আপ ট্রেনে ডাউন পাটকেল
Published : Thursday, 12 January, 2017 at 8:44 PM, Count : 3809

বাদল বিহারী চক্রবর্তী : এবারও নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি হাছেন আলী। গণিত ও ইংরেজিতে বারবার মার খাচ্ছে সে। ফলে আমি এবং আমার বন্ধু নিজাম উদ্দিন এখন হাছেন আলীর সহপাঠী। সহপাঠী হলেও বয়সে সে আমাদের দুজনের চেয়ে প্রায় বছর দুয়েকের বড়। জেলা সদর থেকে আমাদের বাড়ি এক কিলোমিটার দূরবর্তী হলেও ওর বাড়ি জেলা সদরেই। কিছুটা খর্বাকৃতি গড়নের অথচ বাকপটু এই হাছেন আলী ভালো ছাত্র হিসেবে কৃতিত্ব না থাকলে কি হবে, মিথ্যার বাহাদুরি ফুলঝুরি সে অনায়াসেই চালাতে অভ্যস্ত। তাই, সহপাঠীদের সবারই জানা ‘হাছেন আলীর মিথ্যাচার’ সম্বন্ধে। একজন ব্যক্তি কী অবলীলায় একের পর এক মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে, তাতে আমাদের হাছেন আলীর একেবারে মুখে পালিশ। যেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তার মুখ দিয়ে একেকটি দ্রুতগামী আপ ট্রেন ছুটে চলে বিভিন্ন শহরে।
স্কুলে বিজ্ঞান মেলা শুরু হবে। আমাদের প্রধান শিক্ষক তারই প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় ক্লাসে এসে ঢুকলেন। বিজ্ঞানের স্যার তখন আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন। প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের উদ্দেশে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে কে বিজ্ঞান শাস্ত্র ভালো বোঝ? কার কেমন বিজ্ঞানমনস্কতা?’- সবাই চুপচাপ থাকলেও ‘সাচ্চা আলী’ (হাছেন আলীকে আমরা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিদ্রূপ করে সাচ্চা আলী সম্বোধন করি) দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেললো, -‘আজ্ঞে, আমার খালুজান খুব নামকরা বিজ্ঞানমনস্ক স্যার’।
-‘আরে তোমাদের মধ্যে কেউ আছ কি-না, তাই জানতে চাইছি। তোমার খালু-খালা, চাচা-মামার কথা জানতে চাইনি’। শ্রেণিকক্ষে হাসির রোল। প্রধান শিক্ষক মহোদয় সবাইকে থামিয়ে আবার সাচ্চার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আচ্ছা হাছেন আলী, তোমার খালুজান খুব বিজ্ঞানমনস্ক, উনি-’
‘শুধু মনস্কই না স্যার, উনি এ দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীও বটে’। সাচ্চার তথ্যগত জবাব।
‘-তাই নাকি?’ জানার আগ্রহ বেড়ে গেল স্যারের। ‘তোমার খালুজান প্রখ্যাত বিজ্ঞানী! কি নাম তার’?
-‘আজ্ঞে, খালুজানের নাম- ড. কুদরত-ই-খুদা’। সাচ্চার সগর্ব উত্তর।
-‘বল কী! ড. কুদরত-ই-খুদা তোমার আপন খালুজান?’ হেড স্যারের বিস্ময় সূচক প্রশ্ন।
- ‘তবে আর বলছি কি স্যার?’
-‘আগে তো আমাদের বলনি বাবা, যাক, বসো। তুমি আমাদের গর্ব’; স্যারের সঙ্গে সেদিন আমরা ক্লাসের সবাই বিস্মিতই হয়েছিলাম। কিন্তু সাচ্চা আলী পরদিন থেকে পুরো সপ্তাহজুড়ে ক্লাসে ও বিজ্ঞানমেলায় অনুপস্থিত। তার মিথ্যাচার দুই দিনেই সবাই বুঝে গেল।
সপ্তাহান্তে মেলা শেষে অষ্টম দিনে সাচ্চা আলীর ক্লাসে আগমন। একটু নতুন বেশে, পকেটে স্যালাইনের প্যাকেট; চুপ করে বসা সাচ্চা। যথারীতি বিজ্ঞান টিচার ক্লাসে ঢুকলেন। সহসা সাচ্চা আলীকে দেখেই স্যার এক প্রকার রোষেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে হাছেন আলী, এতদিন তোমার কোন মামাজানের বাড়িতে গিয়েছিলে?’; সাচ্চা আলী শান্ত গলায়ই উত্তর দেয়-
-‘আজ্ঞে স্যার, আমার নানাজান, আমার জন্মের আগেই তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন ব্রিটেনের রানীর আমন্ত্রণে এক সফরে গিয়েছিলেন’।
-ভূমিকা রেখে সোজা ভাষায় বলো, স্যারের সক্রোধ জিজ্ঞাসা।
-রানী নানাজানকে বিভিন্ন উপঢৌকনের সাথে সেদেশের এক কার্টন উন্নতমানের ডাল্ডাও দিয়েছিলেন। সে সময় নানা, নানু আর মামা তো ডালডার সম্পূর্ণটুকু খাননি।
-তাতে কি হয়েছে? ওসব আষাঢ়ে গল্প বাদ দাও বাপু; তোমার কথা বলো, স্যার অধৈর্য হয়ে উঠলেন।
-বলছি স্যার, সেই ডালডারই খানিকটা আলমারিতে উঠিয়ে রেখেছিলেন আমার নানুজান। নানা-নানু এখন বেঁচে নেই। গত সপ্তাহে কী যেন খুঁজতে গিয়ে আমি সেটা পেলাম। মামীর বারণ সত্ত্বেও তিরিশ বছর আগেকার ডালডাভাজা পরোটা খেলাম স্যার। আর যায় কোথায়? খেয়ে এমনই ডায়রিয়া হলো-একেবারে সাত দিন শয্যাশায়ী।
রাগে স্যারের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি অগ্নিশর্মা হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন মন্ত্রী তোমার নানাজান, কি তার নাম?’
-আজ্ঞে, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক; সাচ্চার স্বাভাবিক গলায় উত্তর। শুনে স্যার আরও রেগে গিয়ে বললেন,
-বটে, আবার মিথ্যে বলছো? মিথ্যেবাদী কোথাকার।’
 ক্লাসে সবাই চুপচাপ। ক্ষণকাল চুপ থেকে শিক্ষক মহোদয় আবার সাচ্চাকে বললেন, ‘তুমি কি জান, হেড স্যার তোমার প্রতি কী রকম ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন? যাও,এক্ষুণি গিয়ে স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসো’। সাচ্চা ধীরে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল ক্ষমা চাইতে। মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা সালোক সংশ্লেষণ চ্যাপ্টারের প্রশ্নোত্তরগুলো লিখে স্যারের টেবিলে জমা রাখছিলাম, ক্লাসে এসে ঢুকল সাচ্চা। তাকে দেখেই আমরা সকল সহপাঠী হাসিতে ফেঁটে পড়লাম। শিক্ষক ধমক দিয়ে বলেন, এই, তোমরা এভাবে হাসছো কেন? চুপ করো। এবার সাচ্চা যেন একটু ভরসা পেল, ‘ওরা কি বোঝে স্যার? ওরা শুধু ইন্সাল্টই করতে জানে’। আমাকে ডেকে সাচ্চা আবার বলে, ‘এই যে আমির হোসেন, নিজাম আর তুমি তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু; কিন্তু আজও হয়তো জানো না যে আমি কত বড় কবির ভাইপো’। বললাম, না ভাই, জানি না। কথা শুনে শিক্ষক মহোদয় আবার সাচ্চার কথায় মনসংযোগ করে শুধু মাথা উঁচিয়ে বললেন, মানে ?
না, তেমন বাড়-বাড়ন্ত কথা নয় স্যার। বলছিলাম, আমার বড় চাচা যে এদেশের একজন নামকড়া কবি ছিলেন, তাই আমির হোসেনকে বললাম। সাচ্চা সকলের জ্ঞাতার্থে বলছিল।
-তাই নাকি, কে তোমার বড় চাচা ? স্যারের পুনঃ প্রশ্ন।
-ও, আপনারও জানা নেই স্যার?
- কি করে জানবো, এদেশের সকল কবিদেরই তো জানি। কে তোমার বড়চাচা?
- তবে বলি স্যার,পল্লী কবি জসীম উদদীন-ই আমার বড়চাচা।
-আশ্চর্য! তুমি কত ভাগ্যবান, কত বড় বড় মনীষী তোমার আত্মজন, পূর্ব পুরুষ!
-কিন্তু,তাই বলে আমার কোনো অহঙ্কার নেই স্যার।
-না না, তা কেন থাকবে? ভেরি গুড্, ভেরি গুড্, বসো। সেদিন ক্লাসে পাঠদান শেষে স্যার বললেন, শোন তোমরা, আগামীকাল থেকে এক মাসের গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হবে। তোমরা শুধু আম-কাঁঠালই খেয়ো না। একটু পড়াশুনাও চালিয়ে যাবে। স্কুল খোলার পরই পরীক্ষা। তার আগে অন্যান্যবারের মতো এবারও সাঁতার প্রতিযোগিতা আছে। খেলাটা যদিও সর্বসাধারণের, ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ইন্টারেস্টেড হলে নাম দিতে পারো’। পিরিয়ডিক বেল বাজলে স্যার শ্রেণি কক্ষ ত্যাগ করলেন। বাড়ি আসার পথে সাচ্চা - নিজাম ও আমাকে জিজ্ঞাস করে, আমরা সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দেব কি-না। দুজনই জানালাম যে আমরা সাঁতারে পারদর্শী নই। বললাম, ‘তুমি দেবে নাকি?’ সাচ্চা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নিজ শার্টের কলার ধরে বলে, ‘ দেবো মানে ? এদেশের প্রথম জলমানব কে জানো? ’
-মানে, প্রশ্ন করলাম।
-চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস। সেই ব্রজেন কাকার সাথে আমার বাবা সাঁতরে ছিলেন। সে বংশের ছেলে আমি। ধরে রাখতে পারো, এবারকার সাঁতারের ফার্স্ট প্রাইজটা আমারই ভাগ্যের শিকায়’। সাচ্চার আত্মবিশ্বাসী অভিমত। বললাম,  যাক বাবা, বেলুন আর ফুলাবো না, ফেটে যাবে।
-অপেক্ষা করো, বৃক্ষ তোমার নাম কি? ‘ফলে পরিচয়’। সাচ্চার মুখে সংস্কৃত প্রবাদ।
স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। তাতে কি, বাড়ি তো বেশি দূর নয়। মাঠে চার দিন ধরে সাচ্চার দেখা পাইনি। অবশেষে ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি, সাচ্চা কাঁথা গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। বললাম, ‘ কি হে সাচ্চা, এই গরমে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছো যে? সাচ্চা কিছুটা কোঁকানোর সুরে- না, তেমন কিছু নয়।
-নয় মানে, তিন-চার দিন তোমার পাত্তা নেই? জানতে চাইলাম। সাচ্চা একেবারে আমাদের কাছটিতে এসে কাঁথাটা আঁটসাঁট করে গায়ে জড়িয়ে তার চার্মিং গল্প শুরু করলো, ‘ না, তা নয়; দিন তিনেক আগে আমার বড় মামা এসেছিলেন, এসে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। বললেন, চল আমার সঙ্গে ; সেখানে আমার সংগ্রহশালা আছে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বিকেলে হাঁটবি, খুব ভালো লাগবে। গেলাম মামার সাথে। কী বলবো ভাই ! সেখানে মানে, সেই সংগ্রহশালায় মামার আঁকা এতো দুর্লভ ছবি দেখে মনে হয়, জীবন্ত সব’। কথা শোনে এবার কিন্তু আমি নই, নিজাম বিস্ময়াভিভূত, ‘বল কী ! এতো নামকড়া আর্টিস্ট? কি নাম মামার? ’
-ও, তাও বুঝি জান না? কেন, বইতে পড়োনি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নাম? উনিই তো আমার মামা’। কিছুটা কাঁপুনির তালে দ্রুত বলে যায় সাচ্চা। নিজাম মুচকি হেসে আর একটু কাছে ঘেঁষে- ‘তাই বুঝি, তা ভাই, এটা তোমার কত নম্বর ঝাড়ি? ’-এই বলে সাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে দেখে প্রচণ্ড জ্বর। নিজাম চিত্কার দিয়ে ওঠে, ‘একি! তোমার গায়ে যে দেখছি প্রচণ্ড জ্বর! কি করে হলো? ’ এমন সময় পাশের ঘর থেকে সাচ্চার ছোট ভাই, বালক রাশেদ এসে বলে, ‘ জানেন ভাইয়া, আমার ভাইয়া তিন দিন আগে ওপাড়ার পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাচ্ছিল’। বললাম, ‘বল কী! ও তো ভালো সাঁতারু। রাশেদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ ও, সাঁতারু, আমাদের দুই ভাইয়ের কেউ এখনও সাঁতার শিখিনি। সেই পুকুরের পানি খেয়ে ভয় পেয়েই তো ভাইয়ার জ্বর এলো’। ছোট ভাইকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেয় সাচ্চা। আমরা সাচ্চাকে মিথ্যের বাহাদুরিটা এবার বন্ধ করে নিয়মিত ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে, ‘ চলি হে জলমানব ’ বলে চলে এলাম।
স্কুল খোলা হয়ে গেল নির্ধারিত সময়েই। ছাত্রদের মধ্য থেকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় আর কেউ নাম দেয়নি। পুরোদমে ক্লাস চলছিল। বাংলার টিচার একদিন পড়াচ্ছিলেন- বাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে। অর্থাত্, এদেশের চারুশিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যিকদের অপার কৃতিত্ব ও গুণাবলীর কথা আলোচনা করছিলেন। মাঝখানে হঠাত্ পড়া থামিয়ে সাচ্চার দিকে স্যারের চোখ পড়ে। সাচ্চার চোখে জল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে হাছেন আলী, তুমি কাঁদছো কেন? ’ সাচ্চা একটু নড়েচড়ে বসে শুধায়-
-‘না স্যার, আমি মন দিয়েই শুনছি আপনার পাঠদান’। স্যার আবার জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু কান্নাভাব কেন তোমার? ’
-‘ওই যে স্যার, আপনি সঙ্গীত শিল্পীর কথা বলছিলেন তো, তাই-’
-‘তাই কি?’ স্যার প্রশ্ন করেন। জবাবে সাচ্চা সেই কান্না বিজড়িত কণ্ঠেই বলে, ‘আমার ছোট মামা, অল্প বয়সেই মারা গেলেন’।
-‘তিনি গান গাইতেন বুঝি?’
-‘ জ্বি স্যার, লোক সঙ্গীত। তার মতো সঙ্গীত শিল্পী আমি আজও দেখিনি স্যার’। সাচ্চার দৃঢ় বিশ্বাসী কথা।
-‘কি আর করবে বল? আল্লাহ্তায়ালা কখন কাকে পাঠান, কখন নিয়ে যান, সবই তার ইচ্ছা’। শিক্ষক মহোদয় সাচ্চাকে প্রবোধ দিলেন। তিনি আবার তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তা এতো ভালো গান গাইতে পারতেন তিনি- রেডিও, টিভিতে গান গাইলেও পারতেন’। প্রত্যোত্তরে সাচ্চা বলে, ‘কী বলেন স্যার! গাননি মানে? উনি তো শুরু থেকেই রেডিও, টিভিতে গান পরিবেশন করে আসছিলেন’।
-‘তাই নাকি? কই, আমরা তো কোনোদিন শুনিনি? খুব নামডাক নয় বোধ হয়’। স্যারের আন্দাজ করা কথায় সাচ্চা যেন চমকে ওঠে,
 ‘বলেন কী স্যার! আমার মামা আবদুল আলীমের গান শোনেননি?’ এ কথায় স্যার যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘বল কী! ’
-‘জ্বি স্যার, তাই তো অনেক দিন পর সঙ্গীতের প্রসঙ্গ আসায় আমার কান্না আর চেপে রাখতে পারিনি স্যার’।
-‘ না না, ঠিক আছে, ঠিক আছে’। সাচ্চার ভারাক্রান্ত মনকে হালকা করতে চাইলেন স্যার। স্যার আবার বললেন, ‘ছাত্রদের মুখে শুনলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনও নাকি তোমার মামা। তুমি এতো বড় শিল্পীদের ভাগ্নে, তা কি কল্পনা করা যায়? হ্যাঁ জানি, তোমার ছোট মামা অতি অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কান্না শুধু তোমারই নয়, গোটা বাঙালি জাতিই আজ তার জন্যে কাঁদে’। একটু নীরব থেকে স্যার পরবর্তী প্রসঙ্গে গিয়ে বললেন, ‘শোন তোমরা, কাল কিন্তু ই টু বি পড়াবো। মনে আছে তো?’- আমরা সমস্বরে বললাম, ‘জ্বি স্যার’।
-‘আচ্ছা বলো তো, ঘড়ফু নবষরবাবং ধ ষরধত্ বাবহ যব ংঢ়বধশং ঃযব ঃত্ঁঃয-এর বাংলা কি’? আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মিথ্যাবাদী যদি সত্য কথাও বলে, তবু কেহ তাহাকে বিশ্বাস করে না’। স্যার প্রশংসা সূচক ‘মড়ড়ফ’ বলতেই এমন সময় ঘণ্টা বেজে উঠলো। স্যার চলে গেলেন। যাবার সময় স্যার সাচ্চাকে বলে গেলেন, ‘আগামী পরশু পাঁচই সেপ্টেম্বর, মরহুম আবদুল আলীমের মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পীর ছেলেমেয়েরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। হাছেন আলী আমাদের সাথে থেকে তাদের সাথে আমাদের সবাইকে ইন্ট্রোডিউস করে দেবে; বুঝলে হাছেন আলী?’ সাচ্চা ‘জ্বি আচ্ছা’ বলে সায় দিয়ে সেই যে সেদিন থেকে পগার পার হলো, একেবারে পাঁচ দিন।
পূজা ও ঈদের ছুটি শেষে স্কুলের ক্লাসগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছিল। বার্ষিক পরীক্ষার চাপ। চতুর্থ পিরিয়ডে ইতিহাসের টিচার এসেই সাচ্চাকে পেয়ে গেলেন,  ‘কি হে হাছেন আলী, তোমার শিল্পী মামাদের খোঁজ পেলে? বলি, এই পাঁচ দিন স্কুল কামাই দিয়ে, আবার কোন ডাক সাইট আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলে?’ সাচ্চার যেন কোনো অপরাধবোধ নেই। হাসিমুখেই জবাব দেয়, ‘স্যার, এই পাঁচ দিন ছোট ফুফাকে দেখার জন্যে আমাদের বাড়িতে অগণিত লোক সমাগম হয়েছিল।’ স্যার তো রেগে আগুন, ‘চুপ্ করো, আর একটি কথাও বলবে না, মিথ্যেবাদীর গুরুঠাকুর যেন এক’। সাচ্চা এবার ম্রিয়মাণ হয়েই শুধায়, ‘না স্যার, বলবো না’। টিচার পড়ার খোঁজ নেন, ‘পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল পড়া হয়েছে তো? ’
-‘সে কথাই বলছিলাম স্যার’
-‘আমি তোমাকে কি বললাম?’
 -‘জ্বি স্যার, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, আমার ছোট ফুফা-’
-‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ’
-‘নবাবের ভূমিকায় আমার ছোট ফুফা, আনোয়ার হোসেন-’
-‘মানে? আনোয়ার হোসেন তোমার ফুফা?’
-‘ফুফার কথাই তো বলছিলাম স্যার। এই পাঁচ দিন উনি আমাদের বাড়ি ছিলেন বলেই তো বাড়ি এতো লোকারণ্য; আমি কি করে স্কুলে আসি বলুনতো স্যার?’ সাচ্চার এই সাজানো মিথ্যে অজুহাত শোনে টিচার বললেন, ‘দেখো হাছেন আলী, অনর্গল মিথ্যে বলা তোমার একটা বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা, তোমার কি সামান্যতম লজ্জাবোধ নেই?’
-‘কী বলেন স্যার, মিথ্যা বলবো কেন?’ সাচ্চা নিচু গলায় বলে।
-‘ঠিক আছে, বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুল মাঠে নবার সিরাজ- উদ-দৌল্যা যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হবে। তুমি এসে অবশ্যই তোমার ফুফার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে’। সাচ্চার সত্যতা প্রমাণ করার জন্যেই শিক্ষক মহোদয় সাচ্চাকে এমন প্রস্তাব দিলেন। এবারও সাচ্চা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে যায়; পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল ইতোমধ্যে। যাত্রা সপ্তাহও শুরু হয়ে গেল নির্ধারিত সময়ে। সাচ্চার খবর নেই। অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সাথে স্যারের কথা হয় এবং সাচ্চার মিথ্যা ধরা পড়ে গেল।
শীতকালীন তিন সপ্তাহ ছুটির প্রথম সপ্তাহ যাত্রাপালাতেই স্কুলমাঠ সরব ছিল।‘ নবাব সিরাজ উদ-দৌল্যা’ পালা দেখে আমরা বাড়ি চলে এসেছিলাম। ছুটি যখন শেষ হয়ে আসছিল, হঠাত্ একদিন গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে সাচ্চা আলীর সাথে দেখা। জিজ্ঞাস করলাম, ‘কি হে ভায়া, এতদিন কোথায় ছিলে? ’ উত্তরে সাচ্চা বললো- ‘জ্বি, একটু ক্লান্ত আছি ভাই। অনেক জার্নি করেছি, রংপুর থেকে এসে নামলাম’। বললাম, ‘কেন, রংপুর কেন? ’
-‘৯ ডিসেম্বর, ছোট নানুজানের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে গিয়েছিলাম, তার কবর জিয়ারত করতে।’ বললাম- ‘এতো দূর! ’
-‘কেন, নানুজানের বাড়ি তো ওখানেই। দেশ-বিদেশের সবাই চেনেন তাকে।’ সাচ্চার কথায় একটু অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, -‘সবাই চেনেন! কে তোমার নানুজান? ’
-‘আরে, বেগম রোকেয়ার নাম শোননি?’ বললাম, ‘থাক ভাই, পেছনে তাকাও’। সাচ্চা বোকার মতো পেছনের দিকে তাকায়। বললাম, ‘না না, সেই পেছন নয়, তোমার মিথ্যা বলার ট্রেইনটাতে এবার ব্রেক কষো’। আমার কথায় কান না দিয়ে বলে, ‘চলো, বসে একটু সিঙ্গারা খাই’। রেস্টুরেন্টে বসে সিঙ্গারা খাওয়া শেষ হতে না হতেই ইত্যবসরে ঢাকা থেকে বাহাদুরাবাদ গামী ‘সেভেন আপ’ ট্রেইনটা গফরগাঁও এসে থামলে পড়িমড়ি করে এক লাফে ট্রেনে চাপলাম। ‘কোথায় যাচ্ছো’ বলে জানতে চাইলো সাচ্চা। আমি জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বললাম, ‘দাদাজানের বাড়ি যাচ্ছি’। সাচ্চা তখন জানালার একেবারে কাছে এসে বলে- ‘কে তোমার দাদাজান? ’। বললাম, ‘প্রধানমন্ত্রী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’ ট্রেন তখন প্লাটফরম ছেড়ে অনেকটা চলে এলে শুনতে পাচ্ছিলাম, সাচ্চা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে উচ্চ কণ্ঠে বলছিল, ‘যাক বাবা! এ যে দেখছি, আপ ট্রেনে ডাউন পাটকেল মারলে রে ভাই!’



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft