শিরোনাম: |
জেরুজালেমের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং ট্রাম্পের আকস্মিক সিদ্ধান্ত
|
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের এহন উদ্যোগ চিতায় ঘি ঢালার মতো একটি ঘটনার অবতারণা করলো। জেরুজালেম বা যেরুশালায়িম আরবি আল-কুদস মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহাসিক শহর। এই শহরটি ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানদের কাছে পবিত্র শহর হিসেবে পরিচিত। আর্ন্তজাতিকভাবে এই শহরকে ইসরাইল বা ফিলিস্তানের কোনো পক্ষের শহর হিসেবে স্বিকৃতি দেয়া হয় না। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শহরকে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখা হয়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পশ্চিমাঞ্চল ইসরাইল এবং পূর্বাঞ্চল জর্দানের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে যায়। পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, জেরুজালেমে বসতি গড়ে উঠে খ্রিস্টজন্মের ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জেরুজালেম পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। এখানে ইহুদি ধর্ম পালনকারীদের পবিত্র স্থান টেম্পল মাউন্ট ও ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের পবিত্র মসজিদ আল আকসা অবস্থিত। জেরুজালেমের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, এই নগরীটি কমপক্ষে দুইবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, ২৩ বার অবরোধ হয়েছে ৫২ বার আক্রমন হয়েছে ৪৪ বার দখল পুনর্দখল হয়েছে। বিশ্বের এই প্রাচীন নগরীটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম কী করে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিলেন তা বিশ্বের সচেতন মানুষকে অবাক করে দেয়। কারণ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস কত দিনের। মূলত ইসরাইল একটি দখলদারিত্ব রাষ্ট্র। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কের উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটে আরব অঞ্চলে। প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের অধীনে চলে যায়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদিবাদীদের কাছে লেখা পত্রে ফিলিস্তিনি ভুখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোরের ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসনে থাকার সময় সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিদের আনা হয় প্যালেস্টাইনে। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৮৮২-১৯০৩ সাল পর্যন্ত ত্রিশ হাজার, ১৯০৪-১৯১৪ সাল পর্যন্ত চল্লিশ হাজার, ১৯১৯-১৯২৩ সাল পর্যন্ত পয়ত্রিশ হাজার, ১৯২৪-১৯৩১ সাল পর্যন্ত বিরাশি হাজার ১৯৩৮-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিন লাখ ইহুদি সংগ্রহ করে আনা হয় প্যালেস্টাইনে। তাছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থ্থান থেকে ইহুদিদের পুশ ইন করানো হয় ফিলিস্তিনে। আর ব্রিটিশরা এই ইহুদিদের আবাসস্থল গড়ে দেয় ফিলিস্তানের মাটিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরে নিয়ে আসা ইহুদিদের বসতি গড়ে তোলার আর্থিক সহযোগিতা করে তত্কালীন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি সরকার। আর অশান্ত হয়ে উঠে শান্তির প্যালেস্টাইন। বহিরাগতদের অনৈতিক প্রবেশের ফলে দাঙ্গা হাঙ্গামার দেশে পরিণত হয় ফিলিস্তিন। রক্তাক্ত জনপথ হয়ে ওঠে পশ্চিম তীর আর এই রক্তাক্ত জনপথকে আরও রক্তাক্ত করার জন্য নেপথ্যে কাজ করে পশ্চিমা শক্তি। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনে ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে ব্রিটিশরা নেপথ্যে ইন্ধন জোগায় ইহুদিদের। ব্রিটিশ ইন্ধনে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তেলআবিবে ইহুদি নেতারা সংগঠিত হয়ে প্যালেস্টাইনকে ইসরাইল নামে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। ইহুদি নেতারা ইসরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রু ম্যান মার্কিনিদের পক্ষ থেকে ইসরাইল নামে নবসৃষ্ট দেশকে স্বীকৃতি দেয়, এতে প্রমাণ হয় যে মার্কিন ও ব্রিটিশদের পরোক্ষ ইন্ধনে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করে নাম দেয় ইসরাইল। সেই সময় ইসরাইলের এই ঘোষণায় বিরোধিতা করে আরব অঞ্চলের দেশসমূহ। আরব অঞ্চলের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন। ১৯৪৮ সালের এই যুদ্ধে ইসরাইল মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় আরব অঞ্চলের অনেক এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আর ইসরাইল ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা নিজভূমে উদ্বাস্ত হয়ে যায়। ফিলিস্তিনিরা নিজ আবাসস্থল হারিয়ে আরব অঞ্চলের অনেক দেশে আশ্রয় নেয়। আর এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেতে উঠলেন এক ভিন্ন খেলায়। তিনি জাতিসংঘের বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে নিজেই ঘোষণা দিয়ে দিলেন জেরুজালেম হবে ইসরাইলের রাজধানী। এটা আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত একটি ঘোষণা। ট্রাম্প সারাবিশ্বের মালিক হয়ে যাননি যে তিনি যে কোনো শহরকে যে কোনো দেশের রাজধানী বানিয়ে ফেলবেন। এক দেশের সরকার প্রধান অন্যদেশের অভ্যান্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করাটা একটি অশোভন। ট্রাম্প বিশ্ব রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে যে ঘোষণা দিল জাতিসংঘ তার বিরোধিতা করলো না। এটা কেমন জাতিসংঘ? তাহলে কি জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত হয় আমেরিকা কর্তৃক? যদি তাই হয়, তাহলে এই জাতিসংঘ দিয়ে আদৌ কি কোনো মানবকল্যাণ হবে? আর জেরুজালেমের জনবসতি হিসেবে ট্রাম্পের এই ঘোষণাটিও অন্যায্য তাই এই অমানবিক অন্যায্যতার প্রতিবাদ করা উচিত সব মানবতাবাদীদের। ট্রাম্প যে অনায্য কথা বলেছে তার প্রমাণ মেলে জেরুজালেমের জনবসতির হিসাব থেকে। জেরুজালেম এটি পুরনো নগরী। প্রথাগতভাবে জেরুজালেম চারটি অসমান অংশে বিভক্ত ছিল। সেই ধারাটি এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে জেরুজালেম চারটি মহল্লায় বিভক্ত, তা হলো: মুসলিম মহল্লা, খ্রিস্টান মহল্লা, ইহুদি মহল্লা, আমেনিয়ও মহল্লা। মুসলিম মহল্লা: আরবি ভাষায় হারাত আল মুসলিমিন, হিব্রু ভাষায় হা-রুভাহ হা-মুসরেমি, এটা দেয়ালঘেরা প্রাচীর। জেরুজালেমের চারটি মহল্লার মধ্যে অন্যতম। এর আয়তন প্রায় ৩১ হেক্টর বা ৭৬ একর এই মহল্লা পুরনো শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই মহল্লাটি চারটি মহল্লার মধ্যে সর্ববৃহত্ এবং সবচেয়ে বেশি জনবহুল। এই মহল্লাটি শহরের সিংহ ফটক থেকে নিয়ে দক্ষিণের হারাম আল শরীফের উত্তর দেয়াল এবং পশ্চিমে দামেস্ক ফটকের পশ্চিম দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহুদি মহল্লা: এই মহল্লাাকে হিব্রু ভাষায় বলা হয় হারুভা হাইয়েহুদি আর আরবি ভাষায় বলা হয় হারাত আল ইয়াহুদ। জেরুজালেমের পুরনো চারটি মহল্লার মধ্যে এটি অন্যতম। এর আয়তন প্রায় ১,১৬,০০০ বর্গমিটার। এটি পুরনো শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। দক্ষিণে জায়েন ফটক থেকে শুরু করে পশ্চিমে আর্মেনীয় মহল্লা, পূর্বে হারাম আল শরীফ ও পশ্চিম দেয়াল এবং উত্তরে মুসলিম মহল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। বিংশ শতাব্দীর শুরু অর্থ্যাত্ ১৯০০ থেকে ১৯০৫ সালে এখানকার জনসংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯০০ জন। আর্মেনীয় মহল্লা: আরবি ভাষায় একে বলা হয় হারাত আল আরমান, আর হিব্রু ভাষায় বলা হয়রোভা হা-আরমেনীয় জেরুজালেম শহরের এই মহল্লাটিও প্রধান মহল্লা। এটি শহরের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে অবস্থিত। বা-আল নবী দাউদ ও বাব আল খলিল নামক ফটক দিয়ে এখানে প্রবেশ প্রবেশ করা যায়। এই মহল্লাটির আয়তন ০.১২৬ বর্গকিমি. যা পুরনো শহরের ১৪ শতাংশ। খ্রিস্টান মহল্লা: শহরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত। খ্রিস্টানদের অতি পুণ্যভূমি। যদিও আর্মেনিয়ানরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তারা এই মহল্লার অন্তর্ভুক্ত না কারণ আর্মেনিয়ানরা আরব বংশদ্ভূত নয়। আর খ্রিস্টান মহল্লার অধিবাসীরা আরব বংশদ্ভূত। মোট ১২৫ বর্গকিমি. আয়তনের শহরটি চারটি অঞ্চল চারটি ধর্মীয় পালনকারী গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত। তাই এই শহরটি কর্তৃত্ব কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। প্রথাগতভাবে চারটি মহল্লার সাংস্কৃতিকগত দিকটাতেও অসামঞ্জস্যতাও রয়েছে। সেই হিসেবে জেরুজালেম মূলত চারটি ধর্ম পালনকারীদের তীর্থভূমি। তাই বিশেষ কোনো ধর্ম পালনকারীদের কর্তৃত্বে এই শহরের মালিকানা ন্যাস্ত করলে তাতে সংঘাত বেড়ে যাবে। ট্রাম্পের ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়েও নানা মহলের প্রশ্ন উঠেছে। আরব বিশ্বের জটিল পরিস্থিতিতে সৌদি আরব রাষ্ট্রটি সবসময় মার্কিনিদের লেজুড়বৃত্তি করে আসছে আর এই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায়, ট্রাম্প একাই ইসরাইলের পক্ষে সমর্থন করেনি এই সমর্থনে ট্রাম্পের দেশের ইভানজেলিক খ্রিস্টান থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারেরও সমর্থন রয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বিশেষ অনেক গোষ্ঠী ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় আরব শাসকদেরও ট্রাম্প ব্যাপক সর্মথন পেয়েছেন বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের সহযোগিতায় উপসাগরীয় অঞ্চলে বেশকিছু দেশে স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছে। আর এই স্বৈররাজতান্ত্রিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ট্রাম্পকে নীরব সমর্থন দিচ্ছেন। যেমন, সংস্কারের নামে সৌদি বাদশাহ বিন সালমানকে চাচাতো ভাইদের সম্পদ কেড়ে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ। তাই বর্তমান সৌদি রাজপরিবার ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী কার্যকলাপে নীরব সমর্থকের ভূমিকা পালন করছে। সৌদি আরবের বাদশাহ বিন সালমানের কথায় ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সৌদি আরবের লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সৌদি কথা সাহিত্যিক তুর্কি আল হামাদ বলেছেন, ফিলিস্তিন এখন আর আরবদের কোনো ইস্যু হতে পারে না। ফিলিস্তিনিরা ফিলিস্তিনকে বিক্রি করে দিয়েছে তাই ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্থাপিত হলে ইসরাইলই হবে আরব পর্যটকদের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সারাবিশ্বের মুসলমান ধর্মপালনকারীদের অন্যতম তীর্থভূমি হলো সৌদি আরব, আর সে দেশটির ভূমিকা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যদি এ রকম হয়, তাহলে ট্রাম্প তো সেখানে সহজেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক সব মহলের উচিত, জেরুজালেম নগরীকে আন্তর্জাতিকভাবে নিরপেক্ষ শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। লেখক: কলাম লেখক। |