একাত্তরে সম্মুখ সমরে জয়দেবপুর পথ দেখালো দেশকে
Published : Sunday, 10 December, 2017 at 9:22 PM, Count : 4234

মোতাহার হোসেন : উনিশ’ একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত, যখন বাঙালিকে নিধন ও নিশ্চিহ্ন করার সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে পাক বর্বর বাহিনী। একইসঙ্গে চলছিল সম্ভাব্য প্রতিরোধ এড়াতে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের নিরস্ত্র করার কৌশল। ঠিক এমনি সময় মুক্তিকামী বাঙালিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনন্য এক অনুপ্রেরণা ও পথ প্রর্দশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো ঢাকার নিকটবর্তী জেলা গাজীপুরের জয়দেবপুরের মানুষ। তখনও বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেননি, তাই পাকিস্তানি কমান্ডারদের নির্দেশ সরাসরি অমান্য করা সম্ভব ছিল না। আবার অস্ত্র জমা দিলে ভবিষ্যতে যে কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে, তা তারা ঠিকই আঁচ করতে পারছিলেন। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পাকিস্তানি প্রচেষ্টা তারা ভণ্ডুল করে দেয়। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরের সেই ঘটনা ছিল যুদ্ধ শুরুর আগে সাধারণ মানুষের প্রথম প্রতিরোধ। 
মূলত মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জনযুদ্ধের প্রতৃক সুতিকাগার বলা যায় জয়দেবপুরকে। এখান থেতেই শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, তখন মুক্তিকামী মানুষের স্লোগান ছিল, জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয়েছে জয়দেবপুর, চৌরাস্তা, চান্দরা, মাওনা শিববাড়ির মোড় প্রভৃতি এলাকা। তত্কালীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক কেএম সফিউল্লাহ সে সময় ছিলেন জয়দেবপুর ব্যারাকে। টানটান উত্তেজনার প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে এখনও জীবন্ত কত পরিকল্পনা আর সতর্ক পদক্ষেপে সেদিন কৌশলগত বিজয় এসেছিল- তার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে ইতিপূর্বে তার বক্তব্য বিবৃতিতে।
দেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছরে পেছন ফিরে এসব গৌরবময় ঘটনা নতুন প্রজন্মকে অবহিত করার কিঞ্চিত চেষ্টা এই নিবন্ধে। বাংলার ইতিহাসে আগ্নিঝরা মার্চের সেই সব দিনে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা যুদ্ধজয়ের অন্যতম প্রাণশক্তি। তাই স্বাভাবিকভাবেই গাজীপুরের শিমুলতলীতে অবস্থিত সমরাস্ত্র কারখানায় কর্মরত বাঙালি সৈনিক, অফিস, কর্মকর্তা কর্মচারীরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে। পূর্ব-বাংলায় তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের মঞ্চ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হলে পূর্ব-পাকিস্তানের আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেতে থাকে।
এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সফিউল্লাহর দায়িত্ব ছিল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর এলাকায়। এই সেনা অফিসারের দৃষ্টিতে সত্তরের নির্বাচনে মানুষ কত আগ্রহ করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছে। কিন্তু বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে পাকিস্তানিরা, ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনও স্থগিত করা হয়। সে সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটালিয়নের পাঁচটি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। তারা যাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানিরা সেনা সদস্যদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরির চেষ্টা করে। বাঙালি সেনাদের অল্প কয়েকজনকে জয়দেবপুরে রেখে বাকিদের পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে। তাতেও ভরসা করতে না পেরে এক পর্যায়ে ভাওয়াল রাজবাড়িতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার। মার্চের শুরুতে যখন পার্লামেন্ট স্থগিত করা হলো, তখন তিনি টাঙ্গাইলে। তার অধীনস্ত সৈন্যরা সে সময় ‘কিছু করার’ জন্য মুখিয়ে ছিল।
কিন্তু বাঙালি সেনারা কিছু করতে গেলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা; যার সাজা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলা বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। তাই কথা বলার সময় ছিল অনেক রাখঢাক, তবে ভবিষ্যত্ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ঠিকই চলছিল। এমন সময় আসে অস্ত্র জমা নেয়ার নির্দেশ। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে কালক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেন। পাকিস্তানিরাও বিষয়টি বুঝে ফেলে। পরিদর্শনের কথা বলে এক কোম্পানি সেনা নিয়ে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাজির হন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করা।
খবর পৌঁছে গিয়েছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের কাছেও। যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে শুরু হয় ?যুদ্ধ প্রস্তুতি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতর ভাওয়াল রাজবাড়ির চারদিকে বসানো হয় মেশিনগানসহ বিভিন্ন ভারী অস্ত্র। জয়দেবপুরে সেদিন ছিল হাটবার। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কেউ কেউ নজর রাখছিলেন ব্যারাকের দিকে। বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টার খবর পৌঁছেছিল তাদের কাছেও। ভাওয়াল রাজবাড়ির ফটকে পৌঁছে জাহানজেব যে প্রস্তুতি দেখলেন, তার কাছে তা ছিল অভাবনীয়। হাটের ভিড়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা আছেন শত্রুদের ঘেরাওয়ের মধ্যে, যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন; সেজন্যই আত্মরক্ষার প্রস্তুতি। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে এক যুদ্ধজয়ী বলেন, এমন সময় খবর এলো, জয়দেবপুরে প্রাসাদের দিকে ঢুকতে যে রেলগেট, ওখানে মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে দিয়ে হাটের লোকজন ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে আমরা বাংলায় বলেছি, গুলি করো কিন্তু মাথার ওপর দিয়ে করো। আজ ইতিহাসের সেই সাক্ষী জয়দেবপুরে প্রথম প্রতিরোধের স্মৃতিস্তম্ভ জাগ্রত চৌরঙ্গী। সাধারণ মানুষের সেই আত্মত্যাগের সেই ঘটনা স্মরণীয়। জয়দেবপুরের মানুষ আগেই জেনেছিল যে সমরাস্ত্র কারখানার বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হবে। কিন্তু সে দিন সম্মিলিত জনতার প্রতিরোধের পর বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানিরা। জয়দেবপুর থেকে ফিরে যেতে হয় সমরাস্ত্র কারখানার দায়িত্বরত পাক সেনা কর্মকর্তারা।
সাধারণ জনগণ সেদিন পাকিস্তানিদের দেখে ক্ষেপে গিয়েছিল এটি বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুল্লাহ, তখনকার শ্রমিক নেতা বিএনপির নজরুল ইসলাম খান প্রতিরোধের পাশাপাশি বাঙালি সেনা সদস্যদের সমর্থন দিয়েছিলেন। আর সাধারণ মানুষ তো ছিলই। কারণ ওই এলাকার মানুষ বুঝে গিয়েছিল- বাঙালি সেনা সদস্যরা তাদের সঙ্গে আছে। এ কারণে সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমরা সশস্ত্র ছিলাম, আর তারা ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু তারা বাঙালি সেনা সদস্যদের সমর্থন করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু তাদের সাহস আর সমর্থনেই আমরা বিদ্রোহ করতে সমর্থ হই।
মূলত স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের ৪৬ বছর পরেও ইতিহাসে আজও জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ পরে সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ঢাকাসহ সারাদেশে স্লোগান উঠেছিল- ‘জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। কাজেই বিজয় দিবসকে স্মরণে রাখতে হলে জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft