শিরোনাম: |
মুসলিম বিশ্বের স্বপ্ন ও বাস্তবতা
|
জি. কে. সাদিক : আমেরিকার ক্ষেপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দেয়ার পর থেকে মুসলিম দেশগুলোতে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রাধান এর নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে অন্য ১৪ সদস্য-রাষ্ট্র বেশ জোরের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে। ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এর নিন্দা জানিয়েছে। লেবাননে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোও মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছে। প্রায় সবকয়টা মুসলিম দেশের মুসলিমরাই এই সিদ্ধান্তের বিরোধে প্রতিবাদ করছে, করবে। এই নিবন্ধ প্রকাশ হতে হতে আরও অনেক প্রতিবাদ ও আন্দোলন হবে। অতীতেও নানা কারণে অনেক প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়েছে নিন্দার ঝড় উঠেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মুক্তি হয়নি। লাগাম পড়েনি আগ্রাসী ইসরাইলের মুখে। আসলো চুক্তির ২৩ বছর পার হচ্ছে কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। ইসরাইল তার অধিকৃত গাজার পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমে ৮ লাখ অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে, নতুন করে আবার ১৪ হাজার বসতি স্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প প্রশাসন কানে তুলো দিয়ে তাদের অবৈধ কর্মযজ্ঞ চলিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সমালোচনার ঝড়ে পড়েও মার্কিন দূত নিকিহ্যালি বিন্দুমাত্র টলেনি। উল্টো নিজদেশের ঘৃণ্য কর্মের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। মাত্র তিন মাসে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বিনা অপরাধে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। সমুদ্রে-নদীতে সলিল সমাধি অনেক হতভাগ্য রোহিঙ্গা শিশুসহ বহু নর-নারীর। ১৯৮০ সাল থেকে সন্ত্রাস দমনের নামে নানা কায়দায় রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ, আন্দোলন ও নিন্দার ঝড় উঠেছে কিন্তু রোহিঙ্গা নিধন থামেনি। আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েও মিয়ানমার টলেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মুসলিম দেশগুলো ও অন্যান্য দেশসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এবং ওআইসি- সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোন স্থায়ী সমাধান হবে বলেও আলামত দেখা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিন সমস্যার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪ বার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও নানা সময়ই সরাইলের সেনাবাহিনীর বুলেট-বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মাতৃভূমির মুক্তির দাবিতে হাজার-হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। বোমার আঘাতে ঘর-বাড়ি হারিয়ে উদ্ধবাস্তু হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছে ফিলিস্তিনিরা। বিশ্বব্যাপী মুসলিম-অমুসলিম সব দেশেই প্রতিবাদ-আন্দোলন ও নিন্দার ঝড় উঠেছে কিন্তু থামেনি ফিলিস্তিনি হত্যা, মুক্ত হয়নি আরবদের মাতৃভূমি। থামেনি ইহুদিবাদী ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ। কথিত রকেট হামলার অপবাদে বারবার আরব ভূ-খণ্ড রক্তে ভিজিছে। বোমার আঘাতে বাড়ি-ঘর উড়িয়ে দিয়ে গৃহহীনদের মিছিল দীর্ঘ করার ঘৃণ্য প্রায়াসে কোনো ভাটা পড়েনি। অতীতে যেমন কোনো আন্দোলনই ইসরাইলের লাগাম টানতে পারেনি। তেমনি জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার পর মুসলিমদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতেও কোনো কাজ দিবে না। প্রতিবাদের গরম খবরাদি মিডিয়াতে কিছুদিন থাকবে আবার নতুন কোনো ইস্যু এলে এটা হারিয়ে যাবে। আর মুসলিম ভূমি দখলমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। কারণ ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র ও ক্ষমতা দু’দিক থেকেই অনেক এগিয়ে আছে। শক্তি প্রয়োগ করে ইসরাইলকে থামানোর মতো সক্ষমতা নেই মুসলিম দেশগুলোর, আর সেটা সম্ভবও নয়। ৪ বার আরবই-সরাইল যুদ্ধের ইতিহাস তাই বলে। বিশ্ব জুড়ে যে নিন্দা ও প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছে সেটা কানে তোলার কোনো ফুসরত ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের নেই। এখানে মানবাধিকার বলে কোনো কথা নেই। স্বার্থসিদ্ধিই মূল কথা। এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুকৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোকেই। ফিলিস্তিন নিয়ে ভাবার সময় নেই সৌদিআরবের। নিজের স্বার্থই তাদের শাসক গোষ্ঠীর বড় লক্ষ্য। অন্যদিকে ইয়েমেন-লিবিয়া নামমাত্র মানচিত্রসর্বস্ব রাষ্ট্র। জেসমিন বিপ্লবের নামে সুকৌশলে এই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কোমর ভেঙে দিয়েছে কথিত গনতন্ত্রবাদীরা। অদূর ভবিষ্যতেও এই রাষ্ট্রগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ নেই। মিসরে চলছে পশ্চিমা ও আমেরিকার মদদপুষ্ট সেনাশাসন। আফগানিস্তান যুদ্ধবাজদের খেলার মাঠ। যার জন্য চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ তালেবান আছেই। ইরাক ও সিরিয়াতে সরকার আছে, কিন্তু নেই রাষ্ট্রিক কোনো ঐক্য ও সার্বভৌম ক্ষমতা। মন চাইলেই যখন-তখন সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরাইল। হামলার বৈধতার জন্য সন্ত্রাস দমনের ব্যানার লাগায়। কোনো প্রতিবাদ বা ব্যবস্থা নেয়ার মতো শক্তি সিরিয়ার নেই। ঘর সামলাতেই জীবন সাঙ্গ প্রায়। আধিপত্য বিস্তারের জন্য শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের নামে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত ইরান-সৌদি। কে কাকে ধ্বংস করবে সেই হিসাব মিলাতেই সময় পাচ্ছে না। ফিলিস্তিন নিয়ে ভাবার সময় কই তাদের? সন্ত্রাসবাদের মদদে কাতারের জীবনে ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি করে দিয়েছে সৌদি ও তার মিত্র চার মুসলিম দেশ। রাজতন্ত্রের আসন সুসংহত রাখতে সৌদি ও তার মিত্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলো ব্যস্ত। কে আসবে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে? যারা ওয়াশিংটনের ফটকাবাজি শান্তি প্রতিষ্ঠার আশ্বাসের প্রতি এখনও বিশ্বাস নিয়ে দিনাতিপাত করছে তারা শেষ রাতের নিদ্রায় আছে, খানিকবাদেই যার রঙিন স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। আরব লিগ জাতিসংঘে জেরুজালেমকে রাজধানী স্বীকৃতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাব তুলবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কথা হলো জাতিসংঘ কি পারবে মার্কিন সিদ্ধান্তের বাহিরে এসে কোনো ফয়সালা দিতে? একটি বড় প্রশ্ন ওঠে, শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম নিয়ে সৃষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটির অতীত ও বর্তমান সফলতা নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জাতিসংঘের জন্ম হয়। কিন্তু কথা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ু যুদ্ধকালীন বিশ্বের দুটি বৃহত্ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের (সাবেক সোভিয়েত ও আমেরিকা) মধ্যে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছিল জাতিসংঘ কি পেরেছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে? ইরাক যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সফলতা আছে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের? তেমনিভাবে সম্প্রতি পিয়ংইয়ং-ওয়াশিংটন উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারেনি। পারেনি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধের দামামা থেকে ফিরিয়ে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা করতে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তেমনি পারেনি ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেননিয়ে কোনো কর্যকর ভূমিকা পালন করতে। ভেটো দানের অধিকারী আমেরিকা ও মিত্র ইসরাইল বরাবরই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। তাহলে আরব লিগ জাতিসংঘে ট্রাম্প সিদ্ধান্তের বিপক্ষে প্রস্তাব তুলে কোন সুখবর বয়ে আনতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্য দিকে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভূ-সীমার দূরত্ব না থাকলেও আছে মতাদর্শগত, রাজনীতিগত ও মাযহাবগত বিশাল দূরত্ব বিদ্যমান। যেটা গুছিয়ে ঐক্যের সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। সরাসরি না পারলেও সৌদি আকার ইঙ্গিতে মিত্র ওয়াশিংটন ও ইসরাইলের পক্ষেই আছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও সৌদিতে কোনো সাড়া পড়েনি। ট্রাম্পের জেরুজালেম সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশি খবর প্রচার না করার জন্য দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে। যদি রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মুসলিম দেশগুলো কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পারেনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো সমাধান দিতে। তাহলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কতটা পারবে? মুসলিম দেশের সাধারণ মানুষ আন্দোলন করছে তাদের ঐক্য সম্ভব না। কারণ তাদের মধ্যে আছে কাঁটাতারে অনতিক্রম্য সীমানা। যদিও তারা বিশ্বাসের দিক থেকে এক কিন্তু শক্তিতে নয়, ক্ষমাতেও নয়, সংখ্যাতে মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নামের সোনার হরিণ এবং দখলমুক্ত মুসলিম ভূমি তথা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন সেদিন পূরণ হবে যেদিন মুসলিম দেশগুলো তাদের সীমানার দূরত্ব ঠিক রেখে সব মতভেদ ভুলে এক সারিতে আসতে পারবে। আসলে সেটা কি সম্ভব হবে? উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আমি সেটা মনে করতে পারি না; বর্তমানে তো নয় অদূর ভবিষ্যতেও কালো মেঘের আভাস ছাড়া আর কিছুই দেখি না। লেখক: কলাম লেখক |