শিরোনাম: |
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
|
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত, হিন্দি এবং ইংরেজি থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তার অনুবাদকৃত গ্রন্থের মধ্যে ‘সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘বেতাল পঁচিশ’ এবং ‘কথামালার গল্প’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এসব ছাড়াও তার রচিত ‘বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ’, ‘বোধোদয়’ এবং ‘আখ্যানমঞ্জুরী’ গ্রন্থখানি আজও বাংলাভাষা গোড়াপত্তনে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। তার রচিত ‘বোধোদয়’ সংস্কৃত কলেজের নিম্ন শ্রেণিতে পড়ানোর জন্য রচিত, যা বর্তমান বাংলা সাহিত্যে অনন্যসাধারণ বলে বিবেচিত। তিনি কবি কালীদাসের রচিত ‘শকুন্তলা’ কাব্যের অবলম্বনে রচনা করলেন বাংলা গদ্যে ‘শকুন্তলা’। এছাড়া শেক্সপিয়রের নাটক ‘কমেডি অব এররস’ এর অনুসরণে লিখলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ এবং রামায়ণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করলেন ‘সীতার বনবাস’। সাহিত্যকর্ম ও সমাজসংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাবিস্তারেও তার অশেষ অবদান রয়েছে। সংস্কৃত শিক্ষার সংস্কার, বাংলা শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন এবং স্ত্রীশিক্ষার পত্তন ও প্রসারে তার প্রয়াস এক অক্ষয় কীর্তি। তিনি শিক্ষাবিস্তারে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন পরের দুঃখে অতি কাতর। মহকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থে লেখাপড়া করেছিলেন। বিদ্যাসাগর সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। সাদাসিদে পোশাকে গায়ে মোটা চাদর এবং চটিজুতা ছিল তার একমাত্র পরিচ্ছদ। বিদ্যাসাগরের আর একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো সমাজ সংস্কারমূলক কাজ। তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ উপস্থাপন করে ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ বিধবা বিবাহের তীব্র বিরোধিতায় মারমুখী হয়ে ওঠেন। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে বিরুদ্ধবাদীদের অপতত্পরতার দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য একই শিরোনামে আরেকটি পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর বিধবা বিবাহ আইন পাস করার জন্য ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি আবেদনপত্র পেশ করেন। এই আবেদনপত্রের সঙ্গে তিনি বিধবা বিবাহ আইনের একটি খসড়াও সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালের ১৭ নভেম্বর রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে বিরোধী শিবির থেকেও সরকারের কাছে বিপরীত একটি আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। ১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর খসড়াটি গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া কাউন্সিলে উপস্থাপিত হয়। বহুবিধ বিচার-বিশ্লেষণের পর ব্যবস্থাপক সভা কর্তৃক বিধবা বিবাহ আইনের খসড়াটি গৃহীত হয়। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই গভর্নর জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি আইনে পরিণত হয়। ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বরে আইনানুসারে প্রথম বিবাহ করেন সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। বিদ্যাসাগরের উপস্থিত ও তত্ত্বাবধায়নে এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে তার নেতৃত্বে বহু বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিদ্যাসাগর নিজ ছেলের সঙ্গে এক বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে আইন প্রচলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। অবশ্য তিনি মায়ের চেয়েও বড় করে দেখেছিলেন লাখ লাখ বিধবা মায়ের দুঃখকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে গেছেন। ১৮৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি এ প্রথার বিরুদ্ধে শাস্ত্রীয় প্রমাণ উপস্থাপন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের স্রষ্টা হিসেবে খ্যাত। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাকে সিআইই উপাধিতে ভূষিত করে। কঠিন পরিশ্রমজনিত কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। শেষজীবনে তিনি বিহারের অন্তর্গত কর্মাটারে কাটান। সাঁওতালদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাকে মুগ্ধ করে। তিনি তাদের অবহেলিত অবস্থা দেখে তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই মহামতি বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ৭১ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তিনি বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করে সমাজ সংস্কারের এক অসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। - বর্তমান ডেস্ক |