শনিবার ২১ জুন ২০২৫ ৭ আষাঢ় ১৪৩২
বিরল রোগের চিকিত্সায় বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ
Published : Saturday, 26 August, 2017 at 6:00 AM, Count : 1204

মোতাহার হোসেন : বেশকিছু সেক্টরে দৃশ্যমান উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ও বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। কোনো কোনো সেক্টরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহ ‘রোল মডেল’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। জাতি হিসেবে এটা সরকারের এবং আমাদের দেশ ও জাতির জন্য যেমন সম্মানের তেমনি গৌরবেরও। ঠিক এমনি একটি নীরব বিপ্লব সাধিত হতে চলছে দেশের স্বাস্থ্য খাতে।  যদিও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সাধারণ জনমানুষের অভিযোগের কিংবা ক্ষোভের অন্ত নেই। কিন্তু এর মাঝেও ব্যতিক্রম বা ভালো কিছু যে হচ্ছে না তা নয়। বাংলাদেশের চিকিত্সা সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার ও চিকিত্সকদের নিষ্ঠায় অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। এখন বেশকিছু জটিল ও বিরল রোগের চিকিত্সায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামনির চিকিত্সার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে। মুক্তামনিকে সঙ্গে নিয়ে চিকিত্সকরা ওই হাসপাতালের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। পাঠানো হয় তার রোগের সমস্ত পরীক্ষার কাগজপত্র। কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসে, ‘দিস কেস ইজ নট অপারেবল অ্যান্ড কিউরেবল’। সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিত্সকরাই মুক্তামনির ডান হাত অক্ষত রেখে সফল অপারেশন করেছেন, অপসারণ করেছেন তিন কেজি ওজনের অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড।
বিরল রোগে আক্রান্ত শুধু মুক্তামনিই নয়, বৃক্ষমানব হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাওয়া আবুল বাজানদার, মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়া, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু, জোড়া শিশু তৌফা ও তহুরার সফল অস্ত্রোপচারের সাফল্য দেশ ছাড়িয়ে স্থান পেয়েছে বিদেশি গণমাধ্যমেও।  এখানে এটা বলাও প্রাসঙ্গিক যে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেডের চেয়ে রোগী বেশি, রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ও ভুল চিকিত্সার অভিযোগ পুরনো। এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চিকিত্সায় রয়েছে বেশকিছু সাফল্য, বিশ্বে বাংলাদেশের চিকিত্সকরা সৃষ্টি করেছেন উদাহরণ। কেবল তা-ই নয়, বাংলাদেশের একজন চিকিত্সকের উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহূত হচ্ছে অনেক দেশে মাতৃ মৃত্যুরোধে, একজন চিকিত্সকের ৬টি বই ৪০টিরও বেশি দেশে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশি দুই চিকিত্সকের আবিষ্কার করা হেপাটাইটিস-বি এর ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এসবই বাংলাদেশের চিকিত্সকদের সফলতার একেকটি দৃষ্টান্ত। এসব নিয়ে গর্ব করতে পারে বাংলাদেশ।
চিকিত্সকরা প্রথমে বলেছিলেন, জীবন বাঁচাতে বাধ্য হলে মুক্তামনির আক্রান্ত ডান হাতটি কেটে ফেলতে হতে পারে। তবে গত ১২ আগস্ট হাতটি অক্ষত রেখেই তিন কেজি ওজনের অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড কেটে ফেলতে সক্ষম হন বাংলাদেশের চিকিত্সকরা। যদিও তারা বলছেন, এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয় মুক্তামনি, তার আরও অন্তত পাঁচ থেকে ৬টি অপারেশন দরকার হবে। হাত না কেটে অস্ত্রোপচার করাকে চিকিত্সকরা দেখছেন সফলতা হিসেবেই। অন্তত ত্রিশজন চিকিত্সকের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম। তার সঙ্গে ছিলেন একই ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেনসহ ৩০ চিকিত্সক। ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি খুলনা থেকে এসে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন আবুল বাজানদার। বিরল রোগ ইপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভ্যারুসিফরমিসে আক্রান্ত আবুল বাজানদার বাংলাদেশে প্রথম আর বিশ্বে তৃতীয়। গত ১২ জুলাই তার শেষ অপারেশন করা হয়েছে। তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
সাফল্য রয়েছে ঢামেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগেরও। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়া, বড় জিহ্বার আট বছরের জাহিদ, ডাস্টবিনে পাওয়া পলিথিনে মোড়ানো শিশু আয়ান, জোড়া শিশু তৌফা ও তহুরার সফল চিকিত্সা হয়েছে এই বিভাগে। প্রতিটি চিকিত্সায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন এই বিভাগের চিকিত্সকরা। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরায় যুবলীগের সংঘর্ষে মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় সুরাইয়া। ওইদিন রাতেই মাগুরা সদর হাসপাতালে অপারেশন হয় সুরাইয়ার মা নাজমা বেগমের। সন্তান প্রসবের পর দেখা যায় পেটে থাকা শিশুটিও গুলিবিদ্ধ। দুদিন পর মা ও নবজাতককে ভর্তি করা হয় ঢামেক হাসপাতালে। গঠিত হয় ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড।
নবজাতক বিভাগের আইসিইউতে রাখার পর একটু আশঙ্কামুক্ত হলে মায়ের কোলে শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তার নাম রাখা হয় সুরাইয়া। ‘সুরাইয়ার চিকিত্সাও চিকিত্সকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তারা।’ মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে ২-৩টি ঘটেছে। ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাক্তারা জানতে পারেন মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা দুই/একটি হলেও তারা বাঁচেনি। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র শিশু সুরাইয়াই। বিশ্বে এই ঘটনা এটিই প্রথম। সুরাইয়া এখন ভালো আছে। তবে তার বিষয়টি এখনও ডাক্তারদের কাছে বিস্ময়, কী করে সে এতোটা সারভাইভ করতে পারে! এটা পুরো চিকিত্সকসহ দেশের সব মানুষেরা আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা একাগ্রতা নিয়ে সুরাইয়াকে সুস্থ করে তোলার জন্য। সবাই যে যার অবস্থান থেকে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়েছিলেন। একই ঘটনা ছিল কুকুরে কামড়ানো শিশু ফাইজার বেলাতেও। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের পরিচালকও সেখানে সাহায্য করেছেন, ছিলেন প্লাস্টিক সার্জনরাও। সুরাইয়ার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতে আমরা চিকিত্সা দিয়েছি সেই একই প্রসিডিউর মানা হয়েছে ফাইজার ক্ষেত্রেও। ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়  এ ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জিত হয়।
আর সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত ‘তৌফা ও তহুরার’ জোড়া লেগে জন্ম নেয়ার বিষয়টি চিকিত্সা বিজ্ঞানে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’, এটা বাংলাদেশে এই প্রথম। পিঠের একটু নিচ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত সংযুক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছিল তৌফা ও তহুরা। গত ১ আগস্ট তাদের আলাদা করেন চিকিত্সকরা। শুধু চিকিত্সাই নয়, উদ্ভাবনেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের চিকিত্সকরা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতারের প্রসবকালীন রক্তপাত বন্ধে ‘কনডম ক্যাথেটার টেম্পোনেড’ ব্যবহারের মাধ্যমে এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যা বিশ্বব্যাপী ‘সায়েবাস মেথড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০০৩ সালে ‘ইউজ অব কনডম টু কন্ট্রোল ম্যাসিভ পোস্টপার্টাম হেমোরেজ’ শিরোনামে মেডস্কেপ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয় ডা. সায়েবার এ চিকিত্সা পদ্ধতি। পরবর্তীতে মূল রিসার্চ পেপার হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনি অ্যান্ড অবস-এ এবং ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবেও প্রকাশিত হয় এটি। আন্তর্জাতিক নানা জার্নালে সায়েবাস মেথড প্রকাশিত হলে বিভিন্ন দেশের চিকিত্সকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ডা. সায়েবা আখতারের মাধ্যমে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই মেথড নিয়ে এফসিপিএস ডেজারটেশন, এমএস থিসিস ও পিএইডডি থিসিস আছে।
ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ রচিত ৬টি বই উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। অপরদিকে, হেপাটাইটিস বি-এর চিকিত্সায় ‘ন্যাসভ্যাক’ নামে নতুন ওষুধের সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশি দুই চিকিত্সাবিজ্ঞানী ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ও ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ‘ন্যাসভ্যাক’-এর সাফল্য সম্পর্কে গণমাধ্যমকে ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি’র চিকিত্সায় ব্যবহূত অন্যসব ওষুধের তুলনায় এটি বেশি নিরাপদ হিসেবে প্রমাণিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ন্যাসভ্যাক ব্যবহারে শতকরা ৫০ ভাগ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীর রক্ত থেকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। আর শতভাগ রোগীর লিভারের প্রদাহ পুরোপুরি ভালো হয়েছে।’ ন্যাসভ্যাকের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালটি চালানো হয় ২০১৩ সালে। এই ট্রায়ালটি লিভার বিশেষজ্ঞদের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স হিসেবে স্বীকৃত আমেরিকান লিভার মিটিংয়ে ‘প্রেসিডেনশিয়াল ডিস্টিংশন পদক’ লাভ করে। এরপরই এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত শুরু হয় কিউবায়। দেশটিতে ‘হেবার-ন্যাসভ্যাক’ নামে বিক্রি হচ্ছে ওষুধটি। রাশিয়ায় চলছে মাল্টিসেন্টার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। জাপানেও ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন মিলেছে।
চিকিত্সকদের সাফল্য সম্পর্কে বলা যায় ‘জোড়া লাগা’ দুই শিশুদের অজ্ঞান করার মতো সাহস কারও ছিল না-অথচ তাদের একসঙ্গে রেখে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করাটাই বলে দেয় বাংলাদেশের চিকিত্সার অগ্রগতি। বিশ্বাস করি চিকিত্সকরা যদি ভালো টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট পান, তারা নিঃসন্দেহে আরও উন্নতি করবে। কারণ, তাদের মেধা রয়েছে, ইচ্ছা রয়েছে, রোগীদের প্রতি আন্তরিকতা রয়েছে। চিকিত্সকদের এই বিষয়গুলো অনুপ্রেরণা দেবে পরবর্তী প্রজন্মকে। অগ্রগতির এই ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকলে একদিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবে বাংলাদেশ।’ তবে প্রত্যাশা থাকবে বিরল এসব রোগের সফল চিকিত্সাকে টেকসই, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ দায়িত্বশীল মহল উদ্যোগী হবেন সেটা প্রত্যাশা করে দেশের মানুষ। একই সঙ্গে তা ক্রমশ রাজধানীর বাইরে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরে সম্প্রসারিত করা সময়েরও দাবি।
লেখক: সাংবাদিক.কলামিস্ট।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com