পবিত্র লাইলাতুল কদর মর্যাদাপূর্ণ রজনী
Published : Wednesday, 21 June, 2017 at 9:53 PM, Count : 1467

এম. শামসুদদোহা তালুকদার : রমজান মোবারক মাস আল্লাহ্র নূর আর খাইরিয়্যাতে ভরপুর। রমজান মাসে আর যদি কোনো ফজিলত না থাকতো, তা হলে এ ফজিলতই তার জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহতায়ালা এ মাসটিকে পবিত্র কোরআন নাজিল করার জন্য নির্বাচন করেছেন। রমজান শরিফের মহান বৈশিষ্ট্যের বয়ান করেছেন স্বয়ং আল্লাহ জাল্লা শানুহ। তিনি এরশাদ করেছেন- ‘রমজান হচ্ছে সেই মাস, যার মধ্যে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারাহ্, আয়াত-১৮৫)। কোরআন নাজিল করার জন্য রমজান মাসের মাঝে এমন এক রাতকে নির্বাচন করা হয়েছে, যাকে এ রমজান কারীমের রূহ ও বরকত সম্ভারের প্রাণ বলা যায়। ‘লাইলাতুল কদর’ই হচ্ছে সেই মর্যাদাবান রজনী। অত্র অঞ্চলে ‘শবে কদর’ নামে বিশেষ পরিচিত এ বিশেষ সম্মানিত রাতটি উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য বোনাস স্বরূপ। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে পূর্ণ একটি সুরা নাজিল করেছেন শবে কদরের মহিমা উপলক্ষে। আল্লাহ্র বাণী- ‘আমি একে (কোরআন) নাজিল করেছি শবে কদরে। শবে কদর সম্মন্ধে আপনি কি জানেন? শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেস্তাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা আল-কদর- ১-৫)। অত্র সুরাটি অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিত হচ্ছে, ইবনে আবী হাতেম (রা.) এর রেওয়ায়েতে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার বণী-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল ছিল এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেননি। মুসলমানগণ এ কথা শুনে বিস্মিত হলে অত্র সুরাটি অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদাতই সে মুজাহিদের এক হাজার ইবাদাতের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। (মা’আরেফুল কোরআন)।
আরবী শব্দ ‘কদর’ এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। রমজান শরিফের শেষ দশকের মধ্যে বেজোড় এ রাত্রির মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে একে ‘লাইলাতুল কদর’ তথা ‘মহিমান্বিত রাত’ রাত বলা হয়। আবু বকর ওয়াবরাক বলেন: আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোনো সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না, সে এ রাত্রিতে তাওবা-এস্তেগফার ও ইবাদাতের মাধ্যমে সম্মানিতও হয়ে যায়। শবে কদর সমর্থক শব্দ, ‘শব’ ফারসি শব্দ, এর অর্থ ‘রাত্রি’। কদরের আরেক অর্থ ‘তাকদির’ এবং ‘আদেশ’ও হয়ে থাকে। এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেস্তাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয় মাওলা পাকের দরবার থেকে। এমনকি এ বছরে কে হজ করবে, তাও লিখে দেয়া হয়। এ কারণে এ রাতকে ভাগ্য রজনীর রাতও বলা হয়। এমনকি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর উক্তি অনুযায়ী চারজন ফেরেশতাকে এসব কাজে সোপর্দ করা হয়। তারা হলেন ইসরাফিল, মীকাইল, আযরাইল ও জিবরাঈল (আ.) প্রমুখ।
মহান আল্লাহর অপর একটি ইরশাদে ‘লাইলাতিম মুবারাকাহ’র উল্লেখ আছে। অধিকাংশ তাফসিরকারদের মতে এর অর্থ শবে কদরকেই বোঝানো হয়েছে। এ রাত্রিতে তাকদির সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পন্ন হওয়ার অর্থ এ বছর যে সব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লাওহে মাহফুয থেকে নকল করে ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা। নতুবা আসল বিধি-লিপি আদিকালেই লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে।
কোরআনুল কারীম সব সময় লাওহে মাহফুজে সুরক্ষিত ছিল এবং প্রিয় নবী ও রাসুল (সা.) এর ওপর তার অবতরণ শুরু করার পূর্বে মহান আল্লাহ্ একবারে লাওহে মাহফুজ থেকে বাইতুল মামুরের ওপর নাজিল করেছেন। এটি হচ্ছে ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের ইবাদাতগাহ। এ সব প্রক্রিয়া কিন্তু রমজান কারিমের লাইলাতুল কদরে সংগঠিত হয়েছিল। বাইতুল মামুর থেকে নবী করীম (সা.) এর কাছে কোরআন নাজিলের সূচনার জন্য এই ‘লাইলাতুল কদর’কেই বেছে নেয়া হয়েছে।
সব ঐশী কিতাব রমজানেই অবতীর্ণ হয়েছে কিন্তু পবিত্র কোরআন রমজান কারীমের লাইলাতুল কদরে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) সহিফাসমূহ ৩ রমজান, তাওরাত ৬ রমজান, ইনজিল ১৩ রমজান এবং যাবুর ১৮ রমজানে অবতীর্ণ হয়েছে। আর পবিত্র কোরআন রমজান শরিফের শেষ দশকের বেজোড় দিবস লাইলাতুল কদরে নাজিল হয়েছে।
‘লাইলাতুল কদর’ কোনো রজনী এ বিষয়ে মতভেদ আছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রির প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় সংখ্যক রাতে তোমরা লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (সহিহ বুখারি)। সহিহ মুসলিম শরিফে উল্লেখ আছে- রাসুল (সা.) রমজানের শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলেছেন। রাসুল (সা.) অত:পর শেষ সাত রাত্রির মাঝে লাইলাতুল কদরের সর্বাধিক সম্ভাবনাময় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন- ‘যে তা (লাইলাতুল কদর) অনুসন্ধান করবে সে যেন অনুসন্ধান করে সাতাশের রাতে। এবং তিনি আরও বলেছেন- তোমরা লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর সাতাশের রাতে।’ (সুনানে আহমাদ)।
সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.) শপথ করে বলেছেন- লাইলাতুল কদর ২৭ রমজানেই ঘটে। উম্মতে মুহাম্মাদি, সমগ্র বিশ্বের মুসলিমগণ ২৭ রমজানকে শবে কদর হিসেবে বেছে নিয়ে সমগ্র রাত্রিটিকে ইবাদাতের মাধ্যমে কাটিয়ে দেয়। ওই রাতটি জাগরণের ক্ষেত্রে প্রিয় নবী (সা.) ব্যাপক উত্সাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সঙ্গে এ রাত্রি জাগরণ করবে, তার পূর্বের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারি)। বর্ণিত আছে- রাসুলুল্লাহ (সা.) কে তার উম্মতের বয়ঃসীমা বলে দেয়া হলে তাদের বয়সকে কম মনে করলেন এবং ভাবলেন যে, আমার উম্মত এত কম বয়সে পূর্ববর্তীদের সমান ইবাদত করতে সক্ষম হবে না। তখন আল্লাহতায়ালা তাকে শবে কদর দান করলেন, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (মুয়াত্তা মালেক)।
শবে কদরে পবিত্র কোরআন নাজিল হবার বিরাট হেকমত রয়েছে মুসলিমগণ প্রতি বছর কোরআন নাজিল হওয়ার মতো ঐতিহাসিক ঘটনা রাত জেগে আল্লাহতায়ালার ইবাদত করে, তার দরবারে দোয়া করে এবং রোজা রেখে স্মরণ করে থাকে। শবে কদর থেকে বান্দার ফায়দা লাভ করা এবং কোরআন নাজিলের শোকর আদায় করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে প্রত্যেক মুসলিম এ রাতটি জাগ্রত থেকে এখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ্, জিকির ও তাওবা ইস্তিগফারে মশগুল থাকবে। প্রিয় নবী ও রাসুলের (সা.) প্রতি তাঁর উম্মতগণ দরুদ ও সালাম পেশ করবে, মিলাদ-কিয়াম করবে আর সর্বক্ষণ আল্লাহর কাছে গুনাহ্ মাফের জন্য তাওবা ও দোয়া করে থাকে। সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, যে উদ্দেশ্যে মহাগ্রন্থ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে তার ইজ্জত রক্ষা ও নির্দেশনা পালনে জান-মাল কোরবানিতে তাদের মাঝে কোনো ইতস্ততা নেই।
শবে কদরের ক্ষণে ক্ষণে অত্র দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার ব্যাপারে আমরা যেন দায়বদ্ধ থাকি। কারণ কদরের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) সেজদা দিয়ে এ দোয়াটি পড়তেন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফওয়ুন, কারীমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।’ হে আল্লাহ আপনিই ক্ষমা (ক্ষমাশীল), পরম দয়াময়, ক্ষমা আপনার পছন্দনীয়। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (আহমাদ ইবনে মাজা, তিরমিজি)।
আসুন কোরআন নাজিলের এ মাসটির   বিদায়বেলা আমরা সবাই তওবা করে নতুন আবেগ সঞ্চারণ করি। আর আগামীতে আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ আল্লাহর কিতাব ও রাসুলে কারীম (সা.) এর পাকিজা সুন্নাত মোতাবেক গড়ে তুলতে পারি।

[লেখক : ইসলামী গবেষক]



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft