প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছে
শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সবাইকে চমকে দিয়ে প্রটোকল ভেঙে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে চলে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখানে উল্লেখ্য যে, মোদি তার মেয়াদে এর আগে মাত্র দুইবার প্রটোকল ভেঙে বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। একবার ২০১০ সালে তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এবং সম্প্রতি কাতারের প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদকে এই বিশেষ অভ্যর্থনা জানান তিনি সার্বিকভাবে বললে তিস্তা চুক্তি বাদে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হয়েছে। যদিও তিস্তাই ছিল আমাদের প্রাণের দাবি। এ চুক্তিটি না হওয়ায় আমরা আমরা আশাহত হয়েছি। তবে আশা ছেড়ে দেইনি আমরা। এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি জোর কণ্ঠে বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের চলতি মেয়াদেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে তারা। আমরাও এ আশায় রইলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও হাল ছেড়ে দেয়ার ব্যক্তি নন। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি অবশ্যই কূটনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ভত্রবহফংযরঢ় রং ধ ভষড়রিহম ত্রাবত্-অর্থাত্ বন্ধুত্ব হলো প্রবাহমান নদী। এ ধারণাটিকে ব্যাখা করলে বলা যায়, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে টানাপোড়েন থাকলেও বন্ধুত্ব চলমান। আর চলমান সম্পর্কের ধারায় সব সমস্যাই সমাধান সম্ভব ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে সে সময়কার একটি মহল ‘দেশ বিক্রি হয়ে গেছে’ বলে দাবি তুলেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশ যদি তখন বিক্রিই হয়ে যেত তাহলে তালাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের এই বাংলাদেশের রূপান্তর কীভাবে হলো? আজকের এই বাংলাদেশ তো সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের এক রোল মডেল
Published : Monday, 17 April, 2017 at 8:30 PM, Count : 917

স্বপন কুমার সাহা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে শেখ হাসিনার এ সফর বিভিন্ন দিক দিয়েই তাত্পর্যপূর্ণ। এ সফরে দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষাসহ অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন রয়েছে আসলেই এ সফরে বাংলাদেশ কী পেল।
শুরুতেই যে কথাটি বলতে চাই- দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সব সময়ই পারস্পরিক। এখানে উভয়েরই চাওয়া-পাওয়া থাকে। তবে মাঝেমধ্যে জটিলতার কিছু বিষয় থাকে, যার আড়ালে চলে যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
যদি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের কথা ধরা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় দেশ দুটির সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বিশেষ উচ্চতায় রয়েছে। উভয় দেশের বর্তমান নেতৃবৃন্দের বোঝাপড়াও বেশ দারুণ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত ৭ এপ্রিল ভারত সফরের শুরুতেই সেটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ওইদিন শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সবাইকে চমকে দিয়ে প্রটোকল ভেঙে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে চলে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখানে উল্লেখ্য যে, মোদি তার মেয়াদে এর আগে মাত্র দুইবার প্রটোকল ভেঙে বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। একবার ২০১০ সালে তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এবং সম্প্রতি কাতারের প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদকে এই বিশেষ অভ্যর্থনা জানান তিনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষাসহ ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে এখন কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, সামরিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ চুক্তিতে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয় নেই, বরং কারিগরিভাবে উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যতটা জেনেছি, এ চুক্তিতে ছয়টি মূল বিষয় রয়েছে- প্রথমত সামরিক খাতে ঋণ সহযোগিতা বা লাইন অব ক্রেডিট। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহযোগিতা দেবে ভারত। পাশাপশি সামরিক কেনাকাটার জন্য দেবে আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয়ত, সামরিক সহযোগিতা। এতে বলা হয়েছে, নিজেদের দক্ষতা ও কর্মপরিধি অনুসারে আন্তর্জাতিক আইন, নিজ নিজ দেশের জাতীয় আইন ও পরিস্থিতির আলোকে দু’দেশ নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াবে। তৃতীয়ত, যৌথ প্রশিক্ষণ উদ্যোগ ও বিনিময়। এতে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে- পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের জন্য দু’দেশের সামরিক প্রতিনিধি প্রেরণ; সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন, বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক, তথ্য ও পাঠ্যসূচি বিনিময়; সামরিক যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতা, সামরিক বাহিনী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিত্সার ব্যবস্থা ও সামরিক বাহিনীর জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা, দুর্যোগ মোকাবিলা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রশিক্ষণ; সামরিক ইস্যু নিরসনে আলোচনার জন্য কর্মকর্তা পর্যায়ে বৈঠক, সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাত্সরিক ভিত্তিতে সভা; পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে দু’দেশ নৌজাহাজ এবং এয়ার ক্রাফট ভ্রমণের আয়োজন; পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে দু’দেশ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমানায় যৌথ নৌমহড়ার আয়োজন ইত্যাদি। চতুর্থত, প্রতিরক্ষা শিল্প খাতের সহযোগিতায় যৌথ উদ্যোগ। এতে বলা হয়েছে, পরস্পরকে প্রতিরক্ষা শিল্প খাতে সহযোগিতা দেয়া হবে। এছাড়া রয়েছে স্পেস টেকনোলোজিতে সহযেগিতা, সমুদ্র অবকাঠামোর উন্নয়নে অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং কারিগরি সহযোগিতা। পঞ্চমত, প্রতিরক্ষা গবেষণা সহযোগিতা। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। আরও রয়েছে প্রশিক্ষণ, তথ্য বিনিময় এবং সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী প্রকোশলীদের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে সহযোগিতা। ষষ্ঠত, উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা। বাত্সরিক ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পর্যায়ে বৈঠক। এছাড়া প্রতিরক্ষা সচিব পর্যায়ে বৈঠক করে সামরিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা।
এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভবিষ্যতের সামরিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সহায়তা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতেও এসব সমঝোতা হতে পারে এক বিশেষ মাইলফলক।
এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুতের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার চুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিকস সেক্টরে সহযোগিতায় সমঝোতা স্মারক, সাইবার নিরাপত্তায় সমঝোতা স্মারক, বিচার বিভাগীয় সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতায় সমঝোতা, গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতায় সমঝোতা স্মারকসহ সম্পাদিত সবগুলো চুক্তিই নানা দিক দিয়ে উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরকে কেন্দ্র করে ভারতের গৃহীত আরও কতগুলো পদক্ষেপে দু’দেশের বন্ধুত্বের দৃঢ়তা ফের প্রমাণ হয়েছে। শেখ হাসিনার সফরের আগের দিন দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লির পার্ক স্ট্রিটের নাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়। এছাড়া শেখ হাসিনার এ সফরে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনে সমর্থন দেয় এই বন্ধুরাষ্ট্রটি। দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ভারতের এই সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে জন্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উম্মোচিত হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা (একাধিকবার যাতায়াতের সুযোগ) দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এসব পদক্ষেপে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কৌশলগত মাত্রা ছাড়িয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।
এদিকে শেখ হাসিনার সফরকালে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ ব্রিফিংয়ে এসে উভয়েই নিজেদের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ব্রিফিংয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত এখন সোনালি অধ্যায় অতিক্রম করছে। এ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। আমাদের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে, সেগুলো গুরুত্ব বিবেচনায় শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে।’ এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এবার আসি তিস্তা প্রসঙ্গে। নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ নেতাদের দু’দেশে যতবার সফর হয়েছে, ততবারই তিস্তা চুক্তি ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। তিস্তার পানি আমাদের চাওয়া নয়, ন্যায্য অধিকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেরও মূল আলোচ্য ছিল তিস্তা চুক্তি। এই সফরের আগে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব চুক্তিটি নিয়ে আশাবাদী ছিল। কিন্তু এবারও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অসহযোগিতার কারণে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ২০১১ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে এ চুক্তিটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দু’বারই মমতাজির অসহযোগিতার কারণে চুক্তিটি আজও আলোর মুখ দেখেনি।
তিস্তা ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। এর পানি প্রবাহের ওপর এর তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা তথা অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। এ নদীর পানি প্রবাহের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প। তিস্তা অববাহিকার ভারত ও বাংলাদেশ অংশে বসবাসরত জনসংখ্যার আনুপাতিক হার প্রায় সমান, অর্থাত্ ৫০ : ৫০। সে হিসাবে দু’দেশরই সমান পানি দরকার। তিস্তার পানি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি। ইতোমধ্যে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের বেশিরভাগ ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। তবে মমতা বন্দোপাধ্যায় এবারও প্রতিবেশী বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে গেলেন। বরং এবার তিনি তিস্তার বিকল্প হিসেবে একটি হাস্যকর প্রস্তাব দিয়েছেন। যা নিয়ে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, নয়াদিল্লি সফরকালে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে মমতা সাংবাদিকদের বলেন, তিস্তায় কোনো পানি নেই। পানির অভাবে এনটিপিসির বিদ্যুেকন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। সেচের জন্য পানি পেতে সমস্যা হচ্ছে। এ সময় তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গে তোর্সা, জলঢাকাসহ চারটি নদী আছে। সেখানে পানি আছে। ফলে তিস্তার বিকল্প হিসেবে এই চারটি নদীর পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এটি ছিল মমতার দায়সারা প্রস্তাব যা তিনি কৌশলে তিস্তাকে এড়িয়ে গেলেন। কেননা ওইসব নদীতে কোনো বাঁধ নেই। পানি আসতেও বাধা নেই। তাহলে চুক্তির প্রশ্ন আসবে কেন? আর এক তিস্তায় যে পানি আছে, তা মমতার উল্লেখিত সবগুলো নদীতেও নেই। এমনকি তার উল্লেখিত একটি নদীর নাকি অস্তিত্বই নেই। এ বিষয়ে একজন গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। জবাবে তিনি জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবটি অবাস্তব। কেননা ভারতে যেসব নদীতে বাঁধ নেই, সেসব নদীর পানি বিনা বাধায়ই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব নদীর পানি বাড়লেও তিস্তা অঞ্চলে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। তিস্তাপারের মানুষও উপকৃত হবে না। তাহলে এই বিকল্প প্রস্তাব অর্থহীন। আরেকটি বিষয়, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের এককভাবে পানি প্রত্যাহারের অধিকার নেই। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিটি তিস্তার ক্ষেত্রে পুরোপুরিই অনুপস্থিত। এছাড়া ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাত্ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না।
এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, তিস্তার অধিকরের প্রশ্নে বাংলাদেশকে বারবরই অধিকার বঞ্চিত করা হচ্ছে। একজন গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এমনটা কখনোই আমরা আশা করিনি। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও পুরোপুরি দায় এড়াতে পারে না। বিশ্বস্ত প্রতিবেশী দেশটির ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রশ্নে তাদের উচিত্ ছিল মমতাকে আরও চাপ দেয়া। এ ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ না হলেও সফল হয়নি।
সার্বিকভাবে বললে তিস্তা চুক্তি বাদে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হয়েছে। যদিও তিস্তাই ছিল আমাদের প্রাণের দাবি। এ চুক্তিটি না হওয়ায় আমরা আমরা আশাহত হয়েছি। তবে আশা ছেড়ে দেইনি আমরা। এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি জোর কণ্ঠে বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের চলতি মেয়াদেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে তারা। আমরাও এ আশায় রইলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও হাল ছেড়ে দেয়ার ব্যক্তি নন। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি অবশ্যই কূটনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ভত্রবহফংযরঢ় রং ধ ভষড়রিহম ত্রাবত্-অর্থাত্ বন্ধুত্ব হলো প্রবাহমান নদী। এ ধারণাটিকে ব্যাখা করলে বলা যায়, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে টানাপোড়েন থাকলেও বন্ধুত্ব চলমান। আর চলমান সম্পর্কের ধারায় সব সমস্যাই সমাধান সম্ভব। তবে সময়ের দরকার।
এদিকে একটি গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তিগুলোকে ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। তাদের ভাষ্যমতে- ‘দেশ বেচে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।’ তাদের এসব অযৌক্তিক মন্তব্যের জবাবে বলতে চাই, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ বিক্রি করা সম্ভব নয়। আর বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সমঝোতার মাধ্যমেই চলতে হয়। আর সে রাষ্ট্রটি যদি হয় নিকটতম ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশী, তাহলে তাদের বাদ দিয়ে চলার সক্ষমতা বিশ্বের কোনো পরাশক্তিও দেখায় না। এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে সে সময়কার একটি মহল ‘দেশ বিক্রি হয়ে গেছে’ বলে দাবি তুলেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশ যদি তখন বিক্রিই হয়ে যেত তাহলে তালাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজকের এই বাংলাদেশের রূপান্তর কীভাবে হলো? আজকের এই বাংলাদেশ তো সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের এক রোল মডেল। তাই এসব অযৌক্তিক ও নিরর্থক সমালোচনা বাদ দিয়ে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার আহ্বান জানাচ্ছি। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক নীতি অনুযায়ী আমরা সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে সচেষ্ট হচ্ছি- এটা আমাদের সফলতা। এটাই সঠিক নীতি। আর ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। তাছাড়া বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত আমাদের বিশ্বস্ত সহযোগী। তাই পাওয়া না পাওয়ার সাময়িক হতাশা দেশ দুটির ঐক্যবদ্ধ পথচলায় বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না বলে বিশ্বাস করি। বন্ধুত্ব অটুট থাকলে এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর দাবি বেশিদিন অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান
সাবেক প্রেস মিনিস্টার, বাংলাদেশ দূতাবাস, যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft