শিরোনাম: |
প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার প্রসঙ্গে
|
মো. মাঈন উদ্দিন : আজকের শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার। শিশুরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যে, চিন্তা-চেতনায়, মনন ও মানসিকতায় যত উন্নত হবে ভবিষ্যত্ জাতি তত সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু আজকালকার সময়ে শিশুদের সুস্থ মানসিকতা নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন বেশির ভাগ শিশু গবেষক, উদ্বিগ্ন সচেতন মহল, উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। আর এই উদ্বেগের সামনে যে বিষয়টি চলে আসে তা হলো মোবাইল ও প্রযুক্তির অযাচিত ব্যবহার।
প্রযুক্তি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নয়নে নিঃসন্দেহে অপরিহার্য। নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। প্রযুক্তির অনেক অনেক ভালো দিক যেমন রয়েছে, রয়েছে তেমনি দুই একটি মন্দ দিকও। তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র দিক নিয়েই আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি। মানব শিশুর মন কাঁদামাটির মতোই কোমল থাকে। শিশুকে যেভাবে, যে পরিবেশে গড়ে তোলা হবে শিশু সেভাবেই বেড়ে উঠবে। কাঁদামাটি যতটা নরম থাকে এই কাঁদামাটি দিয়ে গড়া ইট কিন্তু ততটাই শক্ত হয় অর্থাত্ পরিবেশের কারণে শিশু মনে কোনো অভ্যাস একবার স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসলে তা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। আমাদের দেশে একটি শিশু ৫-৭ বছর বয়সে ঘরোয়া পরিবেশে যত সহজে বাংলা শিখতে পারে, তার পরবর্তী ৫-৭ বছর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েও কিন্তু তত সহজে ইংরেজি শিখতে পারে না। এ থেকেও বোঝা যায় পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতা শিশু মনের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে। নিজের সন্তানকে কে না ভালোবাসে। সন্তানকে ভালোবাসতে গিয়ে যে শিশুটি ‘মা-বাবা’ শব্দটি ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না তাকে কানে মোবাইল ফোন ধরিয়ে বলি ‘নাও তোমার আন্টির সঙ্গে কথা বলো’। হয়তো কান্না থামাতে গিয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও গান দেখাই। কান্না থামে। ভালো, কিন্তু এই শিশুটিই ৫-৭ বছর বয়সে অধীর আগ্রহ নিয়ে মোবাইলে ভিডিও গান দেখে অথচ এই বয়সে মোবাইল ফোন দেখে তার ভয় পাওয়ার কথা। মোবাইল হাত থেকে নিতে গেলে শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করে। বলা হয়ে থাকে, ‘অভ্যাস মানুষের দাস,’ অভ্যাসের দরুণ সময়ের পরিক্রমায় এক সময় মোবাইল-ই হয়ে ওঠে শিশু-কিশোরদের নিত্যদিনের বহুমাত্রিক বিনোদনের সঙ্গী। মোবাইল ছাড়া এ জগত তার কাছে একদম সাদা-কালো মনে হয়। ১২-১৪ বছরের ছেলে বা মেয়ের আজকাল ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থাকে। ইন্টারনেটে তার অবাধ বিচরণ। টাকা দিয়ে মেগাবাইট কিনে। সহপাঠী বা বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারে কোন সাইটে কি পাওয়া যায়। বুঝলাম, ইন্টারনেটে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে কিন্তু আপনার ১৪ বছরের কিশোর বয়সী ছেলে বা মেয়েটি যে ইন্টারনেটের ভাল সাইটগুলো দেখছে এর কোনো গ্যারান্টি কি আপনি দিতে পারেন? আপনার ছেলে বা মেয়ে অর্ধরাত বা সারা রাত জেগে জেগে এফএম রেডিও শুনছে যেখানে ভালোবাসা, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড শব্দগুলো কমন। অথবা কোনো ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে রাত ১২টার পর কথা বলছে, আপনি কি তার খবর রাখছেন? ভয়ঙ্কর কথা হলো, যৌবনের শুরুতে যার ডার্ক সাইটের সর্বত্র বিচরণ। ব্যক্তিগত মোবাইলের নামে যার হাতে ব্লু-ফিল্মের বাক্স, বিকৃত অভিলাসের উত্থানের তার শেষ পরিণতি বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ এমনকি বিভত্স কিছুতে জড়ালেও অবাক হবার কিছু নেই। একটি ঘটনা বলা যাক, ১৯৩০ সালে মি. সিং এবং তার স্ত্রী ভারতের মেদেনীপুর অঞ্চলে নেকড়ে পালিত দুটি মানব কন্যা শিশু উদ্ধার করে মানব সমাজে নিয়ে আসেন। এদের যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তারা কনুই ও হাঁটুর উপর ভর দিয়ে চলত। দু’হাত ও দু’পায়ের ওপর ভর করে দৌড়াত। কাঁচা মাংস খেত। মেঝেতে দিলে চেটে চেটে পানীয় পান করত অথচ গ্লাস থেকে পানি পান করতে পারত না। পোশাক পরানো যেত না এমনকি শীতের সময়ও নয়। পোশাক পরালেই তা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলত। চার বছর অভ্যাস করানোর পর বড় মেয়েটি মাত্র ৬টি শব্দ শিখতে পেরেছিল। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় পরিবেশ বা হাতের কাছের বস্তুগুলো মানব মনকে, বিশেষ করে কচি মনকে কতটা প্রভাবিত করে। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, ফেসবুক শিশু-কিশোরদের জন্য আরেক আতঙ্কের নাম। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে একাধিকবার হয়রানির শিকার হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং এসব কারণে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। ৮১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত সময় দেয় এবং ৮০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো হয়রানির শিকার হয়নি। জরিপটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে এখনও শিশু-কিশোরদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ইন্টারনেট গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রযুক্তির এ যুগে শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা উচিত নয়। তাই বলে প্রযুক্তিতে অবাধ বিচরণের সুযোগ প্রদান করাও ঠিক নয়। দেশে, বিশেষ করে রাজধানীতে খেলাধুলার পরিসর বা খেলার মাঠ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে শিশু-কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রযুক্তিতে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। তারা প্রযুক্তি কোনো কিছু জানা বা শেখার জন্য ব্যবহার করছে কি-না সে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। অবাধ বিচরণের সুযোগ থাকলে শিশু না বুঝে ডার্ক ওয়েবে ঢুকে পড়তে পারে। আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রযুক্তি যেন আমাদের ব্যবহার না করে। বিশেষ করে শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারে। ব্যবহারের শুরু থেকে সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে এটি শুধু খেলার মাধ্যম নয়, বরং জানার মাধ্যমও। এ জন্য অভিভাবকদেরও শিশুদের সামনে প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। দুই বছরের কমবয়সী শিশুদের কোনোভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে দেয়া উচিত নয়। তাদের সামনে প্রযুক্তি পণ্য উন্মোচন করাও উচিত নয়। শিশুর বয়স ৩ থেকে ৫ বছর হলে দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করতে দেয়া যেতে পারে। উন্নত দেশে সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য বেশকিছু প্রযুক্তি বা অ্যাপস রয়েছে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করে এমন দুটি দাতব্য সংস্থা হল চাইল্ড লাইন ও এনএসপিসিসি। এসব সংস্থা শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট জগত তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এমন সংস্থার অভাব রয়েছে। শিশুদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে প্রযুক্তির অবাধ, খোলামেলা, লাগামহীন বিচরণ হতে আমাদের সন্তানদের বুঝাতে বা দূরে রাখতে হবে। নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে। আর এই কাজটি করতে চার দেয়ালের মধ্যের উপাদান অর্থাত্ মা-বাবা-ভাই-বোনকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ডিজিটাল বিশ্ব গড়ে তুলতে গিয়ে যাতে শিশুর জীবন বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। নাগরিক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা ইন্টারনেট ব্যবহার যাতে নিজের সন্তানের জীবন বিপন্ন করে তুলতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে অভিভাবকদেরই। লেখক : কলামিস্ট |