বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
Published : Sunday, 25 March, 2018 at 8:37 PM, Count : 5500

স্বপন কুমার সাহা : ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৪৭তম দিবস আজ। স্বাধীনতা দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মুক্তিযোদ্ধাদের- যাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ফলে আজকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভারতের মিত্র বাহিনীর যোদ্ধাদের- যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ হারিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। আমি শ্রদ্ধাভরে হূদয়ে ধারণ করি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও স্বাধীনতার স্থপতি ও বাঙালি জাতির সৃষ্টি ও কৃষ্টির ধারক-বাহক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বৃটিশের ঔপনিবেশিক শাসকের কাছ থেকে ’৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের উপর নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চনা শুরু করে। এই শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে ২৩ বছরে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত করতে বাংলাদেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন।
৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় পরিষদের এ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকরা ষড়যন্ত্র ও টালবাহনা শুরু করে। এক পর্যায়ে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেও ১৯৭১ সালের ১ মার্চ রেডিওর মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান অধিবেশন  স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ ১ দফা দাবিতে- বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত বিশাল জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল। আর সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সেদিন থেকেই জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। স্লোগানে স্ল্লোগানে ঢাকার রাজপথসহ সারা বাংলাদেশ মুখরিত হয়েছিল- ‘এক দফা এক দাবি- বাংলাদেশ স্বাধীন কর, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
৩ মার্চ পল্টনে জনসভার পর পরবর্তি কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুীরসহ কয়েকজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ৩২নং বাসভবনে যান। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কথা বলে শেষ পর্যায়ে তাত্পর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ যে উক্তি করলেন, তা হল টউও ( Unilateral Declaration of Independence), অর্থাত্ একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার দিকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২৩ বছরে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন, বঞ্চনা, জেলজুলম ও হত্যাযজ্ঞই একতরফাভাবে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেয়। ভয়েস অব আমেরিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর তাত্পর্যপূর্ণ ‘ইউডিআই’ উক্তিটি উল্লেখ করেন। গত সপ্তাহেও জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে ‘ইউডিআই’ কথাটি উল্লেখ করেন।
সেই আন্দোলন মুখর পরিস্থিতিতে এল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহারাওয়ার্দী ময়দানে (তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে) লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে দিক-নির্দেশনামূলক মহাকাব্যিক ভাষণ দেন। ভাষণের শেষাংশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এ ভাষণের পর থেকে আন্দোলনের গতি আরও বেগবান হতে লাগলো এবং পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে চললো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তাল জনবিক্ষোভ সারাদেশ। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি উপর ‘ঙঢ়ধত্ধঃরড়হ ঝবধত্পয খরমযঃ’ নামে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে। এর আগেই মধ্য রাতে অর্থাত্ ২৬ মার্চের ১ম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তত্কালীন ইপিআর অয়ারলেসের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের ১৮ দিন কার্য্যত পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা বা ক্ষমতা তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে অচল হয়ে পড়েছিল। পূর্ব-পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হতে চললো। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে সারাদেশে পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেদিন তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠির নির্দেশ অমান্য করে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল।
তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বিভিন্ন জেলা, মহকুমা ও থানা শহরগুলোতে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে যা কিছু ছিল তা নিয়েই শত্রুর (পাক হানাদার বাহিনীর) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন ও আক্রমণ শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাহসী রাজনীতিবিদ ও মানবদরদী স্নেহময়ী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ন্যায্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আরও সাহস ও আস্থা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ জন্য জানাই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এক কোটি মানুষকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় দিয়ে খাওয়া-পড়া ও বাসস্থানের ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন সেই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শ্রীমতি গান্ধী অকৃত্রিম বন্ধু। ভারতের জনগণও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি আজও কৃতজ্ঞ।
মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করেছিলেন, এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন সবাই বলতে গেলে পরীক্ষিত জাতীয় নেতা। সিদ্ধান্ত নিতে বঙ্গবন্ধুকে বুদ্ধি পরামর্শ ও সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন তারা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে অন্যতম জাতীয় চার নেতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- তারা হলেন, প্রয়াত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রয়াত ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও প্রয়াত কামরুজ্জামান।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আদেশে প্রতিদিনের কর্মসূচি কিভাবে তত্কালীন পূর্বপাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-বীমা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চলবে সেই সকল নির্দেশনাবলী বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমেদ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ব্রিফ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও  বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
মজার ব্যাপার হলো অসহযোগ আন্দোলন ও জনগণের রায়কে বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে ষড়যন্ত্র চলছিল। এ ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়ন করার জন্য ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় আগমন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে নীল নকশা প্রণয়ন করা। সেই নীল নকশা অনুযায়ী ২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।  
এদিকে বঙ্গবন্ধু ছিল বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে অবিচল। তাই এ ব্যপারে বঙ্গবন্ধু তার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর পাক সামরিক জান্তার আক্রমণ হবে- বঙ্গবন্ধু তা আগেই জানতে পেরে তার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকা ছেড়ে নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য। তবে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করেই নিরাপদ স্থানে চলে যাননি। কারণ হলো- সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে যদি তার ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বার বাসায় পাক সেনারা না পেতো তাহলে হয়তো বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে বের করার নামে সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে হত্যা যজ্ঞ চালাতো। একই সঙ্গে পাক সামরিক জান্তারা বঙ্গবন্ধুকে উগ্রবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালাতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একজন গণতান্ত্রিক নেতা হয়ে সারা জীবন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে গেছেন। আর বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ স্বাধীন প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৫ মার্চ অর্থাত্ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যা আমরা ২৫ মার্চ গভীর রাতে ইপিআরের ওয়্যারলেস ম্যাসেজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণটি পাই। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি পদক্ষেপ বাংলার মানুষ ও বাংলাদেশের দেশ প্রেমে ভরপুর। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের আলোচনার ফাঁদে পা দেননি। কারণ বঙ্গবন্ধু সবই জানতেন এবং বুঝতেন। তাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকট নিরসসনের জন্য বঙ্গবন্ধু সুযোগ দিয়েছেন পাকিস্তানি শাসকদের, যাতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দসহ কেউ না ভাবেন যে, বঙ্গবন্ধু হঠকারিতার পথ বেছে নিয়েছেন।
৭ মার্চ ভাষণের পর গোটা দেশ ও জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে। এতে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার আরেকটি বড় প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তত্কালীন রেডিও পাকিস্তান পরদিন সকালে প্রচার করতে বাধ্য হয়। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী চলছিল বাংলার অফিস, আদালত, ব্যাংক-বীমাসহ সব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল দেশের কোথাও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি বাংলার জনগণ। সবাই স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
২৬ মার্চ সকালে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদে জানায় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিবাহিনী গ্রেফতার করে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকা শহরে বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞের খবরও কিছু কিছু পাওয়া গেল। বাঙালি পুলিশ, বিডিআর, রাজনীতিবিদ, ছাত্র শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ পাক বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছিল।
সেদিন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, কমরেড মনি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফর আহমেদ, অলি আহাদসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, (মুসলিম লীগ ও জামায়াত শিবির বাদে) বাঙালি সৈনিক, বিডিআর, পুলিশ, আনসার, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে যার যার অবস্থান থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রাজনীতি নয়, সেদিন সবার একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নকে সার্থক করে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধে সবারই অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
মূলত বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও দিক-নির্দেশনায় উজ্জীবিত হয়ে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। যা আজ সারা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুপরিচিতি লাভ করেছে।
আজকের দিনটি আমার কাছে ভিন্নতর গৌরবে আন্দোলিত করার মতো। কারণ- যে ডাকে ও পরিপূর্ণ দিক-নির্দেশনায় অর্জিত হলো মহান স্বাধীনতার বিজয়, সেই মহাকাব্যিক ৭ মার্চের ভাষণটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হয়েই বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্বের স্মৃতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। গত ৩০ অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক বিজ্ঞপ্তিতে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে ঘোষণা করেন। দীর্ঘ বছর পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী সেই ভাষণটির বিশ্ব স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তি- বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করছে। এটাই আমার আত্মতৃপ্তি। আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্ব আরও বেশি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ভাষণ সারাবিশ্বকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সমানভাবে আলোড়িত করবে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো- কখনোই কোনো ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুর বিশাল অর্জনকে সামান্যতম ম্লানও করতে পারেনি, পারবেও না।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft