শিরোনাম: |
খাল দখল ও জলাবদ্ধতা
|
![]() নগরের খালগুলো তো রাঘববোয়ালদের দখলে আছে। এগুলো দখলমুক্ত করে এ সাধ্য কার? তাই যে যাই বলি, নিরাশার কথা এই যে, নগর জীবনের জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ সহসাই লাঘব হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে, সক্রিয় হতে হবে, শক্তিশালী হতে হবে, সত্সাহস নিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই নগরজীবনের জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ লাঘব হবে। রাজধানী ঢাকা এবং দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহানগর বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সামান্য বৃষ্টিতেই স্থবির হয়ে পড়ছে কর্মব্যস্ত এই দুই শহরের জনজীবন। শুধু যে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, সেই সাথে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। গত দেড়-দুই দশকে অনেক আশার বাণী শোনানো হয়েছে এই দুই নগরের বাসিন্দাদের। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ জলাবদ্ধতাকে সারাদেশের বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো উপায় নাই। তবে সামগ্রিক বিচারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নগরীর অবস্থা যে খুবই উদ্বেগজনক তা অনস্বীকার্য। আমরা আশা করি, সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহল বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন এবং স্থায়ীভাবে নগরবাসীর দুঃখ লাঘবে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা যারা নগরে বাস করি তারাও সচেতন নই। রাজধানী এবং বন্দরনগরীর সৃষ্ট জলাবদ্ধতার পেছনে দায়ী বিষয়গুলো সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানি, বুঝি এমনকি নিয়মিত দেখিও। কিন্তু কারো মধ্যে সচেতনতা কাজ করে না। ফলে দেখা গেছে, এখনও মানুষ ঘরের জানালা দিয়ে পলিথিনের ব্যাগে করে রাতের আঁধারে ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে, যেগুলো গিয়ে স্থান নেয় কোনো পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ কিংবা নালার মুখে। এতে পানি নিঃসরণের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক কারণ বলা যেতে পারে ভবন তৈরির উপকরণগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার ওপর। তারপর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা। কয়েক দিন টানা বৃষ্টির ফলে পানি সরতে না পেরে জল-কাদায় একাকার হয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। আছে ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনাও। টানা বৃষ্টির ফলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। আর এতে করে বাসা-বাড়ি থেকে বের হয়েই ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। বিশেষ করে যারা সকালে অফিসে যেতে বের হন, তারা পড়ছেন মহাবিপাকে। সামান্য বৃষ্টিতে নগরীর অনেক রাস্তাই পানিতে তলিয়ে যায়। টানা বৃষ্টি, তার ওপর জলাবদ্ধতায় বিভিন্ন রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে অসহনীয় যানজটের। রাজধানীর মৌচাক-মালিবাগ এলাকাসহ কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর, বেইলি রোড, মগবাজার, রাজারবাগ এলাকা ছাড়াও অনেক রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যাওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া ফুটপাতেও পানি জমে গিয়ে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। এর মধ্যে নগরীর অনেক জায়গায় চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর ফ্লাইওভারের কাজ। বৃষ্টির পানিতে ওসব জায়গা কর্দমাক্ত হয়ে চলাচলে আরও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। বৃষ্টির কাদা পানি আর বেহাল রাস্তাঘাট বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রা। বর্ষাকাল চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগরীর জনগোষ্ঠীর জন্য যেন এক মহা দুর্ভোগের কাল হিসেবেই আবির্ভূত হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নগরবাসীকে জলাবদ্ধতাজনিত কষ্ট থেকে রেহাই দিতে এখনও কোনো আন্তরিক উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু এসব সেবাদানকারী সংস্থার কিছু তত্পরতা জলাবদ্ধতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান প্রধান সড়কসহ অলি-গলি কোমর ও হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, একটানা ভারি বর্ষণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে পানি জমে ডুবে যায় নগরের প্রায় রাস্তাঘাট। প্রায় সব রাস্তায় হাঁটুপানি। কিছু কিছু এলাকা কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক এলাকায় বাসা-বাড়ির নিচতলা ও দোকানে পানি ঢুকে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। সিডিএ’র অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সিটি করপোরেশনের খালগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার না করা এবং নালা-নর্দমার ময়লা অপসারণে ব্যর্থতাই এই দুর্দশার প্রধান কারণ। নগরে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হওয়ার জন্য মূল খাল রয়েছে ১৬টি। কিন্তু নগরের প্রাথমিক ১৬টি খালের সব কয়টির অধিকাংশ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বেদখল হয়ে গেছে। এছাড়া এসব খাল সময়মতো সংস্কার ও খনন করা হয়নি। কিছু কিছু খালের মাটি তোলা হলেও তা রাখা হয়েছিল পাড়ে। পরে বৃষ্টির পানিতে ওই মাটি আবার খালে পড়ে। নগরীতে ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে এমনিতেই বহু নালা-নর্দমা খাল ভরাট হয়ে গেছে, তার উপর সংস্কার নেই পুরনো খাল ও নালার। পানি ধারণক্ষম বহু পুকুর ভরাট করে দালানকোঠা ও দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারছে না। সহজে পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় ভারি বৃষ্টিতে হঠাত্ এমন জনদুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো উন্মুক্ত রাখলে এ জন-দুর্ভোগের সৃষ্টি হতো না। এ বিষয়ে ডিসিসি ও চসিকসহ সংশ্ল্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, পুকুর-জলাশয় নদী-নালা ভরাট ও বেদখল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের খাল দখলের প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের প্রধান খাল চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশ ভূমিগ্রাসীদের দখলে চলে যাওয়া এবং ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া। তাছাড়া, বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে তেমন বাধা না থাকায় পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিব্যাগে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো মহানগর। পলিথিনগুলো নালা-নর্দমা ভরাট করে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি করে। যতটুকু দেখা যায়, ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য এখনও কিছু কম। চট্টগ্রামে এখনও কিছু খাল রয়েছে যেগুলো পুনঃখনন করলে হয়তো সেগুলো পুরনো চেহারায় ফিরে আসতে পারে। আর উন্নয়নবিদ-পরিকল্পনাবিদরা যদি দয়া করে ড্রেনেজের বিষয়টা ভাবেন তাহলে পরিস্থিতি রক্ষা পেলেও পেতে পারে। যে কোনো মূল্যেই হোক এ পরিস্থিতি নিরসন করতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ঢাকার সব খাল ও ঝিল আমরা অনেক আগেই ভরে ফেলেছি। প্রভাবশালীরা যে যা পারে দখল করেছে। প্রাকৃতিক বা মুঘল আমলের খনন করা খাল ভরাটের ঢাকার পরম সম্পদ চারটি নদীও দখলে-দূষণে শেষ হওয়ার পথে। পৃথিবীর বহু দেশে নগরায়নের পরও নদীরক্ষা ও নিষ্কাশন সুব্যবস্থার নজির আছে। তাহলে আমরা কেন পারছি না? এজন্য আমাদের সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, ওয়াসা প্রভৃতি সংস্থারও দায়ভার আছে। তবে এসব সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয়ের দরকার আছে। ‘নগর সরকার’ বিষয়টি নিয়ে বহু বছর ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু নগর সরকারে দেখা মিলছে কৈ? নগর সকরার গঠন করে জলাবদ্ধতাসহ নগরীর সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে, নদী, খালগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। তাহলেই নগরের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হবে। লেখক: কলাম লেখক |