শিরোনাম: |
নাটক ও বাঙালির সংস্কৃতি
|
![]() কাজেই আবহমান কাল থেকেই নাটকের মাধ্যমে বিনোদন এবং সেই বিনোদনের ভেতর দিয়ে শিক্ষণীয় কিছু পৌঁছে দেয়া হয় সাধারণ মানুষের কাছে। যখন সমাজে যে অবস্থা বিরাজ করে তখন সেই সমসাময়িক বিষয় নিয়েই নাটক তৈরি করা হয়ে থাকে। নাটকের বিষয়ে তাত্ত্বিক কিংবা একাডেমিক কোনো কিছু নিয়ে আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো একজন সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ দর্শক হিসেবে নাটককে মূল্যায়ন করা। আর সেটি করতে গিয়ে অনেক বাস্তব চিত্রের উদাহরণ এখানে আসতে পারে যা নাটক ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ভাবনার সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষের ভাবনা মিলে যেতে পারে। গ্রামাঞ্চলে আমরা দেখেছি, শীতকালে অর্থাত্ প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে প্রত্যেকটি এলাকায় গ্রামের একদল তরুণদের উদ্যোগে নাটক করা হতো। সেটা করার জন্য কোনো পেশাদারি শিল্পীর প্রয়োজন হতো না। সে নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভেতর যে যা করতে পারে, সেভাবেই মাসাবধি রিহার্সাল করে একটি নাটক নামিয়ে ফেলা হতো। সেখানে কোনো একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কাহিনী সংবলিত নাটককেই বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হতো। কারণ তাহলে জোরে জোরে কণ্ঠ উচিয়ে গলা ফাটিয়ে অভিনয় করতে পারত, যা গ্রামের মানুষেরা দেখতে এবং উপভোগ করতে খুবই পছন্দ করতে দেখা যেত। যে মৌসুমে নাটকটি করা হতো সেটি করার জন্য আগে থেকেই গ্রামময় চুঙ্গা ফুকিয়ে, মাইক মেরে প্রচার চালানো হতো। নাটকের সময় একেবারে দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। এ বিষয়ে আমি আমার নিজের ব্যক্তিগত দুয়েকটি অভজ্ঞতার বর্ণনা করতে পারি পাঠকদের সঙ্গে। আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ১৯৮৭ সালে। পরীক্ষার ফলাফল বেরোনোর আগে ৩-৪ মাস সময় অলস হিসেবে কাটাতে হয়। সেই সময় আমাদের গ্রামেরই এক নাট্যপ্রেমিক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাদের বন্ধুদের প্রস্তাব দিলেন একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য। আমরা প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ তখন নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা ইত্যাদির অনেক সুদিন। যেদিকেই যাওয়া যেত, দেখা যেত সুন্দর সুন্দর বড় বড় আর্ট করা ছবি দিয়ে সিনেমার পোস্টার রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিংবা হাটে-বাজারে জনবহুল স্থানে লাগানো থাকত। সুযোগ পেলেই সব বন্ধুরা মিলে সেসব সিনেমা দেখতে চলে যেতাম সিনেমা হলে। সেভাবে যাত্রপালা কিংবা এ-গ্রাম, ও-গ্রামে নাটক দেখতে যাওয়া হতো সুযোগ পেলেই। এসব নাটক, যাত্রাপালা ও সিনেমা দেখতে দেখতে তখন নিজের মনের মধ্যে নায়ক নায়ক ভাব চলে আসত। মনে হতো যদি কোনো একদিন একটি নাটকে, কিংবা সিনেমায় কোনো একটি চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো। সারাদেশের মানুষ এক ডাকে ও নামে চিনত আমাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেজন্যই আমাদের স্কুলের স্যারের নাটক করারা প্রস্তাবে সাগ্রহেই রাজি হয়ে যাই। পরে আমরা সেই নাটকটি করতে গিয়ে সবাই মিলে এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে প্রায় প্রতিরাতেই শীত উপেক্ষা করে অনেক দূরের একটি স্কুলে রিহের্সাল করতে চলে যেতাম। তারপর প্রায় ২-৩ মাস রিহের্সাল করে আসল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। আমরা নাটকের আগে এলাকার মানুষের কাছ থেকে নাটকটি মঞ্চস্থ করার খরচ মেটানোর জন্য চাঁদা উঠালাম। আর সে সময় এ রকম অনুষ্ঠানাদি দেখার জন্য মানুষ খুবই উদগ্রীব থাকত। সেজন্য আশপাশের প্রত্যেকেই এর জন্য যার যার সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ করতে সহাযোগিতা করেছিল। আমরা নাটক করলাম। অনেক দর্শক হলো। মানুষ মজা পেল এবং অন্তহীন প্রশংসাও করেছিল তখন। ভালো কিংবা খারাপ হয়েছিল কিনা জানি না, তবে এতে যে সবাই মজা করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৮৭ সাল। এখন থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। কিন্তু সেসময় এ সামান্য স্কুল-কলেজ পড়ুয়া পাড়ার কয়েকজন তরুণের নাটক দেখার জন্য যেভাবে গ্রামীণ মানুষের ঢল নেমেছিল, যা কখানো ভুলবার নয়। কিন্তু তখন তো কোনো ধর্মেরই কোনো ক্ষতি হয়নি। সেজন্য জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডরে কোনো ভয় করতে হয়নি আমাদের। যতই দিন যায় ততই নাকি একটি জাতি শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে ধীরে ধীরে সভ্য হয়। কিন্তু তিন দশক পড়ে এখন আর গ্রামাঞ্চলে তো এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাই করা যায় না। উপরন্তু শহরাঞ্চলে এমনকি খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে হলেও এখন সেখানে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হয়। চিন্তা করতে হয় যে, সেখানে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হয় কিনা। আজ কোথায় এসে ঠেকেছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মনে হচ্ছে মাত্র তিন দশক আগেও যা হয়েছে, এখন তা কেবলই স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। আরেকটি মধুর স্মৃতি হলো রাত জেগে যাত্রাপালা দেখা। প্রতিবছর শীতকালে প্রতি জেলা-উপজেলায় যাত্রাপলা আয়োজন করা হতো। মাসাবধি সেসব যাত্রাপালাকে কেন্দ্র করে সেসব স্থানে মেলাও বসত। সেসব মেলায় গুড়ের তৈরি জিলাপি, হাতে ভাজা মুড়ি, মুড়ির নাড়ু, বিভিন্ন ধরনের খেলার মধ্যে হাউজি কিংবা জুয়া খেলাও বাদ যেত না। আমরা বন্ধুরা মিলে সেসব যাত্রাপালা দেখার জন্য রাতের বেলায় পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে চলে তোম সেসব যাত্রাপালা প্যান্ডেলে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা, রূপবান, গুনাই বিবি, মধুমালা, মুগল সম্রাট আকবর ইত্যাদি চমকপ্রদ প্রেমের এবং ঐতিহাসিক সব কাহিনী নিয়ে বাঁধা হতো সেসব যাত্রাপালা। একদিন যাত্রাপালা দেখে এসে পরেরদিন স্কুল কিংবা কলেজের ক্লাসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার মধুর সেসব স্মৃতিগুলো ভুলা কঠিন। কিন্তু আজ কোথায় সেসব দিন! শহরে কিংবা গ্রামে কোথায়ও এখন আর সেসব অনুষ্ঠানাদি হতে দেখা যায় না। যেসব লোক যাত্রার দল সৃষ্টির মাধ্যমে যাত্রাপালা করে তাদের রোজি-রোজগারের ভেতর দিয়ে দিনাতিপাত করতেন, এখন তা আর নেই। দেশে এখন আর নতুন কোনো যাত্রা শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে না। শেষ হয়ে গেছে পুরাতনগুলোও। একদিকে সিনেমা হলগুলো পরিবর্তন করে ভেঙে দিয়ে বড় বড় শপিংমল করে ফেলা হয়েছে, অপরদিকে সেসব গ্রামীণ পরিবেশের যাত্রার দলেরও এখন আর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। অথচ এক সময় এটি একটি বড় শিল্প ছিল। এতে কাজ করত হাজারো মানুষ। জীবিকা নির্বাহ করতেন দেশের সংস্কৃতিবান অনেক মানুষ। তারপর একটা সময় ছিল, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। যারা গান, নাটক, নাচসহ সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার বিষয়গুলোকে প্রশিক্ষক হিসেবে শিখিয়ে তা দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মধ্যে অনুষ্ঠানাদি করে বেড়াত। এখন অবশ্য সরকারিভাবে জেলাপর্যায়ে যেসব শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমির শাখা রয়েছে, সেখানেও সব বয়সের ছাত্রছাত্রীরা তালিম নিতে দেখা যায়। তখন নাটকের দল গঠন করে সেখানে পাড়ার ছেলেমেয়েরা নাটকের রিহের্সাল দিয়ে সেই নাটক সময়মতো মঞ্চস্থ করত। কিন্তু আগেই বলেছি, এখন গ্রামীণ পর্যায়ে সেসব আর নেই। কারণ গ্রামীণ মানুষও এখন আগের মতো এতো স্বতঃস্ফূর্ত নেই। তাদের শহরমুখী হওয়া ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যাঁতাকলে পড়ে জড়িয়ে আছে কঠিন জীবনের মুখোমুখি। সেখানেও লেগেছে নানামুখী উন্নয়নের ছোঁয়া। মানুষ আগের তুলনায় অনেকবেশি ব্যস্ত ও কর্মচঞ্চল। কাজেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করার জন্য সময় ও সুযোগ কোনটিই পর্যাপ্ত নেই তাদের জন্য। সে কারণেই গ্রাম থেকে সেসব প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত নাটক এখন আর পাওয়া যায় না। তখনকার সময়ে নাটকের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। যারা এসব নাটক করতেন তারা স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীচী, পিলসুজ, শতাব্দী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই মূলত শিক্ষা লাভ করতেন। অপরদিকে যাত্রাপালা, সিনেমা দেখা, রেডিও-টেলিভিশনে নাটক শোনা ও দেখার বিষয়টিই অন্যতম ছিল। আর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল রাজধানীতে নাট্যকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত নাটক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য। রাজধানীর মহিলা সমিতির গাইড হাউস মঞ্চ ছিল এদের মধ্যে অন্যতম। এখন অবশ্য ঢাকাতে আরও কিছু ভালো মঞ্চ তৈরি হয়েছে- যার মধ্যে শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চটি অন্যতম। যা বলছিলাম, তখন যেহেতু নাটকের জন্য তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না, সেজন্য এসব মঞ্চ এবং এগুলোতে তখন যারা অভিনয় করতেন, নাটক লিখতেন, নির্দেশনা দিতেন তারাই ছিলেন মূলত ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে একেকজন প্রতিষ্ঠান। আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, ফেরেদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান, হুমায়ূন ফরীদি, আফজাল হোসেন, তারিক আনাম খান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, নিমা রহমান, সারা যাকের, ড. ইনামুল হক, লাকী ইনাম প্রমুখ। এরকম আরও অনেক না বলা যাবে যারা তখন নিজেকে ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তখন তিনটি মাধ্যমে নাটক প্রচার ও প্রদর্শন করা হতো। মঞ্চ, রেডিও ও টেলিভিশনে। মঞ্চ একটি প্রতিষ্ঠান হলেও মূলত সাধারণ দর্শক স্রোতাদের জন্য রেডিও ও টেলিভিশন নাটক খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে তখন থেকে। কারণ সাধারণ সব মানুষ তো আর ঢাকায় এসে মঞ্চ নাটক উপভোগ করত পারত না। সেসময় রেডিও একটি সর্ব সাধারণের গণমাধ্যম ছিল। আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে সবারই অন্তত একটি করে রেডিও সেট ছিল। রেডিওতে প্রায়শই নাটকের জন্য নির্ধারিত কিছু অনুষ্ঠান থাকত। সেখানে দেশি-বিদেশি ধারাবাহিক নাটকও তখন প্রচার করা হতো। আমার স্মৃতিতে রয়েছে, আর্থার কোনান ডায়েলের গোয়েন্দা কাহিনীভিত্তিক নাটক সিরিজ আকারে আমিও রেডিওতে শুনেছি। সেখানেও আসকার ইবনে শাইখ, সৈয়দ শামসুল হক, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ প্রমুখ নাট্যকারদের লেখা নাটকে তারা নিজেরাসহ উপরে উল্লেখিত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে গোলাম মোস্তফা, সুবর্ণা মোস্তফা, আয়েশা আক্তারসহ আরও অনেকে কণ্ঠ দিয়েছেন অভিনয়ে। কাহিনী ও সময়ের বাস্তবতায় সেসব দিনের নাটকের সংলাপ এখনও কানে বাজে। একই সময়ে নব্বইয়ের দশকে এসে টেলিভিশন নাটক খুবই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে খাকে। সেখানে ড. সেলিম আল দীন, ড. হুমায়ূন আহমেদ, আতিকুল হক চৌধুরী, ইমদামুল হক মিলন, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো লেখকগণ টেলিভিশন নাটকে সৃষ্টি করেন একটি নতুন ধারা। তাদের নাটক যখন টেলিভিশনে প্রচার হতো দর্শকপ্রিয়তার কারণে তখন রাস্তায় কোনো মানুষ থাকত না। কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, ঢাকায় থাকি, এসব দিনরাত্রি, শুকতারা, গ্রন্থিকগণ কহে ইত্যাদি ছিল তখনকার নামকরা সব নাটক। তখন বিটিভিই ছিল দেশের মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা। তারউপর প্রতিসপ্তাহে বড়জোড় দু’দিন এসব ধারাবাহিক কিংবা সাপ্তাহিক নাটক প্রদর্শন করত। তারপরও সবাই সেই নাটকের স্বাদ নেয়ার জন্য ঘরে ঘরে বসে যেত টিভি সেটের সামনে। সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি সেসব নাটক নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কাহিনীর আকস্মিকতা, বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে সবারই ছিল পছন্দের তালিকায়। কিছু কিছু নাটকের কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরে। দেখা গেছে একসময় বাংলা সিনোমার মধ্যে অশ্লিলতা ঢুকে যেতে থাকলে, তখন টেলিভিশন নাটকই বিকল্প হতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশের সরকারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম নাটকের উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা করা হয়। অধ্যাপক মোস্তফা নূর উল ইসলাম, নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন এসব উদ্যোগের কৃতিত্বের দাবিদার। সেখান থেকে দেশের নাট্যান্দোলনের সঙ্গে অনেকে শরিক হয়েছেন। সেই প্রতিষ্ঠানের দেখাদেখি পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও চলচ্চিত্রের উপর প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা শুরু করেছে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশালে স্থাপিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা অগ্রগামী। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটি শুরুর দিকেই নজরুলের সাহিত্য শাখার বিশেষ অংশ হিসেবে নাট্যকলা বিভাগটি চালু করে। তারপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথসহ আরও অনেক বেসরকারি বিশ্বদ্যািলয়েও নাটকের উপর উচ্চশিক্ষা কিংবা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। তবে এ পর্যায়ে এসে বলা যায়, দেশে নাট্য আন্দোলন ও নাট্য চর্চার জন্য যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এক সময় চিন্তা করা হতো নাটকের মতো এমন একটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে কীভাবে একজন শিক্ষার্থী তার ক্যারিয়ার শুরু করতে পারে। কিন্তু এখন এ ফিল্ডে কাজ করার বিস্তর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন অবাধ মিডিয়ার যুগ। দেশে প্রায় ত্রিশোর্ধ্ব বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে। এসব চ্যানেলে শুধু নাটক ছাড়াও বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি, ডকুমেন্টারি, নাটিকাসহ অনেক জনসচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। কাজেই সেসব স্থানে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে নাটক অনেক সমৃদ্ধ হলেও সেটি প্রদর্শনের জন্য যে টেলিভিশন মাধ্যম রয়েছে সেখানে বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনা একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেখানে বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় সেগুলো দর্শকরা ঠিকমতো দেখতে পারছে না। কারণ একটি নাটক শুরু হলে বারবার বিজ্ঞাপন বিরতি এবং বিরতি থেকে ফেরার নির্দিষ্ট কোনো সময় না থাকায় ভালো হলেও দর্শকরা সেসব দেখা থেকে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে এসব নাটকের স্থান দখল করে নিচ্ছে ভারতীয় বিভিন্ন বাংলা ও হিন্দি চ্যানেল। এখন ডিজিটাল যুগে টিভি চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণ দর্শকদের আঙ্গুলের মাথায় একটি রিমোটের উপরে। ইচ্ছা না হলে কিংবা বিরক্তির কোনো কারণ থাকলে একটি চ্যানেল পরিবর্তন করতে এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। আগেই বলেছি নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার। এটি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিরও ধারক-বাহক। এখন আকাশ সংস্কৃতির যুগে সহসাই কোনো কিছু থেকে যেমন বিরত থাকা যায় না, আবার বিরত রাখাও যায় না। সেজন্য ভারতীয় যেসব চ্যানেল বাংলাদেশে অবাধে চলছে সেগুলো ইচ্ছা এবং চেষ্টা করলেই বন্ধ করে দেয়া যাবে এমন নয়। এটি যেহেতু একটি শিল্প, কাজেই এখানে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়টিও সমানভাবে জড়িত। আর যেখানে ব্যবসা সেখানে একটি প্রতিযোগিতার বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। কাজেই এগুলোর বিকল্প কিছু করতে চাইলে অবশ্যই আমাদের একটি প্রতিযোগতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে এ শিল্পে বর্তমানে বিরাজমান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবিলা করার যথাযোগ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমানে যদি আমরা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের দৌরাত্ম্য মোকাবিলা করতে চাই, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের বের করতে হবে। এর মধ্যে যেমন বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনা একটি বড় বিষয়। তাছাড়া নাটকগুলোর মধ্যে আনতে হবে বৈচিত্র্যতা। কারণ কাউকে অনুসরণ করার জন্য নয়। আমরা ভারতীয় সিরিয়ািলগুলোর মাধ্যমে আমাদের দেশের দর্শকদের পছন্দসই একটি চাহিদা পাওয়া গেছে। একে ভিত্তি করেই পরবর্তীতে আমরা এভাবেই চিন্তা করলে সুফল হতে পারে। অপরদিকে এখন আবারও যাত্রাপালা, মঞ্চ নাটক, সিনেমা এগুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এগুলো থেকে আমরা সরে আসার কারণেই এখন তরুণ সমাজের মাঝে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে তাদের সহজেই ধর্মের কথা বলে অহেতুক ভয় দেখিয়ে ভুল পথে চালিত করতে পারছে। কাজেই এখন আবারও আমাদের আগের মতো করে প্রতি জেলা-উপজেলায় এমনকি পাড়া-মহল্লায় সেই রকম নাট্যশালা তৈরি করে নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ বিনোদন ছাড়া কোনো জাতি বাঁচতে পারে না। মানুষ যখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদন পাবে তখন তাদের জাতি হিসেবে গড়ে উঠা আরও সহজ হবে। এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলেই বাঙালির বাংলাদেশ একটি সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে, যেখানে কাউকেই যে কেউ ইচ্ছা করলে বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না। আমরা সেরকমই একটি সংস্কৃতিবান জাতিই প্রত্যাশা করি। আর অতীতে বহুবার সেটা প্রমাণ হয়েছে যে, তা কেবলামাত্র নাট্যান্দোলনের মাধ্যমেই করা সহজতর। লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |