শিরোনাম: |
সড়কে দুর্ঘটনা রোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ চাই
|
সড়ক দুর্ঘটনা যেন অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার, মৃত্যুদূত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়া কঠিন বাংলাদেশে। প্রশ্ন হলো, সড়ক দুর্ঘটনায় আর কত প্রাণ ঝরে যাবে? নিত্যনৈমিত্যিক এই সড়ক দুর্ঘটনার দায় কার? কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর? প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে মানুষকে। কোনো দুর্ঘটনায় গোটা পরিবারও শেষ হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, আর এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে, সরকারিভাবে নতুন নতুন সুপারিশ তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। পাগলা ঘোড়ার লাগামও মনে হয় টেনে রাখা সম্ভব, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে মানুষের নিস্তার নেই, তার লাগাম টানে কার সাধ্য! সড়ক দুর্ঘটনার এমন মৃত্যুমিছিল যেন নিত্যদিনের দুঃসংবাদ! বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১২ হাজার মানুষের। দুর্ঘটনাকবলিত কোনো যানবাহনের চালককে আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময়ই তাদের শাস্তি হয় না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা, জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে দায়ী। শুধু চালকের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শতভাগ নৈতিক ও কঠোর থাকতে পারলেই দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এটা ঠিক যে, দেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব যান চালানোর জন্য চাই দক্ষ ও বিবেচক চালক। এই বিপুলসংখ্যক যোগ্য চালক তৈরির জন্য দেশে কি কোনো সুষ্ঠু কার্যক্রম রয়েছে? এমনকি লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের চলার পথে আরও সতর্ক থাকা এবং ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে মেনে চলার ব্যাপারে কোনো কর্মশালা কিংবা প্রশিক্ষণের পরিকল্পনাও কি নিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আসলে সব পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে হবে। না হলে যে কেউ যে কোনো দিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ইহধাম ত্যাগ কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করবে, তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। ক’দিন আগে গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশি। অথচ বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। বাকি যানবাহন যাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বৈধ নয়। অনেকের একাধিক লাইসেন্সও আছে। স্বাভাবিকভাবেই এ অবৈধ লাইসেন্সধারী গাড়িচালকরা গাড়ি চালাতে গিয়ে আইনের ধার ধারেন না। সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত নন, এমন চালকের সংখ্যাও নেহায়েতই কম নয়। এই চালকদের পেছনে আছে শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতা, যে কারণে এদের শনাক্ত করাও হয়ে পড়েছে দুষ্কর। সঙ্গত কারণে চালকরাও তাই বেপরোয়া। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। কেননা এ পরিস্থিতি একটি দেশের পক্ষে কিছুতেই স্বস্তির হতে পারে না। স্মর্তব্য যে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এ যাবত অনেক কথা বলা হয়েছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, সড়কপথ আজো নিরাপদ হলো না। সড়কপথের ‘যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত’ কথার কথা হয়েই থেকে গেল। মাঝেমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার যেসব তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসে তা একটি দেশের জন্য দুর্বিষহ এবং আতঙ্কের। অথচ সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার জনগণের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘রোড সেফটি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে পাঁচটি প্রধান ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এগুলো সরকার সংশ্লিষ্টরা মেনে চললে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। এগুলো হলো গাড়ির গতি, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, হেলমেট ব্যবহার, সিট বেল্ট ব্যবহার ও শিশুর সুরক্ষা ব্যবস্থা। যে পাঁচটি কারণ দেখানো হয়েছে সেগুলোর প্রতিকার না হলে, দুর্ঘটনা তো কমবেই না, বরং দিন দিন বেড়ে যেতে থাকবে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ গাড়ির বেপরোয়া গতি। অদক্ষ চালকের হাতে বেপরোয়া গতির যানবাহন হয়ে উঠেছে মৃত্যুর দূত। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বোচ্চ কঠোর না হলে এটা থামানো যাবে না। সড়কভেদে প্রতিটি যানবাহনের জন্য গতি নির্দিষ্ট করে তা মানতে বাধ্য করতে হবে। দক্ষ চালক তৈরির ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। যাকে তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করা না গেলে কখনোই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। একইসঙ্গে বন্ধ করতে হবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও প্রমিসেস মেডিকেল লিমিটেডের গবেষণা অনুযায়ী, মাদকাসক্ত চালকের কারণে দেশে ৩০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দেশবাসী প্রত্যাশা করেন। মাদকাসক্ত চালকের লাইসেন্স বাতিল করাসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। চালকদের সিটবেল্ট ব্যবহারের প্রতি অনীহা গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিও বেশির ভাগই সচেতন নন। এছাড়া যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার তো রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে এসব আইনের ব্যত্যয়ে জরিমানার অঙ্ক দ্বিগুণ করা যেতে পারে। এতে চালকেরা সচেতন হবেন। এসব ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা না কমার একটি বড় কারণ, দায়ী চালকদের বিচার না হওয়া। দোষী হলেও চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হার খুবই কম। এতে চালকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। চালকদের সঙ্গে মালিক প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন সংগঠনগুলোকেও সচেতন হতে হবে। মালিক প্রতিষ্ঠানকে চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে, নিজের চালকের প্রতি নজর রাখতে হবে। দুর্ঘটনায় আহত নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে মালিকপক্ষ নিজ স্বার্থেই সচেতন হবে। এক গবেষণায় দেখা যায়, নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মোটরযানে দুর্ঘটনা ঘটে সর্বোচ্চ তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ১২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে। নিহতের ৮০ শতাংশের বয়স পাঁচ থেকে ৪৫ বছর। নিহতদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পথচারী। যাদের ২১ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে। দুর্ঘটনায় আহত ১৫ শতাংশ লোক মারা যায় ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে। দেশে ১৬ লাখ রেজিস্টার্ড গাড়ি রয়েছে আর লাইসেন্স পাওয়া ড্রাইভার রয়েছে মাত্র ১০ লাখ। ৪ লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং ড্রাইভিং ট্রেনিং দেয়া ও তাদের জন্য লাইন্সেসের দরকার আছে। তা না হলে প্রতিনিয়তই এভাবে অকাতরে ঝরবে আমাদের প্রাণ। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই থানা পুলিশ পয়সা পেয়ে মীমাংসা করে দিচ্ছে এসব হত্যাকণ্ডের ঘটনাগুলো। কতটাই না অসভ্য আমরা। মানুষ মরবে আর ১০-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সব মীমাংসা হবে; হবে সব স্বাভাবিক। একি ভাবা যায়? সরকারি হিসাব মতে, ১৯৯৯ সালে ৪ হাজার ৯১৬ জন, ২০০০ সালে ৪ হাজার ৩৫৭ জন, ২০০১ সালে ৪ হাজার ৯১ জন, ২০০২ সালে ৪ হাজার ৯১৮ জন, ২০০৩ সালে ৪ হাজার ৭ ৪৯ জন, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৮২৮ জন, ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৪ জন, ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪ জন, ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৮৬৯ জন, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৪২৬ জন, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ২৯৭ জন, ২০১০ সালে ৫ হাজার ৮০৩ জন, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৬৮৮ জন, ২০১২ সালে ৫ হাজার ৯১১ জন, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৮৬৫ জন এবং ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৯৭৫ জন, ২০১৫ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩ জন মারা যান, আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। ২০১৬ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৩১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হন পাঁচ হাজার ২২৫ জন। চলতি ২০১৭ সালের এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১ হাজার ৯৬০ জনেরও বেশি মানুষ। আহত এবং পঙ্গু হয়েছেন আরও কয়েকগুন মানুষ। প্রতিবছরই এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে আর তা রোধ করা যাচ্ছে না। কথায় বলে ‘ঘুমন্ত লোকের ঘুম ভাঙানো সম্ভব, কিন্তু জেগে জেগে ঘুমালে জাগানো কঠিন।’ শত চেষ্টায়ও তাকে জাগানো যায় না। কেউ নিজ থেকে সচেতন হয় না। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যেন সেই দশা। কয়েক মাস আগে খোদ জাতীয় সংসদে অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়সী হেলপার বাস-মিনিবাস চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানালেন যোগাযোগমন্ত্রী। তিনি বলেন, গাড়ির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে দক্ষ চালক বাড়ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক, শিশু, নববধূ-বরসহ পুরো বরযাত্রী, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এমনকি সাবেক মন্ত্রীও এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিহত হওয়ার খবর আমরা পত্রিকার পাতায় প্রত্যক্ষ করেছি, যার একটিও সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। প্রশ্ন হলো সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া এমন কোনো দিন আছে কি? এ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না কেন। সরকার সংশ্লিষ্টরা সচেতন হলে সড়ত দুর্ঘটনা কনা কমে বাড়ছে কেন? সকলের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দুর্ঘটনা না কমায় প্রশ্ন জাগে, বিষয়টিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কি-না? সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা শুধু চালকদেরই দায়ী করি। পরিবহন মালিকরা কি দায়ী নন? তারা কেন লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেন। যারা অবৈধ চালকদের রাস্তায় গাড়ি চালাতে দেয় তাদের দায়ী করি না। যাদের চোখের সামনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে তাদের দায়ী করি না। যারা অসচেতন হয়ে রাস্তায় চলে তাদের দায়ী করি না। শুধু চালকদের ওপর দোষ চাপিয়ে কেবল দুর্ঘটনার দায় এড়ানো যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিকতা, সচেতনতা, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আমরা আশা করি। - লেখক- মীর আবদুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট। |