শিরোনাম: |
একজন নায়ক রাজ রাজ্জাক ও বাংলা চলচ্চিত্র
|
![]() বাংলা চলচ্চিত্রের যেমন একটি অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে তার একেবারে সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন এ কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাক। আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব ১৯৫৫ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সবাক জগতে প্রবেশ করি। কলকাতার টালিগঞ্জে তার জন্মভূমিতে ছোটদের জন্য লেখা ‘বিদ্রোহী’ নাটকে কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার শুরু। তারপর ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকালে শরণার্থী হয়ে তিনি তত্কালীন পূর্বপাকিস্তানে পাড়ি জমান। এখানে এসে প্রথমেই পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামক একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন এ শিল্পী। তারপর বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাান বাংলা চলচ্চিত্রে। তিনি সালাউদ্দিন প্রোডাকশনের ব্যানারে ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগড় লেন’ নামক চলচ্চিত্রে ছোট্ট একটি চরিত্রের মাধ্যমেই নিজের অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে ‘কার বউ’, ‘ডাক বাবু’, ‘আখেরী স্টেশনসহ আরও কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় স্বাক্ষরের পরে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ নামক চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অতঃপর একের পর কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় এবং দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে গমন করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ এ গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করেন। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ ছবি ‘অলোর মিছিল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ তে অনবদ্য অভিনয় করেন। তারপর একে একে ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘কখগঘঙ’, ‘স্বরলিপি’, ‘পাগলা রাজা’, ‘পরিচয়’, ‘প্রিয়তমা’, ‘প্রতিশোধ’, ‘পুত্রবধূ,’ ‘রজনী গন্ধা’, ‘রংবাজ’, ‘সমাপ্তি’, ‘সোনা বউ’, ‘লাইলী মজনু’, ‘সেতু’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘স্লোগান’, ‘সোনালি আকাশ’, ‘তালাক’, ‘নাগিন’, ‘নতুন পৃথিবী’, ‘নাজমা’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘ঘরনী’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘কাবিন’, ‘কাজল লতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাতবৌ’, ‘আনোয়ারা’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘আশার আলো’, ‘অভিযান’, ‘এতা টুকু আশা’, ‘পীচঢালা পথ’, ‘মনের মত বৌ’, ‘ময়নামতি’, ‘দীপ নিভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘মধুমিলন’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘নাচের পুতুল’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘বেঈমান’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অমর প্রেম’, ‘অলংকার’, ‘আসামি’, ‘সোহাগ’, ‘মাটির ঘর’, ‘আনার কলি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’, ‘অন্যরকম ভালবাসা’সহ প্রায় তিন শতাধিক বাংলা ও উর্দু ছবিতে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়কের আসনে বসেছেন। তার বিশেষ সংলাপ ভঙ্গি ও কথোপকথনের জন্য তত্কালীন সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী তাকে ‘নায়করাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এবং সেটাই তার জন্য যথোপযুক্ত ছিল। তার সময়কার ও সমসাময়িক সহ অভিনেত্রী ও জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে সুজাতা, সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, অঞ্জনা, সুচরিতা, রোজিনা প্রমুখই প্রধান। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় উত্তম কুমার যেমন ছিলেন মহানায়ক এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছিল খ্যাতিমান, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের রাজ্জাক-কবরী, রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-ববিতা , রাজ্জাক-শবনম ইত্যাদি নানা নামের জুটি নাম করেছিল তখন। তার সমসাময়িক নায়ক ও পার্শ্ব চরিত্রে কাজ করেছেন রহমান, সিডনী, বুলবুল আহমেদ, রাজ, আনোয়ার হোসেন, খলিল, বাবর, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ওয়াসিম, জাবেদ, ফারুক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ। ওই সময়কার রুপালি পর্দার ছবিগুলোকে এখন শুধু হারানো দিনের বা সোনালি দিনের ছবি হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। তখনকার ছবিগুলো কাহিনী, সংলাপ, ঘটনার বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে মনোরঞ্জন ও আমোদের পাশাপাশি একেকটি শিক্ষণীয় বাণী থাকত। তখন অভিনয়ের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছিল না। তখন দীর্ঘদিনে একেকটি সিনেমা তৈরি করা হতো। কিন্তু তারপরও রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জনের প্রবণতা কারও মাঝেই লক্ষ্য করা যায়নি। ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকেও সিনেমাই ছিল একমাত্র বিনোদন মাধ্যম। সিনেমা হলের ছিল জমজমাট ব্যবসা। রাজ্জাকের সিনেমা মানেই হলের সকল শো’র সকল টিকিট শেষ। কিন্তু তখন সিনেমাগুলোতে কোনো অশ্লিলতা ছিল না। বর্তমানে সবাই রাতারাতি তারকা বনে যেতে চায়। সিনেমার মধ্যে নানারকম অশ্লিলতা গ্রাস করেছে। ছবিতে কাহিনী, সংলাপ কিংবা দর্শকদের জন্য না থাকছে শিক্ষণীয় কিছু না থাকছে বিনোদন। সেজন্য এখন সিনেমা হলগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে সুপার মার্কেট গড়ে উঠেছে। তাছাড়া এখন ডিজিটাল যুগে ঘরে বসেই এমনকি একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেই সব ধরনের দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখতে পারছে দর্শকবৃৃন্দ। অথচ এখন দেশে অভিনয় শেখানোর জন্য এবং এ নিয়ে গবেষণা করার জন্য অনেক প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রের ওপর উচ্চশিক্ষার একাধিক বিভাগ রয়েছে। সেখানে এখন আর কোনো নায়করাজ রাজ্জাক তৈরি হচ্ছে না। নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে তাই সারাদেশের মানুষ কাঁদছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সব পর্যায়ের মানুষ তাকে শোক জানাচ্ছেন। কারণ তিনি ব্যক্তির গণ্ডি পেরিয়ে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তার জীবদ্দশায় এমন কোনো পুরস্কার নেই যা তিনি পাননি। তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সর্বশেষ গৌরবময় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তার মৃত্যুতে তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |