লেখকদের অবস্থান হবে শান্তি, গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার পক্ষে
Published : Thursday, 4 January, 2018 at 8:37 PM, Count : 11366

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বাক-স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা। নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৯৮০-এর দশকে ‘গাছপাথর’ নামে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সামাজিক ও রাজনীতি বিষয়ে ধারাবাহিক কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত একুশে পদকে ভূষিত হন। প্রবন্ধ গবেষণা, উপন্যাস, ছোটগল্প অনুবাদ, সম্পাদনা মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৭০। সম্প্রতি উন্মুক্ত আলোচনায় তার এ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠেছে।
 বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখলাম। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আর থাকছে না। আজ ছেচল্লিশ বছর পরে এসে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে ঠিক অসাম্প্র্রদায়িক রাষ্ট্র বলা যায়? তিনি বলেন না, তা নিশ্চয় বলা যাবে না। আপনি যেটা বললেন, এটা ঠিক অসাম্প্রদায়িক না। আমরা আসলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। অর্থাত্ রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের ঠিক সম্পর্ক থাকবে না রাজনৈতিকভাবে, আর দার্শনিকভাবে ইহজাগতিকতা থাকবে, যেটা জগতটাকে বড় করে তুলবে। আর ওই জায়গা থেকেই আমরা সংগ্রাম করলাম, কিন্তু স্বাধীনতার পরেই ক্ষমতা চলে গেল জাতীয়তাবাদীদের হাতে। এখন এই জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ আমলে সংগ্রাম করেছে, পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এরাই নেতৃত্বে আছে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল জায়গাটাই ছিল, এরা পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিল। ওই ব্রিটিশ আমলে ছিল পুুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদী, পাকিস্তান আমলে পুুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদী এবং বাংলাদেশ হওয়ার পরেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা গেল, তারাও পুঁজিবাদে বিশ্বাসী এবং পুুঁজিবাদ যা করে সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সর্বত্র। সমাজের অনেক উন্নতি হলো, দৃশ্যগত উন্নতি হলো, অবকাঠামোগত উন্নতি হলো; কিন্তু এই উন্নতি হচ্ছে পুরনো ধারার উন্নতি। অর্থাত্ পুঁজিবাদী উন্নতি। যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, ব্যক্তি মালিকানাটা থাকবে এবং সেই মালিকানা বৈষম্য সৃষ্টি করবে। এখন আপনি দেখবেন যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। ব্যক্তি মালিকানায় চলে যাবার ফলে জায়গা দখল, নদী দখল, বন দখল চলল এবং এতে যে উন্নতি হলো, তাতে আমরা দেখছি যে বৈষম্য বাড়ল এবং এখনও বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে, যতই উন্নতি হোক বৈষম্য বাড়বে। বৈষম্য বাড়ার ফলে যে শ্রেণির হাতে ক্ষমতা আছে তারা কিন্তু দেশপ্রেমিক নয়। 
ক্ষমতায় থেকে তারা অনেক বিত্ত করেছে, অনেক উপার্জন করেছে কিন্তু এই টাকাগুলো তারা এদেশে বিনিয়োগ করছে না বা করার ক্ষেত্র পাচ্ছে না, বা করাটা উপযোগী মনে করছে না এবং এই অভাবজনিত কারণে সঞ্চয় উদ্বৃত্ত হচ্ছে কিন্তু সেই উদ্বৃত্তটা চলে যাচ্ছে বাইরে। এই উদ্বৃত্ত এখানে বিনিয়োগ না হওয়াতে বেকারত্ব ভয়াবহ আকারে বাড়ছে এবং আজকে বাংলাদেশে যে হানাহানি, খুনোখুনি বা বিশৃঙ্খলা দেখি, সেটার কারণ হলো ওই অর্থটা এখানে বিনিয়োগ হয়নি। বিনিয়োগ না হওয়ার ফলে উত্পাদন বাড়েনি। আর উত্পাদন যেটুকু বেড়েছে, সেটুকু বিতরণের ব্যাপারে বৈষম্য চলে এসেছে। অল্প লোকের হাতে সম্পদ চলে গেছে। 
আজ বিশ্বব্যাপী এ ঘটনা ঘটছে। তবে বাংলাদেশে এটা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে এবং তারা প্রাণ দিয়েছে এবং একটা জিনিস দেখবেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সত্তর ভাগই গ্রামের কৃষক। যুদ্ধ পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হলো না। কৃষকরা ক্ষেতমজুরে পরিণত হলো, ক্ষেতমজুর গ্রাম থেকে উত্পাটিত হয়ে শহরে এসে বস্তিতে ঠাঁই পেল এবং তাদের জীবনযাত্রার খুব অল্পই পরিবর্তন হলো, আর কিছু হলো না। আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি যেটুকু টিকে আছে এবং যেটুকু বাড়ছে, সেটা হচ্ছে শ্রমিকদের কারণে। যে শ্রমিক কৃষিতে কাজ করে, যে শ্রমিক কারখানাতে, বিশেষ করে গার্মেন্টে কাজ করছে, যে শ্রমিক বাইরে গিয়ে সেখান থেকে টাকা পাঠায় সেই তাদের অর্থেই কিছুটা উন্নতি হচ্ছে এবং এই অর্থটা কিন্তু এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে না, বাইরে চলে যাচ্ছে। এই বাইরে চলে যাওয়ার ট্র্যাজেডিটা কিন্তু আমাদের অঞ্চলের বড় ট্র্যাজেডি।
আমরা জানি যে, মোঘল-পাঠানরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। মোঘলরা সম্পদ পাচার করত এবং ইংরেজরা, তাদের তো লক্ষ্যই ছিল এখান থেকে যত যা কিছু নিয়ে যাওয়া যায়। জাহাজ ভরে ভরে টাকা নিয়ে যেত। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ ছিল যে, তারা আমাদের সম্পদ পাচার করছে। আজকে বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে, ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাচ্ছে, হুন্ডির আকারে পাচার হচ্ছে। অনেকে বিদেশে বাড়িঘর করছে। মানে উন্নয়নের যে পুঁজিবাদী ধারা, ওই ধারাটা অব্যাহত রয়েছে, সেটা আমরা পরিবর্তন করতে পারিনি এবং আজকে পৃথিবীতে যে সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা হলো ব্যক্তি মালিকানা এবং সামাজিক মালিকানার মধ্যে ব্যক্তি মালিকানা বিকশিত হয়েছে- সেটা দাস ব্যবস্থা বলুন, সামন্ত ব্যবস্থা বলুন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলুন, একটা আর একটা থেকে উন্নত এবং প্রত্যেকটাই ওই ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাস করে। 
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যেটা হয়েছিল, আমরা যে অক্টোবরে বিপ্লব উদযাপন করতে যাচ্ছি, তাদের মূল কাজটাই ছিল ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা। আমরাও কিন্তু বাংলাদেশে সামাজিক মালিকানা চেয়েছি। স্পষ্ট করে আমরা বলতে পারিনি কিংবা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তুলে ধরতে পারেনি কিন্তু আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই যে কৃষকের জীবন সেটা সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। যৌথ উত্পাদন হবে, কারখানাগুলোর মালিকানা যৌথ হবে এবং সামাজিক মালিকানা হবে- সেটা আমরা বলতে পারলাম না।
আমরা বলি, বাংলাদেশে যেটা স্বাধীনতা পেয়েছে, সেটা হলো পুঁজিবাদ স্বাধীনতা পেয়েছে। পুঁজিবাদ অব্যাহতভাবে, দুর্দান্তভাবে লুণ্ঠনের মাধ্যমে ক্রমশ প্রকৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে, নদীনালা মেরে ফেলছে। পুঁজিবাদ কিন্তু অত্যন্ত উঁচু জায়গায় চলে যাচ্ছে। আজকে আপনি যে সমস্যার কথা বলছেন, সেটা ওই পুুঁজিবাদের বিকাশের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে এবং ধর্মের যে রাজনৈতিক ব্যবহারের কথা বলি, ওটা ওই ব্রিটিশ আমলে হয়েছে। ব্রিটিশরাই সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করেছিল, পাকিস্তানিরা এলে তারাও এটাই করতো। আজকে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা যে খুব ধার্মিক তা বলা যাবে না। তারা মনে করে যে, ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে শান্ত রাখা যাবে, মানুষের ভোট পাওয়া যাবে। আবার তারা মাদরাসা তৈরির প্রতি উদ্যমী হয়েছে, তারা প্রাইমারি স্কুল করবে না, মাদরাসা করবে। কারণ মাদরাসা করা সহজ। অত বেশি টাকা লাগে না। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে তারা একটা বিনিয়োগ করছে। একটা পরকালের জন্য বিনিয়োগ, আর একটা ইহকালের জন্য বিনিয়োগ। ইহকালের জন্য বিনিয়োগ, যেমন জনপ্রিয়তা বাড়ছে, নির্বাচনে দাঁড়ালে সুবিধা হবে। কিন্তু যারা মাদরাসায় পড়ছে, তারা কিন্তু ওই দারিদ্র্যের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হচ্ছে না। ভালো চাকরি মিলছে না। কিন্তু মাদরাসা যারা তৈরি করছে, তাদের ছেলেমেয়ে কিন্তু মাদরাসায় পড়ছে না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করছে।
আমরা একটা অসাম্প্র্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন মোটামুটিভাবে সামাজিক মালিকানার রাষ্ট্র চেয়েছিলাম, আজকে যে অবস্থানে দাঁড়িয়েছে দেশ, তাতে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন পুঁজিবাদী ডেভেলপমেন্টের বৈষম্য বাড়ছে, গতকালও আমাদের সংবাদে একটা রিপোর্ট এসেছে যে, বৈষম্য বাড়ছে; এর একটা প্রতিফলন আমরা দেখি আবার ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার এবং সাম্প্র্রদায়িক উত্থানের ফলে আর একটা অস্থিরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, যা ক্রমশ বাড়ছে। এখান থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি? 
এসব পথ খুঁজতে পুঁজিবাদী বিকাশ কিন্তু চরিত্রগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। সে শুধু মুনাফা বোঝে, আর কিছু বোঝে না। আর যারা শাসক তারা রাজনৈতিকভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে যাচ্ছে, সেজন্য ধর্ম আসছে এবং মাদরাসা শিক্ষা ও ধর্ম এখন এমন জায়গায় চলে গেছে যে, হেফাজত একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। তাদের দাবি মেনে নিয়ে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যে একটা সংশোধন করা হলো, সেটা অকল্পনীয়, নজিরবিহীন। তারা একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে তৈরি হয়েছিল, এখন তারা একটা রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাদের হাতে ভোট আছে এবং তারা বিক্ষোভ করতে পারে। তারা শুক্রবারে মিছিল করে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। এখন তারা এমন পর্যায়ে চলে গেছে, তাদের সামলানো যাচ্ছে না। যে ইহজাগতিক রাজনীতি, ওই রাজনীতি কাদের করার কথা? ওই রাজনীতি সমাজতান্ত্রিকদের করার কথা। আমাদের দেশে এই দুটো ধারাই ছিল, একটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ধারা, আর একটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ধারা। এখন জাতীয়তাবাদীরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে, সমাজতান্ত্রিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারেনি। যদিও সমাজতান্ত্রিকরাই এই আন্দোলনগুলোর চালিকাশক্তি ছিল। আপনি ভাষা আন্দোলন দেখুন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দেখুন, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন দেখুন এইখানে সমাজতান্ত্রিকরাই আছে, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারেনি। 
এই ক্ষমতায় যেতে না পারার কারণে, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে, দেশে বিনিয়োগ করে না, তারা শিক্ষাকে উত্সাহিত করে কিন্তু গুণগত বিকাশ করে না এবং এখানে আমি একটা কথাই বলবো, এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ, গোটা দেশের পোস্টারটা এখানেই আছে। ছাত্র আন্দোলনকে শাসকরা সবসময় ভয় করে। আইয়ুব খানের শাসন যখন এলো, আইয়ুব খানের একটা চিন্তা ছিল, যদিও চিন্তাটা হাস্যকর, তবুও আমরা শুনতাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়টাই হলো প্রধান, এখানকার ছাত্ররাই আন্দোলন-সংগ্রাম করছে এবং ইউনিভার্সিটিটাকে টঙ্গীতে নিয়ে যেতে চাইল, টঙ্গীতে নেয়া সম্ভব হলো না কারণ সরকার সমর্থক শিক্ষকরাই বললেন, টঙ্গীতে গিয়ে আমরা সেলুন কোথায় পাবো, আমরা লন্ড্রি কোথায় পাবো। ওখানে থাকা সম্ভব হবে না। তখন এই যে আমাদের টিএসসি, এই টিএসসি গঠন করার চিন্তা মাথায় এলো এই ভেবে যে, টিএসসিতে আমাদের শিক্ষকরা খেলাধুলা করবে, গানবাজনা করবে, সাঁতার কাটবে, এইখানেই ঘোরাঘুরি করবে, তারা রাজনীতি করবে না। কিন্তু হলো উল্টোটা। তখন এই টিএসসিই কিন্তু রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। 
এখান থেকেই সব আন্দোলন হতো, মিছিল হতো, মিটিং হতো এবং এটা চলতে থাকল এবং সত্তরের দশক পর্যন্ত টিএসসি খুব মুখর ছিল। তারপর সামরিক শাসন যখন এসেছে, তখন এটা স্তব্ধ হয়ে এসেছে। তবে এরশাদের সময়ও কিন্তু সামরিক শাসনবিরোধী যে আন্দোলন, সে আন্দোলন এই টিএসসি থেকে একটা বিশাল ভূমিকা নিয়েছিল। এরপর একানব্বই সাল থেকে যখন নির্বাচিত সরকার এলো, তখন থেকে আর কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র সংসদ নেই। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র সংসদ নেই। এই যে নতুন প্রজন্ম যে সাংস্কৃতিক অনুশীলনে, চিন্তায়, খেলাধুলায়, রাজনীতিতে বিকশিত হবে- সেটা শাসকরা তৈরি হতে দিচ্ছে না এবং দারুণ একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেটার ফল আমরা এখনই পাচ্ছি, আরও পাবো।
 মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্ন তো বাস্তবায়ন হয়নি, হচ্ছে না, এর প্রতিফলন গণতন্ত্রেও পড়ছে, গণতন্ত্রও যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে বিকশিত হচ্ছে না। গণতন্ত্রও তো আপনার দুই ধরনের গণতন্ত্র আছে, একটা ধরুন আপনার সংসদীয় গণতন্ত্র, সেটা নির্বাচনভিত্তিক। কিন্তু আমাদের এখানে তো আর সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না, হবে না বা হলেও সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না। সংসদ কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না। গণতন্ত্রের যদি আপনি আরও মূল জায়গায় যান, তাহলে গণতন্ত্রের মূল কথাটা কিন্তু ভোট না, গণতন্ত্রের মূল কথাটা হচ্ছে, অধিকার এবং সুযোগ সমান থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং প্রত্যেকটা জায়গায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটা এখানে সম্ভবই না। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সমাজতন্ত্রের দ্বারা সম্ভব। তো সমাজতন্ত্র তো আমাদের এখানে নেই, আসেওনি। এখানে যে গণতন্ত্র আছে, সংসদীয় গণতন্ত্র শুধু, সেই গণতন্ত্রটাও কাজ করছে না। কাজ করছে না এ কারণে যে, আমাদের যারা শাসক এবং তাদের মধ্যে যে বিরোধ, সেটা মতাদর্শিক না, যদিও মতাদর্শিক একটা আবরণ আছে, এই বিরোধটা হচ্ছে ক্ষমতার দরকষাকষির বিরোধ, ধান্ধাবাজি এবং এই বিরোধের ফলে ওটাই রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের চিন্তা হচ্ছে কে ক্ষমতায় যাবে আসবে, সেটা। জনগণ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। যেমন ব্রিটিশ আমলে লীগ-কংগ্রেসের মধ্যে ঝগড়া, পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ আর আইয়ুব খানের মধ্যে ঝগড়া। এই ঝগড়াগুলো এখনও রয়ে গেছে। এখনও আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যেই ঝগড়া। এইটা কিন্তু ধনীদের রাজনীতি, জনগণের যে রাজনীতি, সমাজের পরিবর্তনের যে রাজনীতি সেটা এদেশে বিকশিত হয়নি।
সামাজিক বিপ্লব বলতে, সমাজ বলতে আমরা সম্পর্ক বুঝি। মূল সম্পর্কটা ওই যে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছে জমিদার এবং প্রজার মধ্যে- ওই সম্পর্কটাই রয়ে গেছে। এখন জমিদার নেই কিন্তু ধনী আছে এবং ধনীর অধীনে গরিব মানুষ আছে। সম্পর্কটা ওই মালিক এবং অধীনস্থদের ভেতর। ওই সম্পর্কটাকে তো আমরা পরিবর্তন করতে পারিনি। সেই জন্যই সামাজিক বিপ্লবের দরকার ছিল এবং এই যে ব্যক্তি মালিকানার যে জায়গাটা, সেটা ভেঙে আমরা একটা সামাজিক মালিকানায় যাবো। 
স্বপ্ন অস্পষ্টভাবে সেটিই ছিল এবং যখন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তখন তারা শুধু পাকিস্তানিদের যে তাড়াতে চেয়েছে তা নয়, তারা ভেবেছে যে, এই রাষ্ট্রটাকে এই সমাজটাকে আমরা এমন করব, যেখানে সব মানুষের সুযোগ থাকবে, সব মানুষের অধিকার থাকবে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্র এককেন্দ্রিক থাকবে না, ক্ষমতা এক কেন্দ্রিক থাকবে না। সব মানুষ সমান হয়ে যাবে না, এটা ঠিক, তবে সব মানুষেরই সমান অধিকার থাকবে এবং সমান সুযোগ থাকবে। তো ওই ব্যবস্থা তো আমরা দিতে পারিনি। সমাজতন্ত্রীরা আন্দোলন করলেন, তবে স্বাধীনতার যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধে তো তারা নেতৃত্ব দিতে পারেননি। যদি তারা নেতৃত্ব দিতে পারতেন তবে সেই স্বাধীনতা অন্য মাত্রা পেত। সেই স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা হতো না, তা একটা সামাজিক পরিবর্তন আনত। মূল ব্যাপারটা কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনে।
আমরা দেখেছি পাকিস্তান আমলে, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন এদেশের সুশীল সমাজ চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে যে একটা অগ্রসর ভূমিকা পালন করেছে এবং আমরা অনেকের লেখা পড়ে, অনেকের বক্তৃতা শোনে, অনেকের আলোচনা শোনে অনুপ্রাণিত হয়েছি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে এখানে আলোচনা সভা-সেমিনার হয়েছে- সেসব আলোচনা শোনে, আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি, আমাদের চেতনায় একটা আঘাত এসেছে। সেখান থেকেই আমাদের একটা মনন তৈরি হয়েছে, সমাজ, বিপ্লব, রাজনীতি, এসব বিষয়ে। আজকে সেই ভূমিকাটা দেখা যাচ্ছে না কেন?
এটা খুব দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের ছাত্ররা কিন্তু অনেক বেশি অগ্রসর ছিল অন্যদের তুলনায় এবং আপনি দেখেন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পাকিস্তানপন্থি বুদ্ধিজীবী ছিল, সাহিত্যিকদের মধ্যে পাকিস্তানপন্থি সাহিত্য চর্চা আবার উদারনৈতিক সাহিত্য চর্চা ছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাকিস্তানের সহযোগী যে পরিমাণ মানুষ ছিলেন, বিশেষ করে শিক্ষকদের মধ্যে, অন্য কোনো ক্ষেত্রে এতটা দেখা যায়নি।
আমরা এর ভুক্তভোগী, আমরা দেখেছি। তার মানে ছাত্ররা অনেক এগিয়ে ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বলুন, মুক্তিযুদ্ধ বলুন, অন্য কোনো আন্দোলন বলুন, ছাত্ররাই এগিয়ে ছিল, স্বাধীনতার পতাকা তারাই উত্তোলন করেছিল। এটা গেল একটা দিক। আর একটা দিক হলো এই স্বাধীনতা আমাদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে, অপ্রত্যাশিত সুযোগ। এই সুযোগে আমাদের যারা বুদ্ধিজীবী তাদের যেখানে যাওয়ার কথা ছিল না সেখানে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এবং তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার সহযোগীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই ব্যবস্থাটাকে তারা টিকিয়ে রাখতে চায়। 
যদিও মুখে তারা অন্য কথা বলবে। তাদের স্বার্থ রাষ্ট্রের স্বার্থ এক হয়ে গেছে। তবে পাকিস্তান আমলে তাদের স্বার্থ আর রাষ্ট্রের স্বার্থ এক ছিল না। তারা মনে করতো, পাঞ্জাবিরা চলে গেলে আমরা ওই জায়গাটাতে গিয়ে বসবো। এইটা কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। পাঞ্জাবিরা চলে গেল, তো আমরাই তো সেখানে বসে গেছি, আমরাই তো শাসক হয়েছি। যে শ্রেণিটা তখন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করত, তাদের কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সেই বিরোধিতা নেই। কারণ রাষ্ট্র তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। আর একটা বিষয় হচ্ছে, মেধা কিন্তু অনেক পাচার হয়ে গেছে। যারা এই দেশে রাজনীতি করতো এবং দেশটা সম্পর্কে ভাবতো, তারা কিন্তু আর এই দেশে ফেরত আসেনি। তারা মনে করেছে যে, তাদের কর্মক্ষেত্র এদেশে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। তাছাড়া একাত্তর সালেও তো আমাদের যারা বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। একদিকে হত্যা করা হলো, আরেকদিকে পাচার হয়ে গেল, আরেকদিকে সুবিধা পাওয়া গেল। আর আপনি যদি বিরোধিতা করেন, আপনি বঞ্চিত হবেন, নানান রকম পুরস্কার আছে, নানান রকম পদ আছে, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন। যদি সংগঠিত আন্দোলন থাকতো, তবে অনেক কিছুই সম্ভব হতো। আন্দোলনই কিন্তু একজন মানুষকে সাহস দেয়। ব্যক্তিগতভাবে তো ওই আন্দোলনটা সম্ভব নয়। এখন তো দেশে সেই আন্দোলনটাই নাই।
আপনি দেখুন এখন নানা রকম মিডিয়া আছে, পত্রিকা আছে, টেলিভিশন আছে, কিন্তু আগে যে পত্রিকা বের হতো, এবং তার যে উপ-সম্পাদকীয় বের হতো, তার যে পাঠক ছিল, সেগুলো পড়ার প্রতি তখন যে পাঠকের আগ্রহ ছিল, এখন সে আগ্রহ নেই। না থাকার কারণ, এখন পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেশি, জায়গা নাই। ছোট ছোট জায়গা। 
দ্বিতীয়ত, লেখারও লোক নাই। ওই চিন্তার মানুষও নাই। যারাওবা আছে, তারা অন্যদিক থেকে এত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে যে সেদিকে চলে যাচ্ছে। কারণ ওই লেখার জন্য তিনি যে টাকাটা পাবেন, কোথাও টকশো করলে বা অন্য কিছু করলে তিনি আরও অনেক লাভবান হবেন। আগে কত মাসিক-সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল, এখন তো তেমন কোনো সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকা নেই, যেগুলো মানুষ পড়বে। দৈনিক পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনের ভারে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। লেখার চাইতে সংবাদের চাইতে বিজ্ঞাপন বড়। সেখানে লেখাগুলো বা সম্পাদকীয়গুলো মানসম্মত হয় না বা ভেবে-চিন্তে লেখা হয় না। এজন্য চিন্তার খোরাকটা কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিযোগ: যে পরিমাণ গবেষণা হয়, সেখানে প্রকাশনার পরিমাণ খুব সীমিত। এবং আমাদের শিক্ষকের পরিমাণ যত বেড়েছে, সে পরিমাণে গবেষণা নেই, প্রকাশনা নেই।
 আমাদের যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চর্চা, এই চর্চাটা তো বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিকরা করছে, জাতীয়তাবাদীরাও করছে। আমাদের এই রাজনীতি চর্চার মূল দুর্বলতাটা আপনি কোন জায়গাটায় দেখতে পান। এই বিষয়টা নিয়ে লেখকরা বা চিন্তকরা যারা লেখালেখি করছেন, তাদের ভূমিকাটা বা লেখালেখির দৃষ্টিভঙ্গিটা কোন দিকে ধাবিত হলে উত্তরণের পথ আছে বলে মনে করেন। এর আগে আমাদের পরিষ্কার হতে হবে যে, আমরা কী চাই। এখন আমার যা উপলব্ধি, তাতে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা ব্যক্তি মালিকানা চাই না সামাজিক মালিকানা চাই। 
এখন মানুষের সভ্যতা একটা চরম সংকটের মধ্যে আছে, যেখানে ব্যক্তি মালিকানা তার চরম ফ্যাসিবাদী রূপটা দেখাচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাটা টিকে আছে কয়েকটা মাধ্যমে। একটা হচ্ছে তারা ছাড় দিচ্ছে, আরেকটা হচ্ছে নিপীড়ন করছে, আর নানা ধরনের কৌশল ব্যবহার করছে। এবং কৌশলের মধ্যে মিডিয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।   (চলবে...)



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft