সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
দারাগাঁও গ্রামে দিন বদলের হাওয়া
Published : Thursday, 10 August, 2017 at 6:00 AM, Count : 1228

সিরাজুল ইসলাম খান : আটষট্টি হাজার গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের পূর্বসুরীদের বিরাট ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন আর সংগ্রামের পথ ধরে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশটির জন্ম। রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন তথা দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে জনগণের সার্বিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে সেই থেকে যাত্রা শুরু নতুন লাল সবুজের পতাকা শোভিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার লক্ষ্য ও দেশের জন্য আত্মোত্সর্গকারী সূর্যসন্তানদের স্বপ্ন পুরণে বাঙালির অবিসন্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশ পুণর্গঠনে এবং একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে দেশকে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহন করে সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। দুখজনকভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা ঘটনা এবং তত্পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক আবরণে অগণতান্ত্রিক শাসনের জাঁতাকলে পড়ে দেশ কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পর শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার গুরত্ব পাবার প্রেক্ষাপটে দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। তাতে জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে জবাবদিহিতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। এর ফলে বিগত দুই-আড়াই দশকে দেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষমতার জায়গাটিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেস্ট অগ্রগতি হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সর্ববৃহত্ প্রকল্প তথা পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণকাজ সরকার সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভের পর বাঙালির জন্য এটা আরেক অহংকারের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
যা হোক, দেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পানে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ অগ্রযাত্রা দেশের আটষট্টি হাজার গ্রামেই ঘটছে। যে গ্রামে আমার জন্ম সেটিও যে এই উন্নয়নযজ্ঞ থেকে পিছিয়ে নেই সেটা ঈদ উপলক্ষে কিংবা অন্যকোন সামাজিক অনুষ্ঠানের কারণে গ্রামের বাড়িতে গেলে সহজেই বুঝতে পারি। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলাধীন একপাশ থেকে চাবাগান বেষ্টিত আমার নিজ এলাকা দারাগাঁও গ্রাম। গাছগাছালী ভরা ছায়াসুবিড় টিলা ও ছোট পাহাড়ি এলাকা থেকে চাবাগানের ভেতর দিয়ে দেওছড়া নামের ছোট্ট আঁকাবাঁকা নদীটি এ গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে। নদীতে আগে মোটামুটি পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ থাকলেও বর্তমানে এটির অবস্থা দেশের অন্যান্য নদনদীর মতই শুকিয়ে খাল হয়ে যাবার কাছাকাছি। শুধু বর্ষার বৃষ্টি এলেই আগের মতো পানির বহমানতা দেখা যায়। এককালে এই গ্রামসহ পুরো এলাকার মানুষ মূলত কৃষি কাজের ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন। বেশিরভাগ পরিবারের অবস্থা ছিল ‘দিন আনি দিন খাই’ রকমের।
 ছোট বেলায় যখন বাড়িতে থেকে হাইস্কুল ও কলেজে পড়ালেখা করেছি তখন দেখেছি আশপাশের পুরো এলাকা অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত এবং অভাব অনটন এ এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে এলাকাটি লেখাপড়ায় এমনই পিছিয়ে ছিল যে কয়েকগ্রাম খোঁজেও একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী পাওয়া যেত না। সারা এলাকায় দু-একটি পাকা বাড়ি ছিল কি না তাও মনে পড়ছে না। সবই ছিল বাঁশ-ছনের কাঁচা ঘর। তিন চার গ্রামের মধ্যে আমার বড় ভাই এবং আমার পরিবারের আত্মীয় পরিজন ছাড়া অন্য কোনো পরিবারে কোনো চাকরিজীবী ছিলেন না।
কিন্তু সময় বদলেছে। দেশের অন্যসব এলাকার মতো আমার গ্রাম ও আশপাশের এলাকায় বিশেষ করে গত দুই দশকে যে পরিবর্তনটা ঘটেছে তা তাক লাগার মতোই। আমার ছোটবেলায় যেমন দেখেছি হালের বলদ দিয়ে প্রভাতে সোনার রবি পূব দিকে ওঠার আগে থেকেই লাঙল-জোয়াল আর মই দিয়ে জমি চাষ করা হতো এখন সেখানে মোটরচালিত কলের লাঙল দিয়ে চাষের কাজটি করা হয়। অন্য দিকে চার কিংবা পাঁচটা শক্তিশালী বলদ বা ষাঁড়কে এক সারি করে জুড়ে দিয়ে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ধান মাড়াই করা হতো এখন ধান মাড়াই কল সেই পুরাতন পদ্ধতির জায়গা দখল করেছে। একেবারে পল্লীর মানুষজন এখন আধুনিক কৃষিকাজ ও তার ব্যবস্থাপনা শুধু আয়ত্বই করেন নি, বরং তারা এসবের সংগে নিজেদেরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে তার সুফল ভোগ করছেন।
শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে উপবৃত্তি প্রদানসহ সরকারের নানা উদ্যোগ, স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণ আর বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়ার ফলে পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়। বর্চমানে গ্রামে আমাদের পরিবারসহ হাতে গোনা ৭-৮টি পরিবার ছাড়া সবাই মূলত কৃষিকাজ, এলাকাভিত্তিক স্থানীয় ব্যবসা এবং এ ধরনের কিছু কাজের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি স্বল্প শিক্ষিত একটি তরুণ যুবকশ্রেণী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে পাড়ি জমায়। আমার গ্রামেও দেখি অনেক পরিবারের সন্তান এখন কর্মসূত্রে বিদেশে আছে এবং তারা এখন মাসে মাসে বাবা-মা ও পরিবারের জন্য টাকা পাঠায় বলে পরিবারগুলোতে সচ্ছলতা এসেছে। বলাবাহুল্য তাদের বিদেশ যাবার ক্ষেত্রেও সরকারের নীতি এবং সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয়ের সাফল্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফলে একদিকে যেমন মানুষ লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিতে শিখেছে, ছেলেমেয়েদেরকে স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়মুখী করতে প্রয়াস পেয়েছেন, অন্যদিকে বিদেশ থেকে সন্তানদের পাঠানো টাকায় তারা পরিবারের ‘দিন বদল’ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
একসময় যে গ্রামের প্রায় সব বাড়িই ছিল ছন বাঁশের এখন দুইশ’র মতো পরিবার অধ্যুষিত সে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘরই পাকা বিল্ডিং। প্রায় সব বাড়িতেই এখন একটা রঙ্গিন টেলিভিশন, বসার জন্য সোফা আর বৈদ্যুতিক পাখা আছে। আছে নিজস্ব পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। কোন বাড়িতে গেলে কয়েক মিনিট বসিয়ে রেখে গাল-গল্প করতেই নডুলস, বিস্কুটসহ হাতে বানানো কোনো পিঠার মতো নাস্তা দেয়ার সঙ্গে চা দেয়া হয়- এসবই তো চিন্তা, রুচি এবং সভ্যতা ভদ্রতার সুচকে পরিবর্তনের চাক্ষুস প্রমাণ। গ্রামের যে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ছিল সে রাস্তা এখন পাকা হয়েছে। গত রোজার ঈদে আমাদের গ্রামের মসজিদ দেখে আমাদের এলাকায় বেড়াতে আসা হবিগঞ্জের মিরপুর সরকারি কলেজের এক সহকারী অধ্যাপক এত সুন্দর ও বড় মসজিদ দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন বলে মন্তব্য করে বলেন আসলেই এলাকাটায় পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। আমি তাকে জানালাম যে, এখন এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এক-দুইজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়ে আছে এবং অনেকেই সরকারের জনপ্রশাসন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে করমরত আছেন। অনেকে আবার বিদেশেও ভালো অবস্থানে কাজকর্ম করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারছেন।
আরও আশ্চর্যের ঘটনা হলো, একজন আমার কাছে জানতে চাইলেন কুয়েতের কোন প্রতিষ্ঠান না কি মসজিদ- মাদ্রাসা নির্মাণে অর্থ সহায়তা করে থাকে। তাদের থেকে সহায়তা নিয়ে আমাদের গ্রামের মসজিদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা যায় কি-না সেটা দেখতে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন। তাকে আমি বললাম যে এ ধরনের আর্থিক সহায়তার কাজটি সম্ভবত ‘কুয়েত ফান্ড’ করে থাকে এবং আমি এটার খোঁজ খবর নেব। একেবারে গ্রামে থেকেও কুয়েত ফান্ডের খবর যিনি রাখলেন ষাটোর্ধ সেই তিনি নিজে ‘ব’- এর নিচে বিন্দু দিয়ে ‘র’ বানাতে পারেন না। তবে তার খোঁজ খবরির বিষয়টায় আমি উচ্ছ্বসিত হই এজন্য যে এটা সমাজে সচেতনতা যে দিনে দিনে বাড়ছে সেটারই প্রমাণ।
আমি যখন বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেছি তখন প্রায়শই শুনতাম অমুকের ছেলে হয়েছে কিংবা তমুকের মেয়ে হয়েছে। যখন জিজ্ঞেস করতাম কোথায় বাচ্চার জন্ম হলো, তখন তারা অবলীলায় বলত যে নিজ ঘরেই বাচ্চা প্রসবের কাজটি করা হয়েছে। বাচ্চা প্রসবকালে যে কত জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং এজন্য যে কোন ধাত্রী কিংবা নার্সের দরকার তারা সেটা বুঝতেও পারতো না। কিন্তু এই অতি সম্প্রতি আমার গ্রামের একজন আমাকে মোবাইল ফোনে জানালেন যে তার ছেলের ঘরে এক নাতি হয়েছে। তিনি আরও যোগ করে বললেন, হাসপাতালে তার বউমাকে বিভিন্ন সময়ে ডাক্তার দেখানো হয়েছে এবং বাচ্চা প্রসবকালে একজন প্রশিক্ষিত নার্সকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে নিরাপদ প্রসব হয়েছে। কোন জটিলতা হয়নি এবং বাচ্চা ও প্রসূতি দুজনই নাকি ভাল আছে। অর্থাত্ ‘দিন বদল’টা সঠিকভাবেই শুরু হয়েছে বলে আমার ধারণা।
হবিগজ্ঞ থেকে আমার গ্রামের বাড়িতে যাবার পথে সকাল ৯টা-১০টার দিকে গেলে দেখা যাবে কাঁধে বই-খাতা ভর্তি ব্যাগ ঝুলিয়ে হাসিখুশি মাখা মুখে স্কুল কলেজমুখী ডজন ডজন ছেলে মেয়ে যাচ্ছে। মনটা ভরে যায় দৃশ্যটা দেখে। মনে মনে ভাবি খুব নিকটেই আমাদের একটা জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত ও আধুনিকমনস্ক সমাজ এবং সুন্দর ভবিষ্যত্ হাতছানি দিচ্ছে। উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তার হাওয়া আমার দারাগাঁও গ্রামেও যে লেগেছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ রকম করে প্রতিটি গ্রাম যদি এগিয়ে যায় তাহলে আটষট্টি হাজার গ্রামের কোনোটিই আর পিছিয়ে থাকবে না এবং প্রকারান্তরে গোটা বাংলাদেশটাই সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com