জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
Published : Thursday, 20 July, 2017 at 8:38 PM, Count : 2309

মিজানুর রহমান : আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অপরিসীম। কৃষিকে ঘিরে প্রাণচঞ্চল গ্রামীণ জনজীবন। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং জীবনযাত্রার সামগ্রিক মানোন্নয়নে কৃষি এবং এর উপখাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সম্প্রতি খবরে পাওয়া গেছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে আছে উপকূলের কৃষি জমি ও ফসল। অপরিকল্পিত কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তি। এতে হ্রাস পাচ্ছে উত্পাদন, বিষাক্ত হচ্ছে পানি। কৃষি জমির এ ক্রমশ বিপর্যয় থেকে উত্তোরণের জন্য প্রযুক্তিগত তেমন কোনো প্রস্তুতি না থাকায় কৃষিনির্ভর উপকূলীয়রা ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে কৃষিজমি ও ফসল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট আবাদযোগ্য ভূমির ৩০ শতাংশ এ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। উপকূলীয় ২.৮৫ মিলিয়ন ২৮.৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ০.৮৩ মিলিয়ন ৮.৩ লাখ হেক্টর জমিই লবণাক্ততা দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ১৯৭৩-২০০০ সাল পর্যন্ত উপকূলের মাটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ কারণে এখানকার জমির উর্বর শক্তিরও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে দেখা দিচ্ছে পোকার আক্রমণ, ধানে চিটাসহ নানা প্রকার ক্ষতির প্রভাব পড়ছে উত্পাদিত ফসলে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর পটুয়াখালীসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ এবং ২০০৯ সালের ‘আইলা’র পর এসব জেলা ও উপজেলায় মিঠা পানির অভাব তীব্র হতে শুরু করেছে। নদ-নদী ও ফসলি জমিতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে সমুদ্রের লোনা পানি। ফসল উত্পাদনে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক। আর এ কারণে কৃষকরা শুরু করেছেন ফসলের পরিবর্তে চিংড়ি ও সাদা মাছের চাষ। স্থানীয় তথ্যে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৪ হেক্টর আবাদি জমি থাকলেও তার মধ্যে শুধু আমন মৌসুমেই পতিত থাকছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ হেক্টর জমি। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চাষকৃত ফসল ঘরে তুলতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এসব বিপর্যয় কাটিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে কৃষকরা পতিত জমিকে বহু ফসলি করায় আগ্রহী হয়ে উঠলেও তা নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আটকে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রসার না ঘটা এবং ক্রমশ মিঠা পানির হ্রাস পাওয়া। উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশ কমেছে এবং সাগর ও নদের জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সহজেই লোনা পানি প্রবেশ করছে ফসলি জমিতে।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে জমিতে লবণাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে কৃষকদের লবণাক্ততা নির্মূল জাতের ধানের চাষের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া খরাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিম্নমুখী হয়ে সেচকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এর ফলে বিভিন্ন কৃষির উত্পাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রের লোনা পানি চট্টগ্রাম উপকূলীয় অঞ্চলের আবাদি জমিতে প্রবেশ করায় মিঠাপানির মত্স্য সম্পদ, ফসল দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ বিশ্লেষকরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে যাবে। এতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে ফসল উত্পাদনের মৌসুম। কৃষকরা যথাসময়ে জমিতে যথাযথ ফসল উত্পাদন করতে পারবেন না। ফলে, এ উপজেলায় খাদ্য ঘাটতিসহ কৃষকরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটবে পরিবেশ বিপর্যয়ের।
শুধু আবাদি জমিই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানি উপরে উঠে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে। আর এতে প্রাণহানিরও আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। অনুসন্ধান মতে, যেখানে চাষাবাদ পাহাড়ি ঝরনার ওপর নির্ভরশীল, সেখানে অনাবৃষ্টি, খরা ও অতিবৃষ্টির ফলে চাষাবাদে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকায় ক্রমান্বয়ে বনায়নের মাধ্যমে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি।
এ দেশের কৃষকসমাজ তাদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের জীবন মান উন্নয়নে অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছেন, পাশাপাশি ১৬ কোটি মানুষের ক্ষুধার অন্ন সংস্থানের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের কৃষি ব্যবস্থার ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা উদ্বেজনক। এক সূত্র মতে, গত ২০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম ৫০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছিল তিনটি। শেষ ৫০ বছরে হয়েছে ৫১টি। যদিও বৈশ্বিক উষ্ণতাসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবী হুমকির মুখে। তবে বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমি ক্ষয় ও পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। লবণাক্ততার কারণে বাংলাদেশে বছরে কৃষি জমির ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকার এক হিসাব দেখানো হয়েছিল গত বছর তিনেক আগে। বর্তমানে এই ক্ষতি নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে।
দেশের ১৮টি জেলা, ১৩৭টি উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চলের আওতাধীন। ৩৮টি উপজেলা সরাসরি সাগরের মুুখোমুখি অবস্থানে। উপকূলীয় অঞ্চলে ২.৮ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি রয়েছে। যেখানে দেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান উত্পাদন জমি অন্তর্ভুক্ত। উপকূলীয় অঞ্চলে ৪ কোটি ৬০ লাখ জনগণের বাসভূমি। বিশ্ব ঐতিহ্য অঞ্চল সুন্দরবনের অবস্থানও এ অঞ্চলে।
লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ বিশেষ করে সুন্দরী গাছের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা লবণাক্ততা বাড়ছে বলেই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ আক্রান্ত হচ্ছে আগামরা রোগে। সিডরে সুন্দরবনের কারণে উপকূল অনেকটা রক্ষা পেয়েছিল এবং সুন্দরবনের অনেকটা ক্ষতিও হয়েছে। তবে এ জলবায়ু পরিবর্তন থেকে সুন্দরবন রক্ষা না পাওয়ার আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা। শুধু সুন্দরবনেই এর প্রভাব পড়বে না, এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না উপকূলীয় অঞ্চল বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিসহ প্রায় ৬ লাখ মানুষ যারা জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া পটুয়াখালী ও পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার কয়েক লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার কারণে কৃষিজমি, গবাদিপশু, মানুষের জীবন ধারণ ও বিভিন্ন ভৌত কাঠামোসমূহ হুমকির সম্মুখীন হবে। নদীর পানি ও ভূগর্ভস্থ জলাশয়ের লবণাক্ততা বেড়ে যাবে যাতে পানি সরবরাহ, কৃষি ও সামগ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ২৩ বছরে জোয়ার-ভাটার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হীরন পয়েন্ট, চরচেঙ্গা ও কক্সবাজারের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৪.৬ ও ৭.৮ মিমি. হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১ মি. বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ১৭.৫ শতাংশ ভূমি প্লাবিত হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ শতাংশ ভূমিতে অতিমাত্রায় লবণাক্ততা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মি. বৃদ্ধির কারণে অতিমাত্রায় লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ হবে শতকরা ১১ ভাগ। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সময়ে যশোর, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও ঝালকাঠির ভূমির মাটি লবণাক্ত হয়েছে। ভাঙন, ভূমি ক্ষয় ও নতুন চর জেগে ওঠা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় অঙ্কিত ১৯৫৫ সালের মানচিত্র এবং ২০০৬ সালের ভূ-উপগ্রহ চিত্র পর্যালোচনা করলে এই ভাঙাগড়ার খেলা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ১৯৯১ সালের মহাপ্লাবন সিডর বা আইলার মতো শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস বা সাইক্লোন সারা উপকূলকে তছনছ করে যায়। এছাড়া বন উজাড়, নগরায়ণ উপকূলীয় ভূমির জন্য বিশেষ হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বৈরী আচরণে কৃষি ও পরিবেশ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে স্পষ্টত প্রভাবিত করেছে। ভূমিহীন চাষি, প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড় চাষি মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাবে কৃষক পরিবারের অনেকেই কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বৈরী জলবায়ুর সবচেয়ে বড় শিকার কৃষি ও কৃষক সমাজ। আগামীর মহাদুর্যোগে মহাপ্লাবনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। বৈরী জলবায়ুর মোকাবিলায় আসুন জাতীয় ঐক্য গড়ে আমরা সবাই কৃষকের পাশে দাঁড়াই।
লেখক: কলাম লেখক।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft