মানবিক মূল্যবোধের প্রত্যাশা
Published : Monday, 2 October, 2017 at 9:36 PM, Count : 3560

শিহাব খান : দেশের উত্তরাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ বন্যাকবলিত ছিল দীর্ঘ দিন। বন্যার খবর এখনও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন এলকায়। আমরা জানি, বন্যায় পানিবন্দি মানুষের থাকা-খাওয়ায় কি কষ্ট পোহাতে হয়। বিশেষ করে দিনমজুর ও হতদরিদ্র মানুষের কর্মহীন অবস্থা কাটে কত অমানিবকভাবে। বন্যা বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে অন্যের সাহায্য বা ত্রাণ সামগ্রীই থাকে দুর্গত মানুষের ভরসা। যদিও সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ থাকে, যা অপ্রতুল। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যার ত্রাণের যে সংস্কৃতি কিছুকাল আগেও ছিল, তা যেন বিলুপ্ত হতে চলেছে। দুর্গত মানুষের দুঃখকষ্টের প্রতি সামাজিক সংবেদনশীলতার এমন অভাব সত্যিই দুঃখজনক। দুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া যে আমাদের সবার কর্তব্য- তা কী আমরা ভুলে গেছি না মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে? 
এমন প্রশ্নের মাঝেও এই রাজধানী শহরে কিছু মহতী উদ্যোগের দৃষ্টান্ত কথা জানা গেছে পত্রিকান্তরে। এরমধ্যে একটি হল- ফার্মগেটে এলাকার ইন্দিরা রোডে বিনামূল্যে তৃষ্ণার্তদের ঠাণ্ডা পানি পানের ব্যবস্থার কথা। বাড়ির ফটকের ভেতরে একটি জারে রাখা হয় বরফ দেয়া খাওয়ার পানি। তার পাশে মগ ও গ্লাস। রিকশাচালকরা রিকশা থামিয়ে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে পানি চাইলে তারা পানি এগিয়ে দেন। ঠিক আতিথেয়তার মতোই আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে এ পানি পানে। পত্রিকার খবরে জানা গেছে- প্রায় ১০ বছর ধরে চলে আসছে এ কার্যক্রম। প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ লিটার ঠাণ্ডা পানি বিতরণ করা হয় তৃষ্ণার্তদের সেবায়। পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আশপাশের মেস-হোস্টেলের লোকজন, নিম্নবিত্ত লোকজন, ফেরিওয়ালা ও রিকশাভ্যান-চালকরা এই পানি পান করেন। লোকজন পানি পান করেন, পাশাপাশি বোতল ও জার ভরেও নিয়ে যান। শুধু এই-ই না, এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিলে এলাকাবাসী এ ভবন থেকে ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নিয়ে দৈনন্দিন কাজ চালান। এতে বুঝা যায়- এই সমাজের সব মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা একেবারে গ্রাস করেনি, বদান্যতা ও পর উপকারিতা এখনও কিছু মানুষের মধ্যে আছে।
যখন কোনো কিছুই বিনা খরচে পাওয়া যায় না, তখন বিনামূল্যে শীতল পানিতে মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের কাজটি চলে আসছে নিভৃতে, প্রচার পাওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই। আত্মপ্রচার প্রবণতার এই যুগে রোকেয়া সুলতানার এই নিভৃতি প্রবণতাও নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। বলা যায়- এই উদ্যোগের পেছনে আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এমন মানবিক বোধই সমাজের মূল শক্তি। যার অভাব আমাদের সমাজে ক্রমেই প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। আমাদের সমাজে এ ধরনের  সহানুভূতিশীল ও পরোপকারীর সংখ্যা যত বেশি হয় ততই মঙ্গল। লোভ, লালসা, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিপরীতে বদান্যতা ও পরার্থপরতার আজ বড় প্রয়োজন। রোকেয়া সুলতানা এমন এক বড় দৃষ্টান্ত। 
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর এলাকায় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার হতদরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হয়। রিকশাচালক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক, টোকাই ও দরিদ্র নারীসহ শত শত শ্রমজীবী মানুষ এই খাবর খান। একজন শ্রমিক দিনে কয় টাকা আর আয় করে, বাইরে খেতে গেলে তার অর্ধেকই খরচ হয়। তাছাড়া বাইরের খাবারটাও স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। এসব বিবেচনা করে তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, যারা বিত্তবান তাদের সবারই এমন উদ্যোগ নেয়া উচিত।
দুস্থ, দুর্গত মানুষের সেবা করা যে কত মহত্ কর্ম তা বলে শেষ করা যায় না। দুর্গত মানুষের সেবা করার মধ্যে রয়েছে অশেষ সওয়াব। ইসলামে নিঃস্ব, অসহায়, অভাবী, সর্বহারা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে তাদের বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে, তাদের অসহায়ত্ব লাঘব করবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে, তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কষ্ট দূর করতে সর্বাত্মক চেষ্টার জোর নির্দেশ রয়েছে। বিত্তবানের ও সামর্থ্যবানের ধন-সম্পদে দুর্গত, বিপন্ন ও অভাবী মানুষের অধিকার রয়েছে। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে দাতার অহঙ্কার করার কিছু নেই। কারণ দাতা দান করার মধ্য দিয়ে মানবতার দাবি পূরণ করেন। অন্য দিকে দান গ্রহীতা বিপন্নতা থেকে রেহাই পেয়ে মানবতার ছোঁয়ায় ধন্য হয়ে টিকে থাকার অবলম্বন পান। এটাই মনুষ্য সমাজেরই রীতি হওয়া উচিত। 
মানুষ মানুষের জন্য আর জীবন জীবনের জন্য, এ সহানুভূতির আজ বড়ই প্রয়োজন। কেননা কিছু অমানবিকতা ও দায়িত্বহীনতায় যেমন হতাশ হই আবার কোনো কোনো বদন্যতায় আশাবাদী হই। আসলে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, গঠনে নয় মানবিকতায়, মনুষ্যত্বে ও বিবেকে এর দৃষ্টান্ত রাখা উচিত। মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য শুধু একটু সহানুভূতি চায়। এখনকার একবিংশ শতাব্দীর রোবটিক মানুষ যেন সহানুভূতির ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। অগ্রসরমান বিশ্বে আজ যেন সদয় অনুভূতির বড়ই অভাব। ক্ষুধা, মন্দা, মহামারী, অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বিশ্ব আজ অনেকটাই নিরাপদ হলেও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা আজ বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, ক্ষমতাহীনের ওপর ক্ষমতাবানের অযাচিত বল প্রয়োগ আর অভাবকে পুঁজি করে অভাবীর ওপর সুযোগ নেয়ার প্রবৃত্তি মানুষকে আজ বেশি অনিরাপদ করেছে। অভাবী মানুষগুলোকে মূল ধারার বাইরে রেখে সবুজ শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব কি? প্রতিবেশির ঘরে আগুন দেখে তা না নিভানো কিংবা নিজ ঘরে হাজারটা তালা দিয়েও ওই আগুন থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। পৃৃথিবীর উত্তরের মানুষও মানুষ দক্ষিণের মানুষও মানুষ। হয়তো আমরা মানুষেরা ধর্মে, বর্ণে, ভাষায় ও লিঙ্গে বিভাজিত, আর এই বিভাজনকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষ আজ বিভেদ সৃষ্টি করেছে। যা সভ্য সমাজে কাম্য নয়। তাই মানুষকে আগে মানবিক হতে হবে। আদিম যুগে হিংস্র জীব জানোয়ার, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল মানুষের বড় শত্রু। মানুষ সেগুলো থেকে নিজেদের নিরাপদ করে আজও টিকে আছে। 
আদিম যুগে মানুষের শত্রু মানুষ ছিল না। মানুষ যখন যাযাবর জীবনের যবনিকা ঘটিয়ে এক জায়গায় বসবাস শুরু করে এবং মানুষ যখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা লাভ করেছে তখনই মানুষ মানুষের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এটা খুবই নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। মানুষ যত দিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছিল তত দিন মানুষ অনুভূতি সম্পন্ন ছিল। চাকা আবিষ্কার, শিল্পবিপ্লবে সামগ্রিকভাবে মানুষ যখন নগর জীবনে প্রবেশ করল মানবিক মানুষ তখন নাগরিক মানুষে পরিণত হলো। বিভেদ, বিদ্বেষ একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার নগ্ন প্রতিযোগিতা, জাতিগত ধারণা, রাষ্ট্র গঠন এসব বৈষয়িক বিষয় মানুষকে করে তুলল আরও যান্ত্রিক। আধুনিক যুগে প্রবেশের ফলে মানবিক বিপর্যয়েরও যেন শুরু হলো। অত্যাধুনিকতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মানবিকতা আজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের চরম উত্কর্ষতা মানুষকে আজ মানবতার বড় শত্রুতে পরিণত করেছে। মানবিকতার জায়গা থেকে সহানুভূতির প্রশ্নে মানুষ আজ অন্ধ। এই বিবেকান্ধতার কারণে যে ধর্মান্ধতার বিষবাষ্প সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রভাবে পুরো বিশ্ব আজ বিষময়। অথচ কোনো ধর্মই মানুষকে অমানবিকতার শিক্ষা দেয় না ও সহিংসতা তো নয়ই। সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের জন্য, ধ্বংসের জন্য নয়। 
তাই একটি সহানুভূতিশীল মানবিক মনুষ্য সমাজই পারে এই অশান্তি দূর করতে। নির্দয় অনুভূতি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। শান্তির জন্য চাই সদয় অনুভূতির মানবিক হূদয়। সাম্প্রতিককালে বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসহিষ্ণুতা দূর করতে সহানুভূতির বিকল্প নেই। একটু আধটু সহানুভূতির বিনিময়ে যদি শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠা হয় তবে তাতে কল্যাণ সবার। মানুষ মানুষকে মর্যাদা দিবে, রাষ্ট্র রাষ্ট্রের পাশে থাকবে, জাতিগত ভেদাভেদ দূর হবে সহানুভূতির শক্তিবলে। শুধু একজন মানুষ হিসেবেই যদি আমরা সহানুভূতি প্রদর্শনে যত্নবান হই তাহলে দৃশ্যমান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। চরম বিরুদ্ধবাদী নেতিবাচক চিন্তাধারা ত্যাগ করে সবার জন্য তথা প্রতিটি জীবনের জন্য একে অপরের মধ্যে একটু সহানুভূতি আদান প্রদানের ফলে গড়ে উঠবে একটি মানবিক মূল্যবোধের মনুষ্য সমাজ। এমন প্রত্যাশা সবার প্রতি।
লেখক : কলাম লেখক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft