এইচএসসির ফলাফল নিয়ে কিছু কথা
Published : Sunday, 30 July, 2017 at 8:25 PM, Count : 10019

মোতাহার হোসেন : এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি এখন সর্বত্রই আলোচিত। যেখানে দেশ এগিয়ে চলেছে, সেখানে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পিছিয়ে কেন- এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে; যে যার মতো মন্তব্য করছে। কেউ মন্তব্য করছে, আমরা কি তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি? অনেকে আবার সৃজনশীল পদ্ধতিকে দায়ী করছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির অভিযোগও উঠেছে। আবার সমালোচনার ঠিক উল্টোদিকে অনেকের অবস্থন। তাদের মতে, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল সবসময় নাও পাওয়া যেতে পারে। জিপিএ-৫ অর্জন কমে যাওয়ার বিষয়টিকে তারা যেভাবে মূল্যায়ন করছেন তা হল- জিপিএ-৫ অর্জনই মূলকথা নয়, শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিই মুখ্য। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেককেই বলতে শোনা গেছে- ফলাফলের চেয়ে বড় বিষয় হলো মানুষের মতো মানুষ হওয়া; সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া
মাত্র কদিন আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে দেশের প্রচারমাধ্যমে নানা রকম শিরোনাম করেছে। কোনো কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম করেছে ‘ফল বিপর্যয়’। আবার কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে লিখেছে ‘মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে’ প্রভৃতি শিরোনামে। বাস্তবতা হচ্ছে বিগত সময়ে পাসের হার বৃদ্ধির পর গত দুই বছর পাসের হার কমের কারণে এমনটা মনে হয়েছে। আর এবার ফলাফল ঘোষণার সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করার কারণে এই ফল হয়েছে’। আর এও সত্যি যে, বছর বছর শিক্ষা এবং কোশলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ‘গিনিপিগ’ খেলা শুরু করেছে তার পরিণতি সর্বত্র বিরাজমান। প্রতি বছর ফল প্রকাশের পর প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মতো জঘন্য ও করুণ পথ বেছে নিচ্ছে।
এটা কখনো কাম্য হতে পারে না, এ জন্য দায় কার? বিশ্বমানের শিক্ষার নামে একদিকে বাণিজ্য, অন্যদিকে কোচিং, গাইড বই, শিক্ষার্থীদের ওপর অমানসিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে সুশিক্ষা এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার পরিবর্তে কেতাবি শিক্ষার পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে পুরো শিক্ষা পরিবারকে। প্রত্যাশা ছিল শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার মান বাড়ুক। মেধা যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে আফসোস নেই। অসংখ্য নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে অল্পসংখ্যক প্রকৃত মেধাবী বেশি দরকার। কারণ তারাই বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সৃজনশীল পদ্ধতির জটিলতার কারণে বছর দুয়েক আগেও গণিতের ফলাফল খারাপ হওয়ায় সার্বিক ফল একটু খারাপ হয়েছিল। এতে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টা এমন যে, সবাইকে পাস করতে হবে। ফেল করা যেন মহাঅপরাধ। তাই প্রতি বছর ফল প্রকাশের পরপরই দেশে আত্মহননের খবর চোখে পড়ে। এটা অপ্রত্যাশিত। সফলতা ও ব্যর্থতা- জীবনের এ দুটি দিকই আছে। তাই যে কোনো অবস্থায় তা গ্রহণ করার মানসিকতা দরকার। আবার এটা বলা দরকার যে, শিক্ষার্থী অপেক্ষায় বর্তমানে মা বাবারাই সন্তানের জন্য বেশি উদ্ধেগ, উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেন। আর সেই উদ্ধেগ, উত্কণ্ঠা এবং শিক্ষার নামে বাড়তি বই, বাড়তি বোঝার চাপ সইতে হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আমাদের মনে রাথা উচিত’ শিক্ষার ভিত্তি যদি দুর্বল হয় তাহলে উপরের অংশ নড়বড়ে হবেই। পরীক্ষায় যারা পাস করছে তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাস করছে না তারা কি মেধাশূন্য বলার অবকাশ নেই। শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা যায় না। বিশ্বে এমন অনেক ব্যক্তির উদাহরণ আছে, যারা স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ করলেও পরবর্তী জীবনে বড় ব্যক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। কাজেই পরীক্ষায় পাস-ফেলের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে মেধার সম্পর্ক বিবেচনায় না নেয়াই ভালো। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না, তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সৃজনশীলে নামে মূলত: শিক্ষার্থীদের একটা অবিশ্বাস্য, যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
এবারের ফলাফলে দেখা যায় একযোগে দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সম্মিলিত পাসের হার ৬৮.৯১ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মোট ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ জন। পাস করেছে ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১ জন শিক্ষার্থী। গত বছর ১০ বোর্ডে মোট পাসের হার ছিল ৭৪.৭০ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাসের হার কমেছে ৫.৭৯ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছর পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। দেখা যাচ্ছে, এ বছর জিপিএ-৫ কম পেয়েছে ২০ হাজার ৩০৭ শিক্ষার্থী।
এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি এখন সর্বত্রই আলোচিত। যেখানে দেশ এগিয়ে চলেছে, সেখানে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পিছিয়ে কেন- এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে; যে যার মতো মন্তব্য করছে। কেউ মন্তব্য করছে, আমরা কি তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি? অনেকে আবার সৃজনশীল পদ্ধতিকে দায়ী করছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির অভিযোগও উঠেছে। আবার সমালোচনার ঠিক উল্টোদিকে অনেকের অবস্থন। তাদের মতে, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল সবসময় নাও পাওয়া যেতে পারে। জিপিএ-৫ অর্জন কমে যাওয়ার বিষয়টিকে তারা যেভাবে মূল্যায়ন করছেন তা হল- জিপিএ-৫ অর্জনই মূলকথা নয়, শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিই মুখ্য। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেককেই বলতে শোনা গেছে- ফলাফলের চেয়ে বড় বিষয় হলো মানুষের মতো মানুষ হওয়া; সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো, কোনো পরীক্ষার ফলাফলে কী পরিমাণ বিপর্যয় বা শতকরা কত ভাগ ছাত্রছাত্রী ফেল করলে তা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যাবে? এই যে বলা হচ্ছে, জিপিএ বা পয়েন্ট মূল বিষয় নয়, শিক্ষার্থীরা মানুষের মতো মানুষ হলো কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করছি। কিন্তু হলফ করে বলা যাবে না ‘ভালো মানুষ’ হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জিপিএ কম পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি সুযোগ পাবে? কতটা ‘ভালো মানুষ’ হলে লেখাপড়া শেষ করে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ পাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগ থেকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সর্বনিন্ম যোগ্যতা হলো, এসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে জিপিএ-৭ এবং বিজ্ঞানে ৮। এ রকম অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রয়েছে নির্ধারিত পয়েন্ট। জানা মতে বহু শিক্ষার্থী সত্, আদর্শবান ও খুবই ভদ্র, অর্থাত্ এককথায় ভালো মানুষ। কিন্তু মানবিক বিভাগ থেকে পাস করা এসব শিক্ষার্থীর জিপিএ-৭ ও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৮ নেই। তাদের কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হবে? কাজেই শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য গ্রহণ যোগ্য নয়। যদি পরীক্ষার ফলাফল ভালো করার চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়, যেটা অনেকেই বলছেন; তাহলে জিপিএ কম পাওয়ার কারণে কেন ভর্তি পরীক্ষা বা চাকরির আবেদন করার ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য থাকবে? বাস্তবতা হচ্ছে, ভালো মানুষ হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি ভালো ফলাফলও বাঞ্ছনীয়। আমরা পিছাতে রাজি নই।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের ফলাফল খারাপ, এ সত্য মেনে নিতে হবে। এর যথোপযুক্ত কারণ অনুসন্ধান করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এবারে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রত্যাশিত না হওয়ায় আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক রুনা তাসমিনার আদুরের মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে হতাশায় বাসায়, আত্মীয় বন্ধু কারো সঙ্গেই কথা বলছেনা। মন খারাফ করে বাসায় সময় পার করছে। সেদিন ফোনে রুনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম তার ও তার মেয়ের এই যন্ত্রণার কথা। তখন আমি তাকে বললাম, তোর মেয়েকে আমার ফোনটা দাও, আমি কথা বললাম। অনেক বুঝালাম ‘মানুষের জীবন অনেক দীর্ঘ, শুধু কেতাবি শিক্ষাই সব নয়, প্রকৃত মানুষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ একই সঙ্গে এও বলাম, ‘এই পরীক্ষার ফল প্রত্যাশিত হয়নি, ভবিষ্যতে হবে- তাই মন খারাফ না করে বরং এবারের প্রত্যাশা আগামীতে পূরণে নিজেকে নিয়োজিত করা.. ইত্যাদি ইত্যাদি। তাতে এও বললাম, অনেকেই ভালো ছাত্র না হয়েও ভবিষ্যতে ভালো পদে, ভাল কাজে সুযোগ পায়। আবার অকেনেই ভালো ছাত্র হয়েও পরে তিনি ভালো শিক্ষক নাও হতে পারেন। এ রকম অসংখ্য নজির আছে। কাজেই এইচএসসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শিক্ষা জীবনের কথা ভাবতে হয়। কাজেই ভালো, সত্, আদর্শবান ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হওয়া জরুরি।
ফেসবুকে একজন ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করেছেন এ রকম ‘এইচএসসির ফলাফল ও আমাদের অস্থির শিক্ষা ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা পরিভ্রমণ করে তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলা। শিক্ষা গ্রহণ বা জ্ঞান অর্জনের জন্য থাকে বিভিন্ন পদ্ধতি বা উপায়। পরিবার এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব নিয়ে থাকে। প্রত্যেক সমাজেই জ্ঞান সরবরাহ-প্রাপ্যতা নির্ধারণের একটা মাপকাঠি থাকে।
আমাদের সমাজেও আছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা জানান দেয় একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখেছে। এমন পরীক্ষা দ্বারা প্রাথমিকভাবে একজন ছাত্রকে মূল্যায়ন করা গেলেও প্রকৃত মূল্যায়ন অসম্ভব। প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষা নিয়ে গিনিপিগ পরীক্ষার পরিবর্তে প্রকৃত মানুষ গড়তে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপান্তর না করে জীবনমুখী, মানবতামুখী, বাস্তবমুখী এবং দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মনোনিবেশ করা হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft