জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষ
Published : Thursday, 27 July, 2017 at 9:21 PM, Count : 2504

নিতাই চন্দ্র রায় : বৃক্ষ রোপণ, পরিচর্যার ও সংরক্ষণের বিষয়ে দেশের জনগণকে সচেতন ও আগ্রহী করে তুলতে গত ৪ জুন  থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষ রোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা-২০১৭। এবারের বৃক্ষ রোপণ অভিযানের প্রতিপাদ্য -‘বৃক্ষ রোপণ করে যে, সম্পদশালী হয় সে’।  জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষ অপরিহার্য। পরিবেশ প্রতিবেশ সংরক্ষণ, ভূমির ক্ষয় রোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায়ও বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষের সবুজ বেষ্টনী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা কমিয়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে।
বৃক্ষ রোপণ অনেক পূণ্যের কাজ। পৃথিবীর সকল ধর্মেই বৃক্ষ রোপণকে উত্সাহিত করা করা হয়েছে। বৃক্ষ মানুষের কত উপকার  করে তা বলে শেষ করা যাবে না।  বৃক্ষের দেয়া অক্সিজেন ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণী এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না।  বৃক্ষ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও ওষুধের ব্যবস্থা করে। পশু-পাখির খাবার ও আশ্রয় দেয়। শিল্পের কাঁচামাল জোগায়। মানুষের সৌন্দর্য পিপাসা মেটায়। বৃক্ষ মানুষকে  ছায়া দেয়, নির্মল বায়ু দেয়, বৃষ্টির পানি দেয়।  মরুময়তা হ্রাস করে। নদীভাঙন থেকে রক্ষা করে। শব্দ দূষণ রোধ করে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে। বায়ুমণ্ডের তাপমাত্রা কমাতে সহায়তা করে ভীষণভাবে। তাপমাত্রা হ্রাসে বৃক্ষ যে কী জাদুকরী অবদান রাখে, তা  ঢাকা নগরের বর্তমান অবস্থা থেকেই ভালোভাবে বোঝা যায়। দেশের যে কোনো গ্রামের চেয়ে রাজধানী ঢাকা নগরের তাপমাত্রা  এখন ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এ ছাড়া সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের অংশের চেয়ে ভেতরের অংশের তাপমাত্রাও  থাকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গবেষণায় এ ভয়াবহ  পরিবেশ বিপর্যয়ের তথ্যটি বেরিয়ে এসছে। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে  এ বিষয়ে গবেষণা করে  ঢাকা নগরের তপ্ত ভূখণ্ড তৈরির কারণ হিসেবে গাছপালা ও জলাশয় ধ্বংস করে অপরিকল্পিত নগরায়নের বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন । এটা শুধু ঢাকায় নয়; সারাদেশের নগরগুলোতে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে  গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নগরে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। ইমারত নির্মাণ বিধি মালায় স্থাপনার জন্য নির্বাচিত জমির একটি নিদিষ্ট পরিমাণ অংশে বৃক্ষ রোপণকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। বসতবাড়ির ছাদে, বারান্দায় ও বেলকোনিতে ফল-মূল, ভেষজ ও  সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ লাগানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণে দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থানের জন্য বৃক্ষ রোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। বৃক্ষ রোপণকে ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আজ একটি মেহগনি, কাঁঠাল, সেগুন, শিলকড়াই গাছ রোপণ করলে ২০ থেকে ৩০ বছর পর তা বিক্রি করে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পাওয়া যাবে, যা অন্যভাবে  এত সহজে অর্জন করা সম্ভব হবে না। গ্রামের মানুষ যখন ছেলে-মেয়েদের বিবাহ-সাদি, জমি-জমা ক্রয়, বাসাবাড়ি তৈরি, সন্তানদের উচ্চশিক্ষা ও রোগ-শোকের চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অন্য কোনো উত্স থেকে জোগার করতে পারে না, তখন বাড়ির আশপাশের বা  নিজস্ব বন-জঙ্গলের রোপণ করা গাছ বিক্রি করেই তাকে সেই অর্থের জোগার করতে হয়। প্রিয়জনের জীবন বাঁচাতে হয়।
 সারা পৃথিবীতে বর্তমানে ৬২ বিলিয়ন ডলারের ভেষজ বৃক্ষের বাজার রয়েছে। এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই ভারত ও চীনের দখলে। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করে। অথচ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে এর প্রায় ৭০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উত্পাদন করা সম্ভব। এছাড়া, কাট ফ্লাওয়ার, ক্যাকটাস, অর্কিডসহ বিভিন্ন শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ রফতানি করেও বাংলাদেশ প্রচুর বিদেশি অর্থ আয় করতে পারে।
 বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর কোটি কোটি গাছের চারা রোপণ করার পরও জাতিসংঘ বলছে, গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি। সে হিসাবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় আট হেক্টর বনভূমি। যে হারে পৃথিবীতে বন উজার হচ্ছে, সে হারে কিন্তু নতুনভাবে লাগানো হচ্ছে না গাছ। বাংলাদেশে গড়ে ২৪ ঘণ্টায়  এক লাখ ৩০ হাজার গাছ কাটার বিপরীতে  লাগানো হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার বৃক্ষ। এতেই বোঝা যায়, প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্যের সঙ্গে কী নিষ্ঠুর আচরণ করছি আমরা। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, একটি গাছ তার ৫০ বছরের জীবনে পৃথিবীর প্রাণিকুলকে  প্রায় ৩৫ লাখ টাকার বিভিন্ন  সুবিধা দিয়ে থাকে।
কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ু দূষণ রোধ করে ১০ লাখ টাকার, বাতাসে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে বায়ুমণ্ডলকে ঠাণ্ডা রাখে ৫ লাখ টাকার, বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে ৫ লাখ টাকার, মাটি ক্ষয় রোধ করে উর্বরতা বাড়ায় ৫ লাখ টাকার, পাখি ও প্রাণীর খাদ্য এবং আশ্রয় দেয় ৫ লাখ টাকার এবং ফল ও কাঠ দেয় ৫ লাখ টাকার। একটি আড়াইশ মিটার চওড়া বন বাতাসে জমে থাকা সালফার ডাই অক্সাইডের প্রায় ৩৫ শতাংশ শুষে নিতে সক্ষম। একটি গাড়ি ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ চলে  যে বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে তা শুষে নিতে পারে একটি বড় গাছ। ক্যান্সার নিরাময়ের জাদুকরী গুণ আছে পৃথিবীর প্রায় এক হাজার  ৪শ’ বৃক্ষ প্রজাতির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। নদী ভাঙনের ভয়াবহতা বাড়বে। কৃষি উত্পাদন হ্রাস পাবে। কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসী হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হলে সারাদেশে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই।
একটি দেশের পরিবেশ সুক্ষার জন্য কমপক্ষে শতকরা ২৫ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের বনভূমি রয়েছে মাত্র শতকরা ৭ থেকে ৮ ভাগ। অন্যদিকে জাপানে ৬৩ ভাগ, মালয়েশিয়ায় -৬২, থাইল্যান্ডে ৪৮ এবং মিয়ানমারে শতকরা ৬৭  ভাগ  বনভূমি  রয়েছে। আগাম মৌসুমী বৃষ্টিপাতের  কারণে সারাদেশে চলছে বৃক্ষ রোপণের মহোত্সব। মানুষ কিনছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ভেষজ ও শোভাবর্ধনকারী গাছের চারা। তবে উত্কণ্ঠার বিষয় হচ্ছে- উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীতে বিক্রীত চারার শতকরা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ হলো- ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমনির। ইউক্যালিপটাস গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়। চারার দাম কম ও সহজ লভ্য। কাঠ বেশ শক্ত। সহজে ঘুণে ধরে না। ক্ষেত-খামারের আইলে, বসতবাড়ির আশপাশে, রাস্তার ধারে, জলাশয়ের পাশের লাগানো যায়। এ কাঠ দিয়ে খুঁটি তৈরি করা যায়। জানালা, দরজার চৌকাঠ ও ঘরের রোয়া, বাতা ও বিম তৈরি কাজে এ গাছ কাজে লাগে।
মানুষ এ গাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। ক্ষেতের আইলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগালে পানির অভাবে ওই ক্ষেতের ফসলের ফলন ব্যাপক হ্রাস পায়। ইউক্যালিপটাস গাছকে বলা হয় সৌর নলকূপ। কারণ এ গাছটি মাটি থেকে প্রচুর পানি গ্রহণ করে এবং প্রশ্বেঃদন প্রক্রিয়ায় তা বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। একটি ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৫০ লিটার পানি ত্যাগ করে। পাকিস্তানে পাহাড়ি ঝরনার পাশে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণের ফলে  ৮০ শতাংশ ঝরনার পানি শুকিয়ে যায়। সেই এলাকায় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৫ বছরে ২ ইঞ্চি কমে যায়। পানির স্তর ৫ থেকে ১০ ফুট নিচে চলে যায়। ভুট্টা ক্ষেতের পাশে এ গাছ রোপণের ফলে ইথিওপিয়ায় ভুট্টার ফলন হেক্টরপ্রতি ৪.৯ থেকে ১৩.৫ টন হ্রাস পায়। সম্প্রতি আফ্রিকান দেশ কেনিয়াতে ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেনিয়ার পরিবেশমন্ত্রী জন মাইচোকি আজ থেকে কয়েক বছর আগে ইউক্যালিপটাস গাছ তার দেশ থেকে সমূলে উচ্ছেদের আদেশ দেন। ইউক্যালিপটাস গাছ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এগাছে কোনো পাখি ও প্রজাপতি বসে না। এ গাছের আশপাশে কোনো গাছ বা বন্যপ্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ যেভাবে সাময়িক লাভের আশায় দেশে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনির মতো ক্ষতিকর গাছ রোপণ করছে, তা অব্যাহত থাকলে এক সময় দেশের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। পানির স্তর আরও নিচে চলে যাবে। মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাবে। পানি ধারণক্ষমতা কমে যাবে। প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাবে। জলজ  উদ্ভিদও প্রাণীর বেঁচে থাকা কঠিক হয়ে পড়বে। বন্যপ্রাণি ও গাছপালার অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই এই পরিবেশবিনাশী বৃক্ষ রোপণ থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনির মতো গাছের চারা উত্পাদন, বিক্রয় ও রোপণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, পরিবেশবাদী সংগঠন, কৃষিবিদ, ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft