বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
বিশ্বের মুক্তিকামী ও শোষিত মানুষের ‘আলোকবর্তিকা’
Published : Saturday, 11 November, 2017 at 9:53 PM, Count : 2055

মোতাহার হোসেন : বাঙালির শ্রেষ্ঠতম কবিতা, অভূতপূর্ব জাগরণের বিশুদ্ধ সঙ্গীত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, বাংলার বিপুল সম্পদের ক্ষতিসহ বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ভাষণটি এবার পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ‘বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রার স্মারক’ (মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার)-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি। পৃথিবীর নানা দেশের ৪২৭টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হলো ৭ মার্চের ভাষণ। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের আগমুহূর্তে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্যের মর্যাদা লাভ করল। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, একই সঙ্গে বাঙালিসহ সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী, শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের আলোকবর্তিকা হিসেবে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা, উত্সাহ, শক্তি ও সাহস যোগাবে। 
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো-কোটি জনতার সমাবেশ। মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন বাঙালির বিস্ময়পুরুষ বঙ্গবন্ধু। ‘তোমার নেতা আমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। তারপরই এক ঐতিহাসিক ভাষণ। মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ রচনা করল নতুন ইতিহাস। স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বাঙালির মন ও মননে সৃষ্টি করল অনুরণন। অমর কবিতা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারাবিশ্বে। 
৭ মার্চের ভাষণের এই স্বীকৃতি জাতির পিতার নেতৃত্ব গুণ, সম্মোহনী ক্ষমতা ও জীবন সংগ্রামকেই শুধু সামনে আনেনি, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির জেগে ওঠার ইতিহাসকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। আবেগাপ্লুত, স্মৃতিকাতর বাঙালি আজ নিজের অজান্তেই ফিরে যাচ্ছে একাত্তরের উত্তাল রেসকোর্স ময়দানে। এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতির আরেকটি গৌরবজনক অর্জন বলেই মনে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা প্রতিটি মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতিকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন না একদিন এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি আমাদের সেই বিশ্বাসকেই বাস্তব রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর প্রত্যাশিত ভাষণ। তিনি (বঙ্গবন্ধু) সারাজীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। 
এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে, দুনিয়া কাঁপানো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল অলিখিত। বুকে জমা কথাগুলোই বলেছিলেন শেখ মুজিব। এ ক্ষেত্রে তাকে নিজের ওপর ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রিয়তম স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রচিত স্মৃতিচারণমূলক আত্মজৈবনিক রচনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়। শেখ মুজিবকে বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত, তাই তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, ভরসা করে।’ বলা বাহুল্য, তা-ই করেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। নিজের বিবেচনায় যা বলা দরকার, বলেছিলেন। যেটুকু বলার, তার বাইরে তিনি যাননি। এ কারণেই হয়ত ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ হয়েছে ভাষণটি।
এ ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ নামে এক নিবন্ধে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন- ‘আমার অবয়বকে আমি যথার্থই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। দেহ আমার দীর্ঘ হচ্ছিল। শরীরে আমার রোমাঞ্চ জাগছিল। সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তাই পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে যখন যাওয়া-আসা করছিল এবং সে বিমান থেকে যে-কোনো মুহূর্তে যে মৃত্যুবান আমার বুকে এসে বিঁধতে পারে, সে কথা জেনেও আমার পা একটুও কাঁপছিল না।’ 
৭ মার্চের জনসমুদ্রে উত্তাল ঢেউ হয়ে এসেছিলেন শেখ মুজিব। সেখানে তিনি ছিলেন মহানায়ক। গাজী আজিজুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সেদিনের ১৯ মিনিটের বিকেলটা ছিল শুধু তার। সেদিন আর কোনো দৃশ্য ছিল না তার দৃশ্য ছাড়া। সেদিন আর কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না তার কণ্ঠস্বর ছাড়া। সেদিন একটিমাত্র নদী কলস্বরিত ছিল বাংলায়। সেদিন তিনিই ছিলেন বাংলার দিনমণি-অংশুমালি।
একই রকম আবেগ নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করেছেন ড. আবুল হাসান চৌধুরী। তার ‘স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ প্রবন্ধে এ সংক্রান্ত বর্ণনাটি এ রকম- ‘এক বিশাল জনগোষ্ঠীর হূদয়স্পর্শী ৭ মার্চের ভাষণটি ১৯৭১ সালের মুক্তিকামী বাঙালির আবেগ, উদ্দীপনা ও সংগ্রামী চেতনার দ্যোতনায় অসাধারণ কবিত্বময়- এর ভাব, ভাষা, উপমা ও উচ্চারণ গণমানুষের উন্মুখ অন্তরকে স্পর্শ করতে সক্ষম। লোকসাহিত্যের প্রকাশে যে অকপট সারল্য ও সৌন্দর্য থাকে, থাকে সমবেত শ্রোতা সাধারণের মন জয় করার কিংবা তাদের সম্মোহিত করার জাদুকরী ক্ষমতা, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটিরও সেই সরল সৌন্দর্য ও জাদুকরী ক্ষমতা ছিল এবং এখনও আছে।’ 
যোগাযোগ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাষণটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থের এক প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘সম্প্রচারতত্ত্বে  প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এ কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। এক হাজার একশত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোনো বাহুল্য নেই- আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দু-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লিন তাত্পর্যকে বেগবান করেছে।’ ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ‘ভাষা জাদু : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন- ‘একজন মানুষ এত সহজ ভাষায় মানুষের মনের ভেতরে, মাথার ভেতরে, রক্তের ভেতরে কিভাবে ঢুকে যেতে পারেন, তার প্রমাণ একাত্তরের ৭ মার্চ আমি পেয়েছিলাম।’ 
অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা ঘোষণার দিন বলেই মানেন। এ সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরের প্রবাসী সরকার বিভিন্ন বিবেচনায় ছাব্বিশে মার্চকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে।
তবে এতে ৭ মার্চের গুরুত্ব হারায়নি বরং গুরুত্বের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। বাঙালির স্বরূপে উদ্ভাসনের দিন হয়ে ইতিহাসে বেঁচে থাকবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।’
৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির বড় অর্জন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনবরত মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি, স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার যে ঘৃণ্য ও নোংরা রাজনীতি চলছে তা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে এ ভাষণ শুনে নতুন প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায়। পিআইডি  প্রবন্ধ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft