শিরোনাম: |
গণপরিবহনে নারী ভোগান্তি
|
বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা অনেক বেড়েছে। সে সঙ্গে বেড়েছে নারীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং সহযোগিতাও। তারপরও নগরীতে বসবাসরত কয়েক লাখ নারীকে প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলে যাওয়া ও আসার পথে পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে। যার অন্যতম একটি নগরায়নের গণপরিবহন। জানা গেছে, গণপরিবহনে প্রতিনিয়তই নানাবিধ অসুবিধা ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছে নারী যাত্রীরা। সরকারি-বেসরকারি বাসগুলোতে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া ছোট ছোট যে গণপরিবহনগুলো রয়েছে তাতে চড়তেও নারীদের পড়তে হয় বাড়তি বিড়ম্বনাতে। রাজধানীর বাসাবো থেকে গতকাল শাহবাগের উদ্দেশ্যে বাহন পরিবহনে উঠলেন হাসি নামের এক নারী। তিনি এ প্রতিবেদককে জানালেন, এই রুটে পর্যাপ্ত গাড়ি না থাকায় উপায় অন্তর না পেয়ে বাহন বা মিডওয়েতে এই এলাকার সবাইকেই আসতে হয়। তবে নারীদের এই সব গাড়িতে উঠতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আর কিছু দুষ্টু মানুষ রয়েছেন যারা সুযোগে কুকাজ করে থাকেন। হুরোহুরি ও ধাক্কাদাক্কিতেও এই সব গাড়িতে অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। এই চিত্র শুধু বাসাবোতেই নয়, এটা পুরো রাজধানীরই চিত্র। বাসগুলোতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি সিট বরাদ্দ থাকে যা কিনা অপ্রতুল। তাছাড়া ওই আসনগুলো আবার অনেকটাই গাড়ির ইঞ্জিনের কাছাকাছি থাকায় প্রচণ্ড গরম ওধায়ায় আছন্ন থাকে বিধায় নারীদের শাসকষ্টসহ নানাবিধ অসুখ হয়ে থকে। অনেক সময় এসব অস্বাস্থ্যকর সংরক্ষিত আসনগুলোও পুরুষ যাত্রীদের দখল থেকে উদ্ধার করতে নারীদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আসন না থাকলে নারীদের বাসে না উঠাতে চালক ও চালকের সহকারীদের নির্দেশও দেন কোনো কোনো যাত্রীরা। সংরক্ষিত নয়টি আসন ছাড়া অন্য আসনে বসলেও অনেক পুরুষযাত্রী তর্কবিতর্ক, বিদ্রূপ শুরু করেন। যানবাহনে ওঠার ক্ষেত্রে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা খুব একটা নজরে পড়ে না। এমনকি কখনো কখনো চালক আর সহকারীরা নারী আসন থাকলেও অনেক সময় তাদের বাসে উঠতে দিতে চায় না। বিশেষ করে ব্যস্ত কর্মঘণ্টাগুলোতে কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে গণপরিবহনে জায়গা করে নিতে হয়। পুরুষদের পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠা, দাঁড়িয়ে বা বাসের পা-দানিতে ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে নারীদের। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানারকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা। বাসে ওঠা-নামার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে লাগছে চালক সহকারীর হাত। কিছু পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করে নারী যাত্রীদের গায়ের ওপরে পড়ে যান কিংবা অপ্রয়োজনে গায়ে হাত দেন। বাসের পিছনে ফাঁকা থাকলেও সামনের দিকে নারী আসনগুলোর পাশে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং চালক সহকারীরা পেছনে যেতে বললে তাদের বাজে ভাষায় গালাগালিও করেন অনেকে। তবে ছোট পরিবহনগুলোতে নারী ভোগান্তির চিত্রটা একটু কম। তারা নারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই বের হবার দরজার সঙ্গে তাদের বসার জায়গা করে দেয়। এতে ভেতরের দিকে বসা যাত্রীদের আগে নামতে হলে নারী যাত্রীদের উপর দিয়ে নামা ছাড়া উপায় থাকে না। এই বোরিংটুকুই পোহাতে হয় । ২০১৪ সালের অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নিরাপদ নগর কর্মসূচির ভিত্তিমূলক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ শতাংশ নারীর বাসের চালক বা ভাড়া আদায়কারীর মুখে অবমাননাকর ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যৌনহয়রানি বা সহিংসতা এড়াতে কৌশল হিসেবে জরিপে অংশ নেয়া নারীদের ১৩ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন বলেও জানান। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে ঢাকাতে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল আট হাজার। নানা সমস্যা এবং নতুন নিয়মের কারণে ২০১৫ সালে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজারে। এদিক থেকে গণপরিবহনে নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের সংখ্যা কমে এসেছে। গণপরিবহনের সংখ্যায় স্বল্পতা থাকায় দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এসব ঝঞ্ঝাটের কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারিভাবে পরিচালিত বিআরটিসি নারীদের বাস সার্ভিসের সেবা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়, বরং এ সেবা রাজধানীতে বসবাসকারী সিংহভাগ নারীর কাছে রীতিমতো অদৃশ্য। প্রসঙ্গত, নারীদের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) ১৯৯০ সালে প্রথম ঢাকা শহরে দুটি রুটে নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় মাত্র ৮ মাস পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে তা আবার চালু হয়। বিআরটিসি তথ্যমতে, বর্তমানে রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কপথে মোট ৮টি বাস নারীদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। মতিঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন রুটে নারীদের জন্য এ বাস চলছে। - চারুলতা প্রতিবেদক |