সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
Published : Wednesday, 7 February, 2018 at 9:01 PM, Count : 6712

মো. ওসমান গনি : পৃথিবীর প্রতিটা দেশের মানুষের কাছে তার দেশের ভাষা অতি প্রিয় এবং মধুর। তার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সব ভাষার চাইতে অধিক প্রিয়। আমরা এ ভাষায় কথা বলে আনন্দ ও তৃপ্তি পাই অতি সহজে তা আর কোন দেশের ভাষায় সম্ভব না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মাধ্যমেই আমরা বাঙালিরা একে অপরের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। এ ভাষায় কথা বলতে পেরে আমরা আত্মতৃপ্তি পাই। আমরা বাঙালিরা যেভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলে বা লিখে আমরা মনের ভাবপ্রকাশ করতে পারি তা অন্য ভাষায় প্রকাশ করা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর। তাই পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে সব ভাষার চাইতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সবার চেয়ে ঊর্ধ্বে। তাতে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। বর্তমানে আমাদের এ বাংলা ভাষা হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করছে। যেটা আমাদের বাঙালির কাছে সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয়। আমাদের এ ভাষা আমরা কোনো জাতির করুণায় পাইনি। এ ভাষার জন্য আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ ভাষা আদায় করার জন্য বাঙালি জাতি তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে। ২০০৯ সালের হিসাবমতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকসের ভাষ্য মতে, পৃথিবীতে এখন ভাষার সংখ্যা ৬ হাজার ৯০৯টি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাগুলোর মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অন্যরকম। কোনো ভাষার জন্য তো আর কোথাও জীবন দেয়নি কেউ, ভাষার দাবিতে তো মরণপণ সংগ্রাম আর কোথাও হয়নি। তাই, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, প্রিয় বাংলাভাষাকে নিয়ে আমাদের ভালোবাসা ও গর্ব অনেক বেশি।
যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে পেয়েছি আজ আমরা তাদের কাছে চিরঋণী। কিন্তু যারা আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে আমাদের বাংলা ভাষা এনে দিয়ে গেল আমরা আজ তাদের জন্য কী করতে পেরেছি? আর এ বাংলা ভাষার প্রচলনটাই বা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি। যারা ভাষার জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে ভাষা আনলো তারা কি আজ তাদের যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে? আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখি ভাষা শহীদদের স্মৃতিগুলো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস আসলে আমরা আমাদের ভাষার জন্য পাগল হয়ে যাই। বছরের অন্য দিনগুলোতে তার কোনো খবর থাকে না। এমনটা হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ঠিক না। যে ভাষার জন্য লাখ লাখ লোক শহীদ হয়ে ভাষা আনলো সেই ভাষার প্রতি আমাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। ভাষার কোনো বিকৃত হয় কি-না সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হয় কি-না সেটাও দেখতে হবে। আমাদের দেশের সর্বত্র যদি বাংলা ভাষার প্রচলন চালু রাখতে পারি তাহলে আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম সার্থক ও সফল হবে। এখনও আমাদের দেশের অনেক জায়গায় ভিন দেশের ভাষার প্রচলন দেখা যায়। যেটা আমাদের জন্য মোটেও কাম্য না। হ্যাঁ ভিন দেশের ভাষার ও প্রয়োজন আছে। যেমন আন্তর্জাতিকভাবে ভিনদেশি ভাষা ইংরেজির দরকার হয়। নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের ভাষাকে উপরে স্থান দিতে হবে তা মানা যায় না। যদি দেয়া হয় তাহলে ভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম ও রক্ত বৃথা যাবে। এটা হবে আমাদের বাঙালির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেটা এদেশের কোনো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কোনো লোকই মেনে নেবে না। বাংলা ভাষা অতি সহজ ও মধুর ভাষা হওয়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশের লোকেরা এখন বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করছে। তাদের এ ভাষা শিখনের জন্য প্রশংসার দাবিদার আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। যারা কর্মের তাগিদে বিভিন্ন দেশে গিয়ে কর্মের স্বার্থে নিজ দেশের ভাষা বিদেশিদের শেখান। অনেক ভিনদেশি লোক আমাদের দেশে আসেন আমাদের দেশের লোকজনের সঙ্গে। তারা ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা শিখে বাংলায় কথা বলেন। আবার অনেক ভিনদেশি লোক পুরোপুরি বাংলা ভাষায় কথা বলতে শিখেছেন। এটা আমাদের বাঙালিদের গৌরব।
আমাদের দেশের কতিপয় উচ্চবিত্ত লোক ব্যস্ত থাকেন তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাতে। তারা মনে করেন- ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাদের গৌরব। হ্যাঁ ইংরেজি শিখবে, তবে আগে নিজ মাতৃভাষা বাংলা শেখার পর। তাহলেই তাদের গৌরব করা সাজে। নিজের মাতৃভাষা অবহেলিত রেখে ভিন দেশের ভাষা ছেলেমেয়েদের শিখাতে প্রাধান্য দেয়া হলে সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। ইংরেজি যেমন বর্তমানে সারাবিশ্বের ভাষা, পর্যায়ক্রমে বাংলাও হবে একদিন সারাবিশ্বের ভাষা। হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে লাখ লাখ নতুন লেখক সৃষ্টি হয়েছে। যারা সারাবছর বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের বই লিখেন একুশের বইমেলায় প্রকাশের জন্য। আর এ বইগুলো এত পাঞ্জল ভাষায় লিখেন যেগুলো মানুষ পড়তে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এতে করে মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে। জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা জাগছে। তবে বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ভাষার বানান ও রীতি সঠিক থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেমন আমরা জীবন দিয়েছি এ ভাষার প্রসার ঘটাতেও আমরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাব। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই।
আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলা এখানও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়নি। তদুপরি শিক্ষা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনটির মধ্যে যে ধারাটি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে এবং যার ভেতরে থেকে বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করছে এবং আগামী দিনে যে-ধারায় শিক্ষিতরাই সমাজে কর্তৃত্ব করবে বলে ধরে নেয়া যায়, সেই ধারাটির মাধ্যম অবশ্যই বাংলা নয়। সেটি ইংরেজি। আর বাংলা মাধ্যমে যারা লেখাপড়া করে তাদের ভেতরও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ যে কমছে না বরং বাড়ছে এতেও নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই। উচ্চস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না দেয়ার ব্যর্থতার দরুন শিক্ষা গভীর হচ্ছে না, এমনকি তাকে যথার্থ শিক্ষাও বলা যাচ্ছে না, কেননা মাতৃভাষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই যথার্থ হয় না। উচ্চ আদালতে বাংলাভাষার কার্যকর ব্যবহার নেই, অথচ সেখানে বাদী-বিবাদী আইনজীবী বিচারক সবাই বাঙালি। এটিও বাংলার অপ্রচলনের একটি করুন দৃষ্টান্ত বৈকি।
পাকিস্তানিরা চেয়েছিল উর্দুকে চাপিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু তখন তো দেশ শাসন করছে স্বদেশিরা, তাহলে এখনও কেন বাংলা সর্বত্র প্রচলিত হচ্ছে না?
দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের ধনী ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমনকি বাংলাকে ইংরেজি এবং হিন্দির সঙ্গে মিশিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আজও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব অঞ্চলের বিভিন্ন সাইনবোর্ডগুলো লেখা হয় ইংরেজিতে, আবার বিয়ে ও জন্মদিনের কার্ডগুলো আজ বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে লেখা হয়। বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত প্রমিত বাংলা নিয়ম একেবারেই কম ব্যবহার করা হয়।
যে মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে গিয়ে এ জাতির বীরসন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উত্সর্গ করেছিল সে মাতৃভাষা বাংলাকে এইভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মেনে নেয়া যায় না। আর আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ঐক্যহীনতার কারণে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাভাষার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করানোর জন্য আমাদের সবাইকে ভাষার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। দলমত নির্বিষেশে দেশের সব মানুষকে বাংলাভাষার প্রচলন ও তার ব্যবহারে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft