সিন্ডিকেটের ফাঁদে আটকা পড়েছে বিএনপি
Published : Saturday, 21 January, 2017 at 8:59 PM, Count : 2188

* সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই সমালোচনামুখর নেতারা
* চেয়ারপারসনের অফিসকে ঘিরেই যত অভিযোগ
 
এম. উমর ফারুক : নিজ দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন বিএনপি নেতারা। এতদিন তারা এসব সমালোচনা এখানে-সেখানে করলেও এখন প্রকাশ্য সমাবেশ, সেমিনার এবং সাংবাদিকদের সামনেও করতে শুরু করেছেন। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত এসব নেতার তীব্র আপত্তি দলটির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এই সিন্ডিকেটের কবলে বিএনপি তথা চেয়ারপারসন নিজেও আটকা পড়েছে বলেও তাদের অভিযোগ।
ওই সিন্ডিকেটের কারণে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী দলের কমিটিতে যোগ্য নেতারা পদবি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অযোগ্য নেতাদের পদায়ন করা হয়েছে বলেও সুষ্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। পদ-পদবিতে চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা। সিন্ডিকেটের মূলহোতা স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস দলের চেয়ারপারসনকে ভুল বুঝিয়ে এ ধরনের কাজ করছেন বলে পদবঞ্চিত নেতারা প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন।
সবার বক্তব্য শুনে নোমান বলেন, রাজনৈতিক কারণে আলোচকবৃন্দ তাদের মনের মধ্যে যে দুঃখ-বেদনা তা প্রকাশ করেছেন। যারা আলোচনা করেছেন, বিবেকের তাড়নায় তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিজেদের সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করা কঠিন ব্যাপার। আত্মসমালোচনাকে অনেকে ব্যক্তিগত সমালোচনা হিসেবে গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। আজকে সাহসিকতার সঙ্গে যারা আলোচনা করেছেন, তাদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের উপস্থিতিতেই সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, এবার কমিটি করার সময় টাকা দিয়ে পদ পেয়েছেন অনেকে। বিএনপির ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ন আছে, কিন্তু কাজে লাগাতে পারছে না দলটি। জান কোরবান করে যারা রাজপথে থাকেন, তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। মাঠে কী করলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কী আছে, নেতৃত্বের প্রতি আপনার কী আনুগত্য আছে সেগুলো বিএনপিতে বিচার করা হচ্ছে না, বিচার করা হচ্ছে টাকা। টাকা দিলে নাকি বিএনপিতে বড় বড় পদ পাওয়া যায়। তবে সিন্ডিকেটের কবল থেকে খালেদা জিয়া বেরিয়ে না আসলে দলের ভবিষ্যত্ অন্ধকার।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কটাক্ষ করে বলেছেন, বিএনপি কর্মসূচি দেয় কিন্তু নেতারা ঘরে শুয়ে শুয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। তারা কেউ বাইরে যায় না, রাস্তায় বের হয় না। তাহলে কর্মীরা কী করে আন্দোলনে শরীক হবে? বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে মহিউদ্দিন খান মোহন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর প্রসঙ্গ তুলে বলেন, বিএনপিতে আছেন একজন আবাসিক কাম সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, প্রতিদিন ব্রিফিং করতে হবে কেন? লোকজন এখন হাসিঠাট্টা করে। আওয়ামী লীগের লোকজন বলেন, বিএনপি মানে ব্রিফিং অ্যান্ড নিউজ পার্টি। বিএনপিকে ব্রিফিংয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওখান থেকে বের করা যাচ্ছে না।
মোহন আরও বলেন, আজকে বিএনপি আছে বলে মনে হয় না। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ডিআরইউ ছাড়া বিএনপিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়?
বিএনপি ঘরনার বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত পেশাজীবী নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও গত ১৪ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে রিজভীকে সংবাদ সম্মেলন করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তার কথা আমলে নেয়নি রিজভী। উল্টো পরদিন নয়াপল্টনে ব্রিফিং করেছেন তিনি। গুণী মানুষের কদর নেই বিএনপিতে এটাই তার বড় প্রমাণ। এ কারণে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন প্রবীণ ও গুণী ব্যক্তিরা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহন বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকায় ‘অপহরণ’ নাটকীয়তার পর ভারতে আবির্ভূত হয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বিচারাধীন বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনকে এবার যুগ্ম-মহাসচিব থেকে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে আনা হয়েছে। কয়েক দিন ভিডিও বার্তায় টেলিভিশনের ম্যাসেজ দিয়ে অন্তর্ধান হয়ে শিলংয়ে গিয়ে উদয় হলেন, কোনো যোগ্যতা নাই তারে বানিয়ে দিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য। কী যোগ্যতা আছে উনার স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ায়? উনি তো অস্থায়ীভাবে ভারতে আছেন, এখানে স্থায়ী কমিটি সদস্য। কীসব কাণ্ড ঘটছে বিএনপিতে?
ক্ষমতায় গেলে ঢাকা সিটির নাম পরিবর্তন করে জিয়া সিটি করার ঘোষণা দেয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর সমালোচনা করে মোহন বলেন, এর থেকে বালখিল্য কথা আর হয় না। ঢাকার নামকরণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকাকে জিয়া সিটি করার কথা বলে দুদু সাহেব জিয়াউর রহমানকে খাটো করেছেন। আওয়ামী লীগ যে কালচারে বিশ্বাস করে বিএনপিতো সেই কালচারকে বিশ্বাস করতে পারে না।
পদবঞ্চিত মোহন খানের জ্বালাময়ী বক্তব্যের সুর ধরেই  বিএনপির নতুন কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রফিক সিকদার বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটাতে হবে, রাজপথে আন্দোলন দিতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যারা ত্যাগী, যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের আরও বেশি করে মূল্যায়ন করেন। যার যেটি পাওনা সেটি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করলে আগামী দিনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাকে সারাবছর কাজ করানোর পরে আমার শ্রমের মূল্য যদি আপনি আরেকজনকে দিয়ে দেন, আমার বেতন যদি আমাকে না দেন, আমাকে যদি বঞ্চিত করেন, আমার পেটে যদি লাথি দেন আমি যেমন কষ্ট পাব, আরও যারা কষ্ট করেছেন তারাও কষ্ট পাবে।
কাজ ছাড়াই পুরস্কৃত হলে কেউ কাজ করবে না বলে মন্তব্য করে রফিক বলেন, এই বৈষ্যম্যের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে হবে, রাজনীতিবিদদের দিয়ে রাজনীতি করাতে হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, বিএনপির বড় বড় নেতারা একটা সময় মনে করতেন একটা-দুইটা ধানের শীষ বিক্রি করলে কী এমন ক্ষতি। দেখা যেত আমলারা সেই জায়গায় স্থান পেয়েছে। আমলারা কোনোভাবে কাউকে সন্তুষ্ট করে নমিনেশন নিয়েছে, পাস করেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে মনি বলেন, দলের মনোনয়ন না হয় বিক্রি হলো, সেটা আলাদা জিনিস। কিন্তু দলের পদ, মাকে যখন কেউ বাজারে বিক্রি করে সেই সংসার বলতে আর কিছু থাকে না। সেই মানুষকে কেউ মানুষ বলে না, তাকে অমানুষই বলা হয়।
বিএনপিতে যে ৬০০ সদস্য আছে তারা কি কখনো একসঙ্গে একটা মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন ওবায়দুল কাদেরের দেয়া বক্তব্যের সুর ধরে মনি বলেন, দলের নেতাকর্মীরা খুন, গুম হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন জেলে থাকলেও কেন্দ্রীয় বড় নেতারা এ নিয়ে চুপ থাকছেন কেন?
ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, এ নেতাদের মুখ থেকে দলের সমালোচনা শুনে আমি অভিভূত। রাজনীতির ক্ষেত্রে এতটা সরল ও গভীর অনুধ্যান, গভীর বোধ তৈরি করতে পারে, রাজনীতি বলতে যে একটা দর্শন আছে তা তারা স্পর্শ করতে পেরেছেন, এগুলো আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
বিএনপিতে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি ও কৌশলগত দিকের অভাব আছে মন্তব্য করে সুকোমল বড়ুয়া বলেন, দলে গবেষণা প্রয়োজন, তৃণমূলে রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে কর্মীদের খোঁজ-খবরও রাখতে হবে।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft