শিরোনাম: |
পানিসম্পদ ব্যবহারে নেদারল্যান্ডস উদাহারণ!
|
আমাদের কিছু লোকের সীমাহীন লোভ, শিল্প মালিকগণ কর্তৃক নির্বিচারে কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে নির্গমন এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ক্ষমাহীন অবহেলা ও দখল দূষণের কারণে ইতোমধ্যে অনেকগুলো নদ-নদী হারিয়ে গেছে। এদের অস্তিত্ব আছে শুধু কাগজে কলমে। প্রায় ৭০০টি বিভিন্ন নদী, শাখা নদী এবং উপনদী জালের আমাদের দেশকে ঘিরে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। ভারত, চীন এবং নেপাল হতে উত্পত্তি হয়ে আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদী আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আন্তর্জাতিক নদীসমূহে ভারত এক তরফা বাঁধ নির্মাণ এবং পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া বাহু আগ থেকে শুরু হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উজানে পয়োঃবর্জ্য ও শিল্পদূষণ। আমাদের ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের প্রধান প্রধান নদীগুলো যেমন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ইত্যাদি ইতোমধ্যে দখল দূষণে মৃতপ্রায় হয় গেছে। এ সব নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেন এতই স্বল্প যে, কোনো জলজ জীব এবং অণুজীবের অস্তিত্ব আর এ সকল নদীতে পাওয়া যায় না। ঢাকার ভেতর যে ৬৫টি খাল ছিল দখল বাণিজ্য তার মধ্যে ২২টির এখন আর কোনো হদিস নেই। বাকি ৪৩ টির মধ্যে ২০টি মৃত প্রায়, ২৬টি খাল পুনরুদ্ধারের জন্য ঢাকা ওয়াসা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, মাতামুহুরী, সিলেটের সুরমা যশোরের কপোতাক্ষ এবং দেশের অনেক নদীর পাড় ঘেঁষে স্থাপনা এবং নদীর তীর ভরাটের কারণে নদীসমূহ নাব্য হারাচ্ছে এবং কতিপয় জায়গায় তা ভরাট করে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ে। গবেষকদের মতে ২০৫০ সালের মধ্যে ডুবে যেতে পারে বাংলাদেশ। এর একটি সারণী এভাবে ধারণা করে প্রকাশ করা হয়েছে। যদি পৃথিবীর ভূ ভাগের তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ ০.২৩ মিটার বেড়ে যাবে। যদি ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ ০.৫২ মিটার বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের মতে, জ্তালানি তেলের বিকল্প সন্ধান করা প্রয়োজন। নইলে পৃথিবীর ভূ ভাগের তাপমাত্রা মারাত্মক বেড়ে যাবে। হয়তো তা ৫.৬ ডিগ্রি সেলিসিয়াস হতে পারে। যা আগামী এক’শ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ ২ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রায় ১০০০ বর্গ কিলোমিটার কৃষি জমি পানির নিচে চলে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার-টেকনাফসহ সমুদ্র উকূলবর্তী কিছু এলাকা সাগরে চলে গেছে। এর ফলে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে ১ কেজি ধান উত্পাদনের জন্য প্রায় ৩০০০-৫০০০ লিটার পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি কাজ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের হার হচ্ছে শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ। যদিও নতুন পানি নীতিতে নগর মহানগর গৃহস্থালী এবং সুপেয় পানির ব্যবহারকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তবে কৃষি কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো বিষয়টি এ নীতিতে স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। এখানে এটা অবহেলিত, উপেক্ষিত। অথচ আমাদের জিডিপিতে অবদান প্রায় শতকরা ২২ ভাগ এবং শ্রম শক্তির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এখনো এ খাতে নিয়োজিত। আগামীতে অধিক সংখ্যার জন্য আমাদের খাদ্য উত্পাদন আরো বাড়াতে হবে। তখন এ ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ আরো বাড়বে। কিন্তু কৃষি কাজে ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহারের জন্য কোনো প্রণোদনা বা কর্মযজ্ঞ নেই। দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও বৃষ্টি পানি ধরে তা পুনঃব্যবহারের কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। দেশের উত্তর পঞ্চিমাঞ্চলে টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি এরকম একটা বিপদ সংকেতই আমাদের দিচ্ছে। তাছাড়া অনেক জায়গায় লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় ও নিরাপদ পানি প্রাপ্তির সঙ্কট বিবেচনায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত ও পরিমাণগত অনুসন্ধানসহ ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে লবণাক্ততা অনুপ্রবেশ এবং এর বর্তমান ও ভবিষ্যত বিস্তৃতি মূল্যায়নে সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ চিহ্নিতকরণে স্থায়ী পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন ও গাণিতিক মডেল সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। জানুয়ারী ২০১১ হতে ডিসেম্বর ২০১৪ সময়কাল বাস্তবায়িত উক্ত প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় ১৯ জেলার প্রায় সব উপজেলায় ভূ-গর্ভস্থ পানি তথা পানি সম্পদের পর্যবেক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকল্প হতে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে উপকূলীয় অঞ্চলের পানি সম্পদের পরিমাণ ও গুণগত অবস্থান নির্ণয় ও গাণিতিক মডেল সমীক্ষার মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং এর বর্তমান ও ভবিষ্যত বিস্তৃতি চিহিত করা হয়েছে। তথ্য ও উপাত্তের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ পানি সম্পদের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য পরিবর্তনকে চিহিত করে যুগপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অধিকাংশ এলাকার ভূ-গর্ভস্থ অগভীর ও স্বল্প গভীর (২০০-২৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত) পানিতে মাত্রাতিরিক্ত (ক্লোরাইড ৬০০ মিলিগ্রাম/লিটার এর অধিক) লবণাক্ততার উপস্থিতি ঘটছে। তবে ভূ-গর্ভস্থ গভীর পানিতে ( ২৫০-৩০০) মিটারের অধিক) সাধারণ লবণাক্ততা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে যা যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে দীর্ঘসময় ধরে পানীয় পানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারের উচিত হবে নদীগুলো রক্ষার জন্য আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পদক্ষেপগুলো স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপগুলো হবে নদীর তীর চিহিত করে তা সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, দখলকৃত নদী খাল পুনরুদ্ধার এবং নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হবে বাহুমুখী বাঁধ নির্মাণ জলাধার নির্মাণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর জন্য ভূ-উপরিস্থিতি পানির ব্যবহার কমানো, পানি কর প্রবর্তন, পানির ব্যবহার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তা পুনঃচক্রায়নের প্রযুক্তির প্রসার, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ, শিল্প কারখানার অনলাইন মনিটারিং প্রবর্তন এবং নিয়মিত নদীর ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা- এটা করতে পারলে আমরা আমাদের নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় রক্ষা করতে পারবো। নইলে আমরা একটা পানি বুভুক্ষু দেশ হিসেবে পরিণতি হতে আর বেশি সময় লাগবে না। - লেখক: পরিবেশবিদ |