শিরোনাম: |
রুপালি ইলিশে আশার ঝিলিক
|
![]() ‘ডিমওয়ালা ইলিশের বিশেষ স্বাদ’ নেয়ার লোভ পরিত্যাগের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ক্রেতার মন-মানসিকতায় আসেনি পরিবর্তন। বর্তমানে বার্ষিক যে ৪ লাখ টন ইলিশ উত্পাদিত হচ্ছে, ভারতের মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের ধাক্কা না থাকলে পদ্মা নদীতেই আহরণ বেড়ে যেত আরও ২ লাখ টন। উত্পাদিত জাতীয় মাছ ইলিশের সরাসরি বাজার মূল্য বর্তমানে অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা। তবে লাখো জেলেসহ বিভিন্ন স্তরে মানুষের কর্মসংস্থান মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ইলিশের অব্যাহত বংশবৃদ্ধি ও আহরণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সর্বত্র প্রান্তিক জেলে পরিবারগুলো খুশি। তবে ইলিশের খাতেও একাধিক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালে অর্থাত্ যৌক্তিক পর্যায়ে কখনোই নামে না। প্রকৃতির এই উদার দান যা বাংলাদেশের জন্য অনন্য এক সম্পদ সেই চকচকে রূপালি ইলিশের দিকে পড়েছে বিদেশি মাছ-লুটেরাদের লোভাতুর শ্যোন দৃষ্টি। ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের চোরা শিকারি ও চোরাকারবারিদের মাধ্যমে ইলিশ পাচার থামেনি। এ ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি ও টহল তত্পরতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে গেল কয়েকদিন আগে দেশে পালিত হয়ে গেল জাতীয় মত্স্য সপ্তাহ-২০১৭। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘মাছ চাষে গড়বো দেশ বদলে দেব বাংলাদেশ।’ চার দশকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ইলিশের উত্পাদন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ৪শ’ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। এ বছর তা ৪ লাখ অতিক্রম করবে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৮৭-৮৮ সালে বাংলাদেশে ইলিশের উত্পাদন ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার টন। তখন থেকে ১১ বছর যাবত ইলিশের উত্পাদন ২ থেকে আড়াই লাখ টনে সীমিত থাকে। এমনকি ২০০২-০৩ সালে উত্পাদন দেড় লাখ টনেরও নিচে নেমে আসে। জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে তা রোধকল্পে চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেন। তখন ইলিশ রক্ষা ও উত্পাদন বাড়াতে সরকারি তোড়জোড় চলে। জাটকা ও মা মাছ ধরা বন্ধকালীন সময়ে বেকারত্ব বিবেচনায় রেখে জেলেদের মাঝে বিনামূল্যে চাল বিতরণ, নগদ সহায়তা, সচেতনতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ পরীক্ষামূলকভাবে এগিয়ে চলে। আর ধীরে ধীরে এর সুফল আসতে থাকে। এই সাফল্যের পথ ধরে উপরোক্ত সহায়তা ও প্রণোদনামূলক উদ্যোগ আরও বিস্তৃত করা হয়। মত্স্য অধিদফতর এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, পৃথিবীর মোট আহরিত ইলিশের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশের। দেশের নদ-নদী, খাড়িতে আহরিত মোট মাছের ১২ শতাংশই হচ্ছে ইলিশ। বিগত ২০০০-০১ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন, ২০০১-০২ সালে ২ লাখ ৯ হাজার ১২১ টন, ২০০২-০৩ সালে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টন ইলিশ উত্পাদিত হয়। এরপরই ইলিশ সংরক্ষণ বিশেষত জাটকা নিধন ও মা মাছ সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিগত ২০০৮-০৯ সাল থেকে ইলিশের উত্পাদন ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন, ২০০৯-১০ সালে ৩ লাখ ১৩ হাজার টন, ২০১০-১১ সালে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন, ২০১২-১৩ সালে ৩ লাখ ৫১ হাজার টন, ২০১৩-১৪ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন, ২০১৪-১৫ সালে ৩ লাখ ৮৫ হাজার এবং ২০১৫-১৬ সালে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। বিদায়ী ২০১৬-১৭ সালে ইলিশের উত্পাদন ৪ লাখ টন অতিক্রম করার কথা। সমুদ্রসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে ফারাক্কা বাঁধের গুরুতর বিরূপ প্রভাবে পদ্মায় ইলিশের উত্তম বিচরণ ও প্রজনন এলাকাগুলো গেছে হারিয়ে। স্বাধীনতা লাভের গোড়াতে পর্যন্ত দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ইলিশ পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কুমার, ধলেশ্বরী, গড়াই, পায়রা, চিত্রাসহ সংলগ্ন নদ-নদী থেকে আহরণ করা সম্ভব ছিল। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মাসহ অনেক নদীতে চর পড়ে ভরাট এবং নানামুখী বিপর্যয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও মোহনায় ইলিশের আনাগোনা কমতে কমতে প্রায় ফুরিয়ে গেছে। তবে সংরক্ষণ নীতির সাফল্যের কারণে বিভিন্ন নদ-নদী, সাগর ও উপকূলে ইলিশের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে বাড়ছে ক্রমাগত ইলিশ শিকার। বর্তমানে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে সাগরের বিচরণশীল এলাকাগুলোতে। যা নতুন করে আশা জাগিয়ে তুলছে। স্বাদে গন্ধে গ্রহণযোগ্যতায় রুপালি ইলিশের জুড়ি নেই। সরকার কর্তৃক জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধন রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই ইলিশের উত্পাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা মা ইলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে লোনা পানির সাগর ছেড়ে এসে নদ-নদীর মিঠাপানিতে লাখ লাখ ডিম ছেড়ে দেয় এবং সেই ডিম পোনা থেকে সামান্য বড় জাটকা হয়ে আবারও সাগরে গিয়ে পরিপুষ্ট ও বড় হয়ে থাকে। এই দুই প্রক্রিয়া বা চেইনে বাধা দিয়ে ওদের নির্বিচারে শিকার করা হলেই ইলিশের প্রজনন ও উত্পাদন ব্যাহত হয়। এখন তা রোধ করা হচ্ছে। তবে তা আরও কড়াকড়িভাবে বন্ধ করা হলে ইলিশ জাতীয় অর্থনীতিতে এক বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। ইলিশের প্রাকৃতিক প্রজনন বৈশিষ্ট্যগুলো যাতে কখনোই ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ইলিশের বিচরণ পথ, প্রজনন মৌসুম, সাগরে ও মিঠাপানির দিকে নিয়মমাফিক আসা-যাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদি সুরক্ষা জরুরি। ইলিশ শিকার ও সংরক্ষণের মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতেও অনেক অপচয় ঘটছে। এরজন্য উন্নত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ফিলিপাইনে সবচেয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছ ‘মিল্ক ফিশ’ সুরক্ষায় দেশটি সচেতন। আমাদেরও ইলিশ সম্পদকে সুরক্ষায় আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখা উচিত, আরও বিভিন্ন দেশে এমনকি ইরানের কাছে সাগর উপকূলেও কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদ ও গুণবিচারে বাংলাদেশের ইলিশের কোনো তুলনা মিলে না। বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারি বৃহদাকারের ট্রলার ভেসেলগুলো নির্বিচার মাছ শিকার ও নিধন করছে। অবিলম্বে এর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। অনেক ট্রলার অবাধে বিশাল আকালের জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার পর সেখান থেকে ছোট আকারের কম দামি মাছ বিশেষত ইলিশ পোনা, জাটকা সমুদ্রেই ফেলে দিয়ে চলে আসে। বঙ্গোপসাগর-উপকূলভাগে ৪৭৬ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি আহরণ করা হয়। এরমধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বা অর্থকরী মত্স্য সম্পদ হচ্ছে ইলিশ। বাংলাদেশের আহরিত বা মোট উত্পাদিত মাছের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি যোগান আসে ইলিশের। জিডিপি’তে ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি। পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে যে পরিমাণ ইলিশ মাছ আহরণ করা হয় এরমধ্যে ৬৫ শতাংশই উত্পাদিত হয় বাংলাদেশে। এরপরের অবস্থান ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহে বাদবাকি ১০ ভাগ ইলিশ শিকার করা হয়। দেশে সাগর উপকূলভাগে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে, মাঝি-মাল্লা ইলিশ আহরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাছাড়া অন্তত ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ইলিশের উপর নির্ভরশীল। আমাদের জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় আমাদের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। কোনোভাবেই আমাদের এই সম্পদকে বিলীন হতে দেয়া যাবে না। তা রক্ষা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লেখক: কলামিস্ট |