শিরোনাম: |
বন্যার্তদের সহায়তা হোক মানুষ মানুষের জন্য
|
![]() আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে এ বছর বিগত ২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া গত ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উজানে বন্যার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে আসামে বড় ধরনের বন্যা হওয়ায় সে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। যার প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা অববাহিকায় পানি বাড়ছে। পদ্মা এখনও বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে সহসাই তা বিপদসীমা অতিক্রম করবে। দুই নদীর পানি একসঙ্গে বাড়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে চলতি বছর হাওর এলাকার বোরো ফসল ডুবে যায় আগাম বন্যায়। যার প্রতিক্রিয়ায় ১০ বছর পর বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। দেশের চাহিদা পূরণে কয়েক কোটি মণ চাল আমদানি করা হচ্ছে। উত্তরের জনপদ অচল বলা চলে। পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা অর্থাত্ উত্তরের সব জেলা প্লাবিত হয়েছে। দিনাজপুরের বন্যা পরিস্থিতি বাজে আকার ধারণ করেছে। বগুড়ার কিছু অংশে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী সিরাজগঞ্জ প্লাবিত হয়েছে। ঘরমোহনপুরে বাঁধ ভেঙে পানির নিচে অর্ধশত গ্রামের ফসল, বালিয়াডাঙ্গী গ্রামে পদ্মার ভাঙন চলছেই, কুড়িগ্রামে বন্যায় রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, এবার দিনাজপুর থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ, সিরাজগঞ্জে বন্যায় ২১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। তার মানে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এবারের বন্যায় কৃষক যে সব হারিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ যে পরিমাণ পাওয়ার কথা, তা এখনও পৌঁছেনি। এসব এলাকার জমির ফসল গেছে, গেছে পুকুরের মাছও। বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে, তা সহজেই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এবারের অকাল বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের অনেক দিন সময় লেগে যাবে। শুধু বন্যা নয়, অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধস, নদীভাঙনসহ দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কয়েক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থনীতিবিদ এবং কৃষিবিদরা মনে করছেন। এ মৌসুমের প্রাক-বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কৃষির যে ক্ষতি হয়েছে, তা ছিল স্মরণাতীতকালের মধ্যে ভয়ঙ্কর। ফলে হাওরবাসী আজ সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগের সম্মুখীন। দেশের মোট জনসংখ্যার আট ভাগের এক ভাগ বসবাস করেন হাওরাঞ্চলে। এ হাওরাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি মানুষের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। একের পর এক হাওরের ফসল যখন তলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে ধানের পচন থেকে অ্যামোনিয়া জাতীয় সৃষ্ট গ্যাসে দেখা দিল মাছের মড়ক। উপার্জনের দ্বিতীয় যে উপায়টি দরিদ্র হাওরবাসীর সামনে খোলা ছিল, তাও বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র একদিনে ৯০ পয়েন্টের মধ্যে ৮১টির পানি বেড়েছে। এর মাঝে ১৭ পয়েন্টের পানি অতিক্রম করেছে বিপদসীমা। টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির দেশের কয়েকটি এলাকায় আরও অবনতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা। এতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, ভেসে যাচ্ছে খামারের মাছ। তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার ৬৮ গ্রামের ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কায় অনেক এলাকার মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। তলিয়ে গেছে রোপা আমন ও সবজি ক্ষেত। ভেসে যাচ্ছে পুকুর-খামারের মাছ। নীলফামারী শহরের সওদাগড়পাড়া, বাবুপাড়া, প্রগতিপাড়া, নিউবাবুপাড়া, শাহীপাড়া, নতুন বাজার কলোনিসহ কয়েক এলাকার বাড়িঘর হাঁটুপানিতে তলিয়ে রয়েছে। শহরের অনেক রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। তাছাড়া কুড়িগ্রামের ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর ও তিস্তাসহ কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধরলার পানি কুড়িগ্রাম ফেরিঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে ছোট যমুনা নদীর ফ্লাড ওয়ালের আউটলেট দিয়ে পানি প্রবেশের কারণে নওগাঁ শহরের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শহরের বন্যাকবলিত মহল্লাগুলোর রাস্তাসহ বাড়িঘরে পানি ঢোকায় এসব এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধ কুমারে পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। এ জেলার ৯ উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুতরাং এ মুহূর্তে কালবিলম্ব না করে সরকারকে বন্যা মোকাবিলায় আগাম সতর্ক হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে এবং আগামীর জন্য স্থায়ী বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিকল্পনাসহ এগিয়ে আসতে হবে। বন্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষকরা বলেছেন, নদী তার স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের গভীরতাকে হারিয়ে ফেলেছে; পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়েছে। আর এ ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছি। এ কারণে ডুবছে রেলপথ, সড়ক ও জনপদ; পুড়ছে কপাল, কাঁদছে মানুষ। বিত্তবানদের উচিত সাধ্যমতো তাদের কাছে অন্ন, বস্ত্র পৌঁছে দেয়া; তাদের থাকার ব্যবস্থা করা। আমরা যেন তাদের ভাই কিংবা বোন মনে করি। কারণ আজ যারা এমন দুর্ভোগের শিকার, এমনও হতে পারে আগামীকাল আমাদের পালা। তাই ছোট-বড়, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই। এখন আপন চিন্তা ভুলে গিয়ে আসুন ভাবি অসহায় সেই বন্যার্ত মানুষের কথা। চোখ খুলে দেখি নিরীহ অসহায় মা-বোনদের দিকে। মানবতার পরিচয় দেই। অন্যদিকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল। গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। করতোয়ার পানি বৃদ্ধির ফলে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি স্থানে মাটি সরে গেছে। করতোয়ার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অপরদিকে ঠাকুরগাঁও পাঁচ উপজেলার কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, ব্রিজ-কালভার্ট তলিয়ে গেছে। নষ্ট হচ্ছে ফসল। গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিপাকে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। টাঙ্গন নদের পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এবং লালমনিরহাট ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপদসীমার ৩০ এবং ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার মোগলহাটে পাউবোর দুটি বাঁধ ভেঙে ১৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে গেছে পাটগ্রাম শহররক্ষা বাঁধটিও। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নিম্ন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তাছাড়া পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নালিতাবাড়ী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, খুলনা, সিলেট এবং বিশ্বনাথসহ সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি দেশের সব সম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ মানুষের জন্য এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বন্যার্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী। |