শিরোনাম: |
বাগেরহাট জেলা বিএনপি
মৌসুমি নেতাদের দাপটে কোণঠাসা মূলধারা
|
এম. উমর ফারুক: দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর জন্য বাগেরহাট জেলা বিএনপির এখনও নির্দিষ্ট কার্যালয় গড়ে উঠেনি। নেতাদের সুবিধার জন্য একেক সময়ে একেক জায়গায় কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে জেলার কেন্দ্র থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মফস্বল এলাকায় শ্মশানঘাটে জেলা বিএনপির কার্যালয়। নদীর তীরে অবস্থিত এই কার্যালয়ের সুনশান নিরবতাই প্রমাণ করে নিস্তব্ধ জেলা বিএনপির কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন করে শুরু হয়েছে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে জটিলতা। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন আর নিবেদিত নেতাদের বাদ দিয়ে মৌমুমি আর সুবিধাবাদীদের দিয়ে একটি পক্ষ কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু এবার ত্যাগী আর পরীক্ষিত নেতারা সরব হয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে জেলা বিএনপিকে রক্ষার জন্য আবেদন নিবেদন জানিয়েছেন। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের দিয়ে একটি কমিটিও জমা দিয়েছেন তারা।
জেলার একটি বড় অংশের নেতাকর্মীদের এমন আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে খালেদা জিয়া দল পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকা ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহানকে অভিযোগের তদন্ত করে এবং কমিটি গঠন নির্দেশনা দেন। কিন্তু মোহাম্মদ শাজাহানও একতরফাভাবে সুবিধাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতদের পক্ষালম্বন করতে শুরু করেছেন বলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন। এ সময় তারা বলেন, নিরপেক্ষ তদন্ত না করে এবারও যদি কেন্দ্র থেকে যেনতেন নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমরা আর রাজনীতিই করব না। পদত্যাগ করব। ওই আবেদনে বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, জেলার কার্যালয়ের মতোই জেলা বিএনপির নেতৃত্ব মৌসুমি নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে মূলধারার বিএনপির নেতাকর্মীরা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। তারা জানান, জেলা বিএনপির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী মরহুম মোস্তাফিজুর রহমানের সময়ে দলের সেই রমরমা অবস্থা আজ হারিয়ে গেছে। তার অবর্তমানে বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতারা আজ জেলা বিএনপির নিয়ন্ত্রক। এর ফলে দলের নিজস্ব বলয় থেকে উঠে আসা কর্মীরা হারিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতির মাঠ থেকে অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকছেন। এ সকল নেতাদের অর্থ-বিত্তের কাছে কেন্দ্রের কিছু নেতাদের আপসকামিতার কারণে দলের কোনো পদ-পদবি জুটছে না মূলধারার নেতাকর্মীদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেলা বিএনপির সদস্য পদের মতো উচ্ছিষ্ট পদ পেয়েই সন্তোষ্টচিত্তে থাকতে হচ্ছে তাদের। আর দলের সুবিধাবঞ্চিত এই বিরাট অংশ এবং নির্যাতিত এ সকল নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তায় বিএনপির সমর্থনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাচ্ছে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত ইসলামী। তারা আন্দোলনসহ নির্যাতিতদের পাশে অবস্থান করে সাধারণ সমর্থক গোষ্ঠীর আকর্ষণের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যার প্রমাণ উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে একটিতে জয়লাভ এবং ৪টিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ। অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে জেলার ৯টি উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে মাত্র একটিতে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। যদিও প্রচারণা রয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী অংশ এ উপজেলা ছেড়ে দিয়েছে। যার কারণে এ উপজেলা আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনের দিন বিজিবির প্রহারে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায়। নেতাকর্মীরা জানান, জেলা বিএনপির কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য জেলার প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেটে দলীয় কার্যালয় থাকলেও দির্ঘ কয়েক বছর এ কার্যালয় অব্যবহূত অবস্থায় রয়েছে। বিগত জোট সরকারের সময়ে জেলার সাবেক সভাপতি নিউমার্কেটের পরিবর্তে মেহেন্দিকুঞ্জে নিজ বাড়িতে বিএনপির কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ১/১১’র পরবর্তী সময়ে বিএনপির সাইনবোর্ড ফেলে দিয়েছে যা নিজের বাড়ি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। আর এখন শহর থেকে দূরে শ্মশানঘাটে জেলা কার্যালয় থাকলেও দলের সকল কার্যক্রম চলে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী রেজার পুরনো বাজার এলাকার বাসভবনে। জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ২০০৮ জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী জেলা কমিটি ভেঙে বিএনপির প্রবীণ নেতা অ্যাডভোকেট শামসুল হককে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। কিন্তু তার অজ্ঞাতে এবং তার অনুমোদন ছাড়া বর্তমান জেলা কমিটি ঘোষণা করেন কেন্দ্রের দায়িত্বশীলরা। এই কমিটিতে তাকে সদস্য পদেও রাখা হয়নি বলে তাকে কেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন সময়ে ধরনা দিতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে। ফলে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। ২০১২ সালে তিনি মারা যাওয়ার আগে তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী বিএনপির কোনো পদে থেকে যেতে পারেননি। জানা গেছে, ২০০৯ সালের নভেম্বরে বরিশাল জেলা বিএনপির সম্মেলন করতে কেন্দ্রীয় নেতারা বরিশালে যান। তখন এম এ সালাম ও আলী রেজা বাবু কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে একটি বাসে করে সব উপজেলা ও পৌর ইউনিটের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বরিশাল থেকে ফিরেই ঘোষণা দেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বাবু। এ কমিটি বাসের মধ্যে প্রসব হওয়া বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় এক বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, পরে ওই কমিটি কেন্দ্র থেকে অনুমোদন করিয়ে আনেন সালাম-বাবু। অভিযোগ রয়েছে, ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হলেও আজ পর্যন্ত সাংগঠনিক কোনো চিঠি পায়নি কমিটির সদস্যরা এবং কোনো পরিচিতি সভাও হয়নি এ জেলার বর্তমান কমিটির। নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে জানান, কমিটির সভাপতি আবদুস সালাম জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এইচ সেলিমের ছোট ভাই। ওয়ান ইলেভেনের মামলা জটিলতার কারনে সেলিম নির্বাচন করতে না পারায় তার ছোট ভাইকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এ সময় তিনি বিএনপির কোনো সদস্য পদেও ছিলেন না। পরবর্তীতে সেলিম বিএনপি থেকে ইস্তাফা দিলে অরাজনৈতিক আবদুস সালামই হয়ে ওঠে জেলা বিএনপির কর্ণধার। সিলভার এইচ সেলিমের বিএনপির রাজনীতিও খুব পুরনো ছিল না। সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজের হাত ধরে উঠে আসা তার রাজনীতি উত্থান ঘটে অবিশ্বাস্যভাবে। হাওয়া ভবন বিতর্কিত করার সঙ্গে তার নামও জড়িত রয়েছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বাবুর রাজনীতি জাতীয় পার্টি থেকে শুরু। ১৯৯৭ সালে বিএনপিতে যোগদান করে এখন তিনি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এছাড়া সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ওয়াহিদুজ্জামন দিপু, শেখ নজরুল ইসলাম (১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়া হত্যা মামলার আসামি) জাতীয় পার্টি থেকে উঠে আসা। এছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবদলের সভাপতি ফকির তরিকুল ইসলাম (অভিযোগ রয়েছে তার বাবা রজ্জব আলী ফকির রাজাকার ছিলেন) জাতীয় পার্টি থেকে যোগদান করেছে। এ রকমভাবে জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলে রেখে মূলধারার নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন এবং জেলার রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব বরাবর অভিযোগ করেন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৪ সালের আন্দোলন এর সময় ঘণ্টা হিসাবে ২-১ বার জেলার সভাপতি বাগেরহাট গেলেও পুলিশ পাহারায় আশা যাওয়া করত। ২০১৫ সালের আন্দোলনের অধিকাংশ সময় জেলা সভাপতি বিদেশে অবস্থান করেছে। অথচ সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অবরোধবিরোধী সমাবেশে কাওরান বাজারে উপস্থিত থেকেছেন। স্থানীয় একাধিক বিএনপি নেতা বলেন, জেলা বিএনপির তিন শীর্ষ নেতা সালাম-বাবু-দীপুর কেউ বিএনপি করতেন না। নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারাই এখন বাগেরহাট বিএনপির হর্তাকর্তা। অথচ দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা নেতাদের অবমূল্যায়নে অনেকেই হতাশ। বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলায় বিএনপির কোনো কার্যক্রম নেই। বিএনপির কোনো কর্মসূচি পালিত হয় না। উপজেলা কমিটি সচল না থাকায় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডগুলোও মৃত। রাজনীতির প্রাণ হচ্ছে ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটি কিন্তু কাগজের কমিটি হওয়ায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও কাগজে সীমাবদ্ধ থাকে। অঙ্গ সংগঠনগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। জেলা যুবদল এক যুগ আগে গঠিত হয়েছে, জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তানু ভূঁইয়ার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ দলের সকলপর্যায়ের নেতাকর্মীরা, জেলা মহিলা দল কয়েক বছর ধরে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি সালাম-বাবুর অসহযোগিতার কারণে নিভু-নিভু অবস্থায় রাখা হয়েছে। এ সকল অঙ্গ সংগঠনের উপজেলা পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও গঠন হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। সবকিছু্র নিয়ন্ত্রক এম এ সালামের বাইরে কোনো কিছুই হয়ে ওঠে না বলে নেতাকর্মীরা জানান। এ ব্যাপারে আবদুস সালাম বলেন, বাগেরহাট জেলার বিএনপির সবগুলো কমিটিই সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় রয়েছে। আমাদের জেলা কমিটি নিয়ে কোনো ধরনের ঝামেলা নেই। জেলা বিএনপির কার্যালয়টি পুরাতন শহরে অবস্থিত হলেও কার্যক্রম চালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওই অফিসটি অনেক বড় হওয়ায় মিটিং-সমাবেশ করতে সুবিধা হয়। জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম খান বলেন, জেলা বিএনপি এখন শ্মশানে গেছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা জেলা বিএনপির ঠিকাদারি নেয়ায় দল এখন ধ্বংসের পথে। সেলিম সাহেব দলকে তার ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করে বাড়িতে অফিস করেছিল। আরেক ভাই এম এ সালাম জীবনে বিএনপি না করে নমিনেশন পেয়েছে প্রাথমিক সদস্য পদ জেলার সভাপতি। তিনি ও ভাইয়ের মতো শ্মশানে জায়গা কিনে অফিস করেছেন বিল্ডিং করার আশায়। তিনি বলেন, নেতৃত্বে ব্যর্থতা ও নমিনেশন বাণিজ্যের ফলে ৭৫ ইউনিয়নে দলীয় ৭-৮টি চেয়ারম্যান পেয়েছি, উপজেলা নির্বাচনেও ভরাডুবি। জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাগেরহাটে থেকেও ভোট দিতে যাননি। নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে বাগেরহাট থেকে পালিয়ে যাওয়া নেতৃত্বকে বাগেরহাটবাসী ঘৃণা করে। নেতাকর্মীরা গোলামির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চায়। এ ব্যাপারে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। |