শিরোনাম: |
সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় চাই নতুন উদ্যোগ
|
মীর আবদুল আলীম : এইতো সেদিন (১২ সেপ্টেম্বর) মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাসলিমা আক্তার তৃষা প্রাণ নির্দয়ভাবে কেড়ে নিয় বেপরোয়া গতির বাস। দেশের সবকটি পত্রিকায় ফলাও করে সে সংবাদ ছাপা হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বরের একটি পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লিখেছে- ‘সকালে অভিভাবকের হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিল মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাসলিমা আক্তার তৃষা। স্কুল ছুটির পর মায়ের হাত ধরে বাসায় ফিরার পথে বেপরোয়া গতির বাস নির্দয়ভাবে কেড়ে নিয়েছে শিশুটির জীবন। কাফরুল থানায় শিশুটির লাশের সম্মুখে বসে বিলাপ করতেছিলেন হতভাগ্য মা। এমন নৃশংস নির্বিবেক ঘটনা আর কোথাও ঘটে কি-না আমাদের জানা নাই।’ সড়ক দুঘর্টনার ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়তই এভাবে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় আর সংবাদ প্রকাশ করে আমাদের পত্রিকাগুলো, কিন্তু কি হয় তাতে? কার কথা কে শোনে? সরকার সচেষ্ট না হলে; চালক হেলপার জনগণ সচেতন না হলে, দুর্ঘটনাতে ঘটতেই থাকবে।
যেদিন লিখছি (১৪ সেপ্টেম্বর), সে রাতে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকা ফিরেছি। গিয়ে ছিলাম ইন্দোনেশিয়াতেও। মালয়েশিয়ার সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের তুলনা করা আমার বোকামিই হবে, তবে ইন্দোনেশিয়ার সড়কগুলো আমাদের চেয়ে প্রশস্ত আর ভালো তা বলা যাবে না। বলতেই হয়, তাদের সড়কে নিয়মকানুন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মানে সেখানকার চালক এবং জনগণ। সড়কগুলোতে ডিভাইডার খুব কম। একমুখী রাস্তা যা আছে তা জাকার্তায়। ট্রাফিক চোখে পরেনি, তবু নিয়ম-নীতি মেনে তবেই সবাই সড়ক পাড়াপার হচ্ছে, আর চালকরাও ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালাচ্ছে। ১৮ বছরের নিচে চালক সেখানে নেই। আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল, গুলিস্তানের রাস্তা তো ১২/১৩ বছরের চালককেও দাবড়ে লেগুনা গাড়ি চালাতে দেখা যায়। তাই যা হবার তাই হয়। রাজধানীতে অবৈধ যান, আর অদক্ষ চালকের কারণে প্রাণ দিচ্ছে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, পথচারী। আমরা নিয়ম মানি না তাই দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ ঝরছে পথে-ঘাটে। ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ নিয়মনীতির মধ্যে আছে বলেই সেখানে সড়ক দুর্ঘটানা খুব কম হয়। ওরা পর্যটনে আধুনিক হলেও গড়ে সেখানকার অধিবাসীদের আমাদের চেয়ে জীবনযাত্রার মান অনেক কম। আমাদের ১ টাকা সমান ওদের ১৫৯ টাকা। এবার ১শ’ ডলারে সারে ১৩ লাখ টাকা পেয়েছি আমরা। তার পরও ওরা সভ্য। ওরা রাস্তার নিয়ম মানে সবাই। সে দেশের সরকার তাদের নিয়ম মানতে বাধ্য করেছে। এখন তারা নিয়ম মানতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমাদের সরকার সংশ্লিষ্টরা কি করছেন? তারা ভাবনাবিহীন সময় পার করছে নাকি? তা না হলে প্রতিদিন পথে এত মানুষ মরছে কেন? নিয়ম মানছে না কেন পরিবহন চালক? এ দেশের জনগণও নিয়ম মানে না। নিয়ম মানতে চাইলে সরকার জনগণকে নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারে। আমি যখন রাজধানী ঢাকায় পড়াশুনা করি, তখন মনে পড়ে বাসে চড়তে গিয়ে ধক্কা-ধাক্কিতে শার্টের কলার আর বোতাম ছেড়ার ঘটনা কত যে ঘটেছে তার ইয়াত্তা নেই। এখন কি দেখি আমরা? অবৈধ ডাইভারের, অবৈধ লেগুনায় চড়তেও মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়ায়। নিয়ম করে দেয়া হয়েছে তাই নিয়ম মানে জনগণ। নিয়ম মানালেই মানবে জনগণ আর চালক। আমাদের দেশের মানুষ তো এতটা অসভ্য নয়, যে নিয়ম মানবে না। কতিপয় ভিআইপিদের গাড়ি উল্টো পথে চলতে দেখি। তাদের দেখে জনগণের মনে তো এমন অপরাধ করার সুড়সুড়ি জাগবেই। দূরভাগ্য হলো দেশে কিছু শ্রেণির মানুষ অনিয়ম করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিয়ম ভাঙতে তারা কোন কষ্ট পায় না। তাই প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু খবর পাচ্ছি আমরা। আর পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিয়ত ছাপছে সেসব খবর। তাতে কি এসে যায়; প্রতি দিনই একই খবর। পরামর্শে ঠাসা থাকছে পত্রিকার সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় কলামেও। কে কার কথা শোনে? কে ভাবে দেশের কথা? যারা সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন, তাদের ভাবনাটা সঠিক হতে হবে। রাস্তার মৃত্যু কষ্ট তাদের হূদয় ছুঁলে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তারা কিছু একটা করবেন নিশ্চয়। তারা এ নিয়ে একদিন ভাবন নেই ভাববেন। তবে সে সময়টা কতদূর? লাশের পাহাড় আরও বাড়লে হয়তো তারা কষ্ট পাবেন, ভাবনা তাদের পেয়ে বসবে। আর এ কষ্ট থেকেই এ ভাবনা থেকেই, তারা জনগণ আর চালকদের সড়কের আইন মানতে বাধ্য করবেন। প্রশ্ন হলো- প্রতিদিন এত লাশ পড়ে সড়কে, তাতো তাদের না দেখার কথা নয়? ফেসবুক আর ইন্টারনেটের কল্যাণে ঘটনা ঘটে যাবার পরই আমরা মোবাইলে সব পেয়ে যাচ্ছি; দেখছি সবই। নিত্য আহ উহ করছি। কিন্তু দুর্ঘটনা থামাতে মাথা খাটাচ্ছি না। এভাবে চলে না। এতো লাশ দেখতে দেখতে আমরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। ভাবনাটা পরে ভাবলে তো দেশের অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। প্লিজ, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আপনারা যে যেখানে দায়িত্বে আছেন তারা যার যার দায়িত্ব তা পালন করুন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ কিভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবুন। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে সড়ক দুর্ঘটনা হয় অনেক। এদের অধিকাংশ রাস্তা পাহাড় কেটে তীর ঘেঁষে করা। যখনই নেপালে গিয়েছি, তখনিই আল্লাহর নাম জপতে জপতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। বাসের জানালা দিয়ে নিচে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সরু পাহারের রাস্তায় গাড়ি চালায় সেখানকার ডাইভাররা। প্রকৃতিগত কারণেই সেখানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তবে ওদেরও নাকি আমরা ছাড়িয়ে গেছি। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরা এখন কোনো বিষয়ই না। গুলি করে একজন মানুষ মারা গেলে দেশে হৈ চৈ হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায় তার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ মরে সড়ক দুর্ঘটনায়। পথে ঘাটে মানুষ মরে গাড়ির চাপায়, কোথাও কোনো টুঁ শব্দটিও নেই। সবার মুখে যেন কুলুপ আঁটা। প্রতিবাদ নাই, তাই বোধ হয় প্রতিকারও নাই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটা ভাবনা মাথায় এসেছে। ভাবনাটা অনেক সস্তা কিনা জানি না। তবে তা প্রকাশ করছি। আমারা দেখি দেশের বিশেষ কোন দুর্যোগ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সফলতার সঙ্গে সে দায়িত্ব সেনাবাহিনী পালনও করে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনাকে দুর্যোগ ভেবে, এ দায়িত্বটা কি সেনাবাহিনীকে দেয়া যায় না? সরকারকে সড়ক দুর্ঘটনা রেধে সেনাদের দায়িত্বটা দেয়ার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করব। আমার বিশ্বাস আমাদের সেনাবাহিনীর যে দক্ষতা, তাতে মাত্র ৩ মাসেই তারা সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারবে। ৬ মাসের মধ্যে দেশের চালক আর জনগণকে সড়ক আইন মানতে বাধ্য করাতে পারবে। মিয়ানমারের কথা বলতে তো সবাই চটে যাবেন। গালমন্দ দেবার আগে আমার ফেসবুক ওয়াল আর সম্প্রতিকালে প্রকাশিত মিয়ানমার নিয়ে আমার লেখা কলামগুলো পড়লে বোধ করি আমার পক্ষেই থাকবে আপনারা। ওরা অসভ্য ওরা বর্বর। ওদের প্রতি ঘৃণায়, ক্ষোভে রক্ত প্রায়শই টগবগ করে। অসভ্য রাষ্ট্রের মানুষও কিন্তু সড়কের নিয়ম ঠিকই মানে। মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব খারাপ। ধর্মের বিষয়ে তো আরও বেশি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতনের ব্যাপারের সারা বিশ্বে তাদের বদনামের শেষ নেই। এই বর্বর মিয়ানমারের মানুষ কীভাবে সড়ক নিয়ম মানে তা স্বচোক্ষে গত বছর (২০১৬) লায়ন্স ক্লাবের একটি দলের সঙ্গে সফরে গিয়ে দেখেছি। মিয়ানমারের রাস্তায় ডিভাইডার নেই বললেই চলে। সাদা দাগ দিয়ে চলার পথ নির্দিষ্ট করা। অবাক ব্যাপার, পাঁচ দিনের যাত্রায় একটিবারও কাউকে নিজ দাগ অতিক্রম করতে দেখলাম না। সৌদি আরব, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশেই সড়কে গাড়ি চলাচলে নিয়মানুবর্তিতার ব্যবস্থা স্বচোক্ষে লক্ষ্য করেছি। ভাবী, আমরা কেন ওদের কাছ থেকে শিখছি না? আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা তো এসব দেশে যান। প্রশ্ন হলো, তারা কি এসব দেখেন না? শিখেন না কেন? মন্দ ভাগ্য আমাদের। তারা শেখেন না; আমাদের শেখানও না। শিখলে আর শেখালে আমাদের রাষ্ট্রের পরিবহন ব্যবস্থাও এমন হতো না কখনই। আইন করলেই হয় না। আইন প্রয়োগ করে শেখাতে হয়। আমাদের দেশের গাড়িচালক এবং আইন না মানা মানুষগুলের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সচেতন হলে জনগণ আর চালকরা সড়কে আইন মেনে চলবে। তাতে দুর্ঘটনা কমে আসবে। বিশেষ করে সড়ক সচেতন বহির্বিশ্বের দেশগুলোর কাছ থেকে কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যায়, সে শিক্ষা আমাদের গ্রহণ কারতে হবে। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মানার বিষয়টি আমরা অনুসরণ করতে পারি। আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে গ্রহণ করে আমরা উপকৃত হতে পারি। এ ব্যাপারে সরকার দৃষ্টি দিবে এবং সড়ক দুর্ঘটনাকে দুর্যোগ ভেবে তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। সরকারের কাছে এই প্রত্যাশা আমাদের। লেখক : কলাম লেখক। |