আঁধার ঘেরা সকাল
Published : Thursday, 9 February, 2017 at 8:58 PM, Update: 09.02.2017 8:59:12 PM, Count : 1320

এম. উমর ফারুক : বিদ্যুত্ নেই। রুমের সবগুলো জানালা বন্ধ। থাই গ্লাসের জানালায় বাহিরের আলোয় কিছুটা আবছা দেখা যায়। রুমে ফ্যান নেই। ভ্যাপসা গরম। একফোঁটা আলো বাতাস কিছুই নেই। গরমে গা দরদর করে ঘামছে। আতঙ্ক আর গরমে শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে নজরুলের। জন্মের পর বাবা-মা নাম তার নাম খুব ভাবনায় পড়েছিল। তার মা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েই ভক্ত হন। তাই কবিকে স্মরণ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু ভাগ্যে কী নিমর্ম পরিহাস। পাড়ার লোকজন তাকে কানকাটা নজরুল বলে ডাকে। ছোটবেলায় কাগজ টোকাতে গিয়ে বস্তির লোকমানের সঙ্গে দ্বন্ধ হয়। এক পর্যায়ে ব্লেড দিয়ে লোকমানের কান কেটে দেয়। এ জন্য নজরুলকে জেলও খাটতে হয় কয়েক মাস। এরপরেই হয়ে ওঠে কানকাটা নজরুল। বাবা ছিল কাগজ বিক্রেতা। শহরের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে পুরাতন কাগজ কিনেন এবং বিক্রি করেন। মা বাসা বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করত। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে নজরুলের জন্ম। জন্মের পর থেকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি সে। অভাব অনটন আর কস্টেও সঙ্গে যুদ্ধ করেই বড় হয়েছে। প্রত্যেকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নজরুলকে কাগজ টোকাতে পাঠাতো ওর বাবা। অভুক্ত পেটে চোখ ডলতে ডলতে উস্কোখুস্কো চুল, নোংরা ছেঁড়া গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই বের হয়ে যেত বস্তা কাঁধে নিয়ে। কোথায় খাবে সকালের খাবার ঠিক জানা নেই। আদৌ খাওয়া জুটবে কি-না তাও জানে না। বাসায় ওর বাবাকে প্রত্যেকদিন কমপক্ষে ৩০ টাকা দিতে হয় কাগজ বিক্রি করে। না হলে বাসার ভাত বন্ধ। প্রচুর মারধর ও করে ওর বাবা ওকে। যেদিন টাকা বেশি রোজগার করতে পারত না সেদিন ভয়ে বাসায় আসতো না। চেয়ে চিন্তে কিছু খেয়ে নিয়ে ফুটপাতে, রাস্তার ডিভাইডারের ওপর কিংবা ওভার ব্রিজের ওপর ঘুমিয়ে থাকতো। ভোরে উঠে পথে পলিথিন, বোতল, রিক্সার স্পোক, কাগজ, লোহা-লক্কর এই সব হাবি জাবি খুঁজতে হয়। নজরুলের বন্ধুরাও এই কাজে যায়। সবাই আলাদা আলাদা টোকায়। কখোনো কখোনো পাল্লা দিয়ে দুই তিনজন এক সঙ্গে টোকায়। সবার একটা সাধারণ দুশমন ছিল সেটা হলো সব পাড়ার কুকুরগুলো। কোনো এলাকার কুকুরই ওদের দেখতে পারতো না। দেখলেই ধাওয়া দিত। আবার লোকজনদের হাতে প্রত্যেক দিনই মারধোর খেত, গালমন্দ শুনত।
একদিন এক বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কোত্থেকে এক লোক হঠাত্ এসে ওর হাত শক্ত করে ধরে বললো- পাইছি তোমারে চান্দু। ওই কুত্তার ছাও কাইল এইহান থিকা পানির পাইপগুলা চুরি কইরা কই বেচ্ছস ক?’
বলতে বলতেই হাতে লম্বা একটা কাঠের তক্তা এগিয়ে দেয় কে যেন। চ্যাপ্টা তক্তা দিয়ে মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো- জানতাম তুই লোভে পইরা আইজও আসবি। কই বিক্রি করছস পাইপ গুলা ক? হারামাজাদা ক?
নজরুল চিত্কার করে বলে- ছার আমি নেই নাই ছার। আমি বেচি নাই ছার। আল্লার কসম ছার আমি চুরি করি না। আইজই প্রথম আপানেগো বাসায় আইছিলাম বোতল টোকাইতে। নজরুলের আকুতি মিনতিতে হয়তো আকাশ কেদেছে। হয়তো পাথর কেদেছে। তবুও ছাড়েনি। নির্দয়ভাবে মেরেছে নজরুলকে। সারা শরীর চওড়া চওড়া দাগে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল সেদিন। একদিন প্রচণ্ড ক্ষুধায় ঝটপট করছে নজরুল। পকেটে টাকা নেই খাবার কিনে খাবে। কয়েকদিন ধরে অসুস্থ্য থাকায় কাগজ টোকাতে পারেনি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থিও হয়ে মহাখালীর ওয়ারলেস গেটের পাশে এক হোটেলের সামনে খাবারের জন্য ঘুরঘুর করছিল। এই দেখে হোটেল মালিক ওর দিকে গরম চা মেরেছিল। মাথার কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল সেবার। মাথার সেই অংশে এখনও চুল ওঠে না।  আরেকদিন ওর চেয়ে বয়সে বড় এক টোকাই বস্তাসহ ওর মালপত্র কেড়ে রেখে দেয়। সেই নিয়ে ওর সঙ্গে মারমারি লাগে। মারের বেশির ভাগটি ওর ভাগেই জুটেছিল। এ রকম মারধোর ওর কপালে কত জুটেছিল তার হিসেব নেই। হঠাত অন্ধকার ঘরটাতে আলো জ্বলে উঠল। সিলিং অনেক ওপরে। মৃদু একটা আলো। সবকিছু আবছা দেখা যাচ্ছে। সাত দিন কেটে গেছে ওই বদ্ধ করে। আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ওর বুকটা ধক করে উঠলো। আবার একপ্রস্থ মারপিট হয়ে যাবে হয়তো ওর ওপরে। ঘরের পশ্চিম কোণে একটা মজবুত লোহার গেট। আরেক কোণায় একটা টেবিল। দুটি চেয়ার রাখা টেবিলটার এপার ওপার। চেয়ারের সঙ্গে হাত পা বাঁধা নজরুলের। গত সাত দিনে জল আর খাবার বলতে খুব কমই জুটেছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা পানির চৌবাচ্চা রাখা আছে। কতবার যে নজরুলকে ওই চৌবাচ্চার ভেতর ঠেসে ধরা হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। আঙ্গুলের ডগায় সুঁই ফোঁটানো, মোটা রোলার দিয়ে পেটানো, গরম পানির বোতল দিয়ে পায়ের তলায় পেটানো, ঘুষি-লাথি, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, নখ উপড়ে ফেলা, হাত পা ব্লেড দিয়ে কেটে লবণ লাগিয়ে দেয়া আরও কত কি?
প্রথম কদিন নজরুল শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর সব বলেও দিয়েছে ও যা জানে। কিন্তু ওরা আরও জানতে চায়। তাই দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছে। পশ্চিম দিকের দরজাটা খুলে গেল।
র্যাবের পোশাক পরা জনা পাঁচেক লোক ঢুকলো। টেবিলের উল্টোদিকে মুখোমুখি চেয়ারে এক নতুন অফিসার বসলো। এতদিন এ অফিসারকে নজরুল কখনো দেখেনি। অফিসারটি বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো- কি নজরুল সাহেব?
কি খবর? এখন শরীরটা কেমন বোধ করছেন?
ছার পানি খামু একটু পানি খাওয়ান। মৃদু শুকনো কণ্ঠে কথাটা বলেই একবার ঢোক গেলার মতো করলো নজরুল।
অফিসারটি ইশারা করতেই এক জওয়ান পানি আনতে চলে গেল। আর কিছু খাবেন নজরুল সাহেব? র্যাব অফিসারটি প্রশ্ন করল।
ছার গরম সিঙ্গারা খাইতে মন চায়। লগে এককাপ দুধ চা। র্যাব অফিসার ইশারা করতেই ঘরের এককোণায় গিয়ে ওদের মধ্যে একজন মোবাইলে গরম সিঙ্গারা আর চায়ের কথা বলে দিল।
নজরুল সাহেব আপনি তো লোকটা খুব কাজের। র্যাবের অফিসারটি এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগলো। এত কিছু পেটে নিয়ে ঘুরেন আগে বললেই তো গত সাতদিনের মারধোর গুলো করা লাগতো না। আপনি যে তথ্য গুলো দিয়েছেন সব যাচাই বাছাই করেছি আমরা। সবই সত্যি। এর মধ্যে আপনার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাঁচ হাজার বোতল ফেনসিডিল, দশটি আগ্নেয়াস্ত্র সহ খিলগাঁও থেকে চাকু মিজান নামে একজন, যাত্রাবাড়ী থেকে ইরা নামে এক ইয়াবা সম্রাজ্ঞীকে ২০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার করেছি। এছাড়াও বগুড়া শহর থেকে কালা আলম, রফিকও জব্বার নামে অস্ত্রসহ তিন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছি। সবই তো ঠিক আছে কিন্তু .....
কিন্তু কী স্যার।
নজরুল সাহেব একটা হিসেব তো মেলাতে পারছি না না। একজন এমপি তার এলাকার এক কমিশনারকে খুন করিয়েছে এই তথ্য তো আমরা মানতে পারছি না। ছার এই নজরুল মিথ্যা কথা কয় না। খারাপ কাজ করতে পারি কিন্তু আমি যে প্রমাণগুলার কথা কইলাম, আপনেরা মিলাইয়া দেখেন, প্রমাণ পাইবেন। কমিশনার আক্কাস ভাইরে এমপি আতাউর খুন করাইছে।
কেন খুন করাইছে? অফিসার জিজ্ঞেস করল।
এলাকায় চান্দাবাজির টাকা নিয়া গণ্ডগোলের সূত্রপাত। তাছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনে কমিশনার আক্কাস এমপি হওয়ার আগ্রহ দেখাইছে। এলাকায় আক্কাসের পক্ষে লোকজন গণসংযোগ চালানো শুরু করে দেয়। দিন দিন আক্কাস ভাইয়ের শক্তি বাড়তে ছিল। এলাকার রাস্তা ঘাটের কাজ-কাম, প্লট দখল, বস্তি দখল নিয়া দুজনের মধ্যে বনিবনা হইতাছিল না। যার কারণে এমপি সাহেব তাকে খুন করান।
বাহ্ সবই জানেন দেখছি। শোনেন এইবার সত্যি কথা বলি। এমপি সাহেব আসছিল ক্যাম্পে। এসে আমার সঙ্গে কোটি টাকার চুক্তি করে গেছেন। যাতে এই খুনে তাকে জড়ানো না হয়।
আপনার গ্রেফতারের কথা শুনেই এসেছিল। বুঝেতেই পারছেন আপনার ওপর নাখোশ তিনি। উনার ডান হাত ছিলেন আপনি এক সময়। পরে আক্কাসের হয়ে কাজ করা আপনার জন্য ভালো সিদ্ধান্ত হয় নাই।
এরই মধ্যে চা, সিঙ্গারা, পানি চলে এলো। হাত পা খুলে দেয়া হলো অফিসারের ইশারায়। নজরুল খুব মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শিঙ্গারা-চা খেতে লাগলো। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? করলে বলেন আমি আপনার জন্য আনিয়ে দেব।
নজরুলের চুপচাপ থাকা দেখে অফিসারটি এবার ভরসা দেয়া কণ্ঠে বললো- আপনি বলেন যা খেতে চান বলেন। সাত দিন এত মারধোর করলো আপনাকে এটা ঠিক হয় নাই। আমি থাকলে মারতে দিতাম না। বলেন কি খাবেন?
স্যার তেহারি খাইতে ইচ্ছা করে খুব। বলেই নজরুল চুপ হয়ে গেল। এই সাত দিন যেন তার কাছে সাত বছরের মতো মনে হয়েছে। মনে হয় কত বছর খোলা হাওয়া খায় না। ছকমলের দোকানের চা, সাইফুলের সিঙ্গারা, ময়না হোটেলের তেহারি খায় না। খাওয়া-দাওয়া হতেই হাত পা বেঁধে অন্ধকার ঘরে রেখে চলে যায়।  আবার সেই অন্ধকার রুমে একা নজরুল। ছোটো বেলার কত কথা মনে হতে লাগলো তার হিসাব নেই। টোকাই থেকে টেম্পোর হেলপার হওয়া, তারপর নেশা করা, খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, সন্ত্রাসী লাইনে যোগ দেয়া, প্রথম খুনের দিন, প্রেমে পরার পরে মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরতে যাবার প্রথম দিন। আরও কত কি?
টেম্পোতে যখন হেল্পারি করতো তখন চলন্ত টেম্পোতে উঠতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। দেড় মাস বিছানায় পড়েছিল। তখন ওর বাবার অকথ্য গালগালি শুনতে হতো প্রতিদিন। বাবা বলতো হারামজাদা মরলেও তো পারতি। তোরে কে এমন বসাইয়া বসাইয়া ভাত খাওয়াইবো। পঙ্গু সাইজা ঘরে পড়ে আছো? আইজই কামে যাবি কুত্তার বাচ্চা। ঘরে তোর খানা নাই আইজ থিকা।
সেই যে পরের দিন ঘর থেকে রাগ করে নজরুল বের হলো আর কোনো দিন সে ঘরে ঢোকে নাই। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত। মাকে এটা ওটা কিনে দিতো। মাসে মাসে হাত খরচ দিতো। বাবার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলতো না।
একদিন রোড এক্সিডেন্টে বাবাও মারা গেল। মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখলো। ছেলে কোথায় যায় কি করে মা ঠিকমতো জানতে বুঝতে পারতো না। প্রশ্ন করলেও উত্তর পেতো না। নজরুলের বয়স তখন বাইশ-তেইশ হবে। এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে সবে নামডাক শুরু হয়েছে। দলে মিটিং-মিছিলের আগে, কোনো মারামারিতে আগে, কোপাকুপিতে রামদা হাতে সবার আগে। এসব কারণে এমপি সাহেবের মনও জয় করে নিয়েছিল সে। নজরুলের সাহসীকতা নিয়ে গর্ববোধ করতো এমপি। এমন বীর ছেলে নাকি লাখে একটা পাওয়া দায়। যে কোনো কাজে নজরুল সবার আগে। জীবনের প্রথম খুন এমপি সাহেবের জন্যই। যে ব্যবসায়ীকে খুন করে। তার সঙ্গে এমপি সাহেবের দ্বন্দ্ব ছিল। এমপি হওয়ার পর ওই ব্যাবসায়িকে কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কমিশনের টাকা এমপিকে দেয়নি। উল্টো এমপিকে দুর্নীতি মামলা দেয়ার হুমকি দেয়। এজন্যই ক্ষেপে যান এমপি। সিদ্ধান্ত নেন খুন করার। আর ওই সময়ে সব চেয়ে বিশ্বস্ত হলো নজরুল। তাই হাতে একটা সদ্য আমদানি করা নাইন এমএম দিয়ে বলল যা ফুটা কইরা দে। ব্যাকআপ আমি দিমু।
সেই শুরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এমপি ছাড়াও ভাড়াটে খুনি হিসেবেও কাজ করে নজরুল। কথা আর কাজের মধ্যে মিল থাকায় অপরাধ জগতে খুব অল্প সময়ে অনেকের মন জয় করে নেয়। একাধিক খুনসহ কয়েকটি মামলার আসামি হয় কানকাটা নজরুল।
একদিন রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে নজরুল। পথে চিত্কার চেঁচামেচি শব্দ কানে আসে। এগিয়ে যায় সামনে। দেখে অনেক লোক জটলা বেঁধে আছে। আর একটি মেয়ের ওরনা ধরে টানছে এক যুবক। মেয়েটি চিত্কার করছে, কেউ তাকে উদ্ধার করছে না। পেছন থেকে গিয়ে মাথায় লাথি মারে নজরুল। যুবকটি পালিয়ে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়ে মেয়েটি। নজরুল মেয়েটিকে নিয়ে পাশের হাসপাতালে ভর্তি করায়। দুদিন পর মেয়েটি পুরো সুস্থ হয়। এ দুদিন নজরুল মেয়েটি সঙ্গে হাসপাতালে ছিল। চিকিত্সার যাবতীয় খরচ বহনসহ সেবাও করেছে।
গার্মেন্টে চাকরি করতো মেয়েটি। এক সময় ওই মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয় নজরুলের। মা এলাকায় বাসায় থাকেন। তাই তাকে সঙ্গ দেয়ার কথা ভেবে ওই মেয়েটিকে কয়েক মাস পর বিয়ে করে নজরুল। দু’বছর পরেই ঘরে এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সুখেই কাটল তার পরের দুই বছর। কিন্তু র্যাব হঠাত্ই সব এলোমেলো করে দিল।
এরই মধ্যে একবার এসে কয়েকজন নজরুলকে ময়না হেটেলের তেহারি খাইয়ে চলে গেল। ওদের প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না- কবে ওকে কোর্টে চালান করা হবে। রাত একটার দিকে হঠাত্ দরজা খুলে গেল। ১০-১১ জন র্যাব এসে নজরুলের হাত পা-এর বাঁধন খুলে দিল। এরপর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে টেনে আনলো রুমের বাইরে। দরজার চৌকাঠ ডিঙিয়ে ডান-পা বাইরে দিতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দরজার ডান পাশে নিম গাছের ডালে বসে কাক কা কা করে চিত্কার করছে। বাম পা আর সামনে দিতে ইচ্ছে করছে না। গেটের সামনে র্যাবের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়িতে বসেই আছে। গাড়িটা স্টাট করা। জোর করে ওই গাড়িতে তুললো।
নজরুল সবাইকে বারবার জিজ্ঞেস করলো- ছার আমারে কই লইয়া যাইতাছেন? ছার আমারে মাইরালাইবেন? স্যার আমারে ক্রসে দিবেন?
একজন বলে ওঠে চোপ হারামজাদা আর একটা কথা বললে তোর মাথার খুপরি উড়িয়ে দেবো। ভয়ে-আতঙ্কে কাঠ হয়ে থাকে নজরুল। সবাই উঠে বসে গাড়িতে। চলতে থাকে গাড়ি। নির্জন রাস্তা। ঘুমিয়ে গেছে রাজধানী। পথে দু-চারজন টোকাই শুয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ছেড়ে দেয় নজরুল। দুই গাল চুয়ে চুয়ে অশ্রু ফোটা পড়ে পায়ের নকে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই চুপ করে বসে আছে।
হঠাত্ থেমে যায় গাড়ি। যাত্রাবাড়ীর এলাকায় এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের পাশে। আশপাশে কোন বাড়িঘর নেই। সিটি করপোরেশন বড় বড় ডাস্টবিন পাশে। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামে র্যারের অফিসাররা। এরপর নজরুলকে নামিয়ে নেয়। পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের ভেঙে পড়া ইটের উপরে দাঁড় করায় নজরুলকে। প্রথমে ডান পায়ের হাঁটুতে তারপর বামপায়ের উরুতে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। মাটিতে পড়ে যায়- নজরুল।
প্রচণ্ড রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে হাউমাউ করে নজরুল বলে ওঠে ছার আমারে মাইরেন না। আমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া চলেন। ছার আমার একটা তিন বছরের মাইয়্যা আছে। বাসায় বউ আছে। আমারে মাইরেন না ছার।
র্যাবের একজন ভারী বুট পায়ে নজরুলের মুখে-বুকে-পেটে লাথি মারতে মারতে বলতে থাকে কুত্তার বাচ্চারা যখন মানুষ খুন করোস তখন মনে থাকে না। তোদের জন্য দেশে এত বিশৃঙ্খলা। তোরা দেশটারে সুন্দর হইতে দিলি না। তোদের একটাকেও দুনিয়াতে রাখবো না। শুয়োরের বাচ্চা চাঁদাবাজি করোস, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ করোস। এ বলেই মাথার খুলিতে আর বুকের বাম পাশে ঠেকিয়ে পরপর দুটি গুলি করে দিল।  বাঁচার আকুতি আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে। গড়াগড়ি খায় নিজের রক্তে। ভিজে যায় বাংলার মাটি। এক সময় নিস্তেজ নজরুল। পড়ে থাকে নিথর দেহ। খবর পায় স্থানীয় থানা পুলিশ। নজরুলের লাশ ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিকে রাখা হয়।  পরদিন কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে বরাবরের মতো ছোট একটা সংবাদ প্রচারিত হলো। লাশের ফুটেজ আর জীবিত অবস্থায় তোলা ছোট্ট একটা ফাইল ফটো। আর সেই একই বিবরণ- এদিকে বন্দুক যুদ্ধে মহাখালীর সাততলা বস্তির কানকাটা নজরুল নামে এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর মৃত্যুর কথা নিশ্চত করেছে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসী কানকাটা নজরুলের দেয়া তথ্য মতে তার সহযোগীদের ধরতে যাত্রবাড়ীতে অভিযান চালাতে যায় র্যাবের একটি বাহিনী। সেখানে আগে থেকে ওঁত্ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। র্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। গোলাগুলির সময় কানকাটা নজরুল পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পরে সেখান থেকে পায়ে, মাথায় এবং বুকে গুলি বিদ্ধ অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে র্যাব। এছাড়া সন্ত্রাসীদের ফেলে যাওয়া দুটি চাইনিজ পিস্তল, ৮-১০ রাউন্ড গুলি এবং কিছু গুলির খোসা উদ্ধার করে র্যাব। টিভিতে সংবাদ দেখে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যায় নজরুলের বউ। তিন বছরের কন্যাসন্তানকে বুকে নিয়ে লাশ ঘরের সামনে কাঁদতে থাকে সে। মাঝে মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সকাল পেরিয়ে দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে। কিন্তু উপরের নির্দেশ থাকায় নজরুলের লাশ নিতে পারেনি তার বউ। কোথায় দাফন করা হয়েছে এ খবরও জানতে পারেনি নজরুলের পরিবার। নাকি দাফন করা হয়নি নজরুলকে?



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft