শিরোনাম: |
কম্পিউটার গেম এবং তরুণ সমাজ
|
![]() দেখা গেছে, একটি অবুঝ শিশু থেকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত কম্পিউটার গেমে ক্রমশ আসক্তি হয়ে যায়। কোরিয়ায় একজন টানা ৫০ ঘণ্টা কম্পিউটার গেম খেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল, চীনের এক দম্পতি কম্পিউটার গেম খেলার অর্থ জোগাড় করতে নিজেদের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছিল। এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল হলেও বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটছে। আজকাল কম্পিউটার গেমে আসক্তি আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়ই ভয়ানক কথা। কম্পিউটার গেম সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো একটা কম্পিউটার গেমে তীব্রভাবে আসক্ত একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ উত্তেজক রাসায়নিক পদার্থের দ্রুত নিঃসরণ হয়। শুধু তাই নয়, যারা সপ্তাহে ছয়দিন টানা দশ ঘণ্টা কম্পিউটার ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের গঠনেও এক ধরনের পরিবর্তন হয়ে যায়। এই তাত্পর্যপূর্ণ উদাহরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে যাওয়া মোটেও বিচিত্র কিছু নয়। বরং ক্ষতিকর। এ বিষয়ে একটু সতর্ক না থাকলে খুব সহজেই আসক্ত হয়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় মানুষগুলো, কোমলমতি শিশু-সন্তানেরা, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। অতঃপর এদের ফিরিয়ে আনতে কে দায়িত্ব নিবে? আমরা জানি, আসক্তি মানেই হচ্ছে এক প্রকার নেশা। আর নেশা সব কিছুর জন্যই খারাপ। নেশা কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। একটা সুন্দর জীবন ধ্বংস করার জন্য যে কোনো নেশাই যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। কাজেই আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, কম্পিউটার গেম চমত্কার একটা বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে। কখনো কোনো নেশার বস্তু হতে পারে না। আত্মহত্যা স্পৃহাকারী কোনো ডিভাইস হতে পারে না। বরং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি উত্কৃষ্ট ও প্রয়োজনীয় বস্তু হতে পারে। কম্পিউটারের যথোপযুক্ত ব্যবহার কখনো ধ্বংস আনতে পারে না। কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে, এতে আসক্ত হওয়া খুব সহজ ব্যাপার। তার পরিণতি মোটেও ভালো নয়। এসব সবাইকে মনে রেখে কম্পিউটার গেমের প্রতি তীব্র আসক্তি পরিহার করতে হবে। শহরের শিশুদের খেলার জায়গা নেই- তা সবার জানা। তবে এর সঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শিশুরা মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে অনলাইন গেম বেশ কয়েক বছর ধরেই রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে সচেতন অভিভাবকদের কাছে। তবে শুধু অভিভাবকরাই নন, অনলাইন গেমের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আসক্তি মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজ বিজ্ঞানীদেরও বেশ চিন্তা বাড়িয়েছে। বর্তমানে শিশুদের বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গেম বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলে থাকেন। অনলাইন গেম খেলতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এর সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। তার ওপর দ্য ব্লু হোয়েল নামক গেমটি নতুন মাত্রা যোগ করতে শুরু করেছে। ২০১৩ সালে রাশিয়ায় দ্য ব্লু হোয়েল গেম নামক এ মরণ খেলা শুরু হয়। এ গেমের কারণে ২ বছর পরই প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, নীল তিমিরা মারা যাওয়ার আগে জল ছেড়ে ডাঙায় ওঠে, যেন আত্মহত্যার জন্যই ডাঙায় উঠে আসা। সে থেকেই এ গেমের নাম দ্য ব্লু হোয়েল বা নীল তিমি করা হয়েছে। এর আগে দ্য ব্লু হোয়েল গেম এর কারণে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সমপ্রতি বাংলাদেশ যুক্ত হলো। আমাদের দেশে আত্মহননের ঘটনা হু হু করে বাড়ছে বিভিন্ন কারণেই। নতুন করে যুক্ত হলো এ উপসর্গ। পরিসংখ্যান বলছে, গেল ৩ মাসে রাশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় মোট ১৬ তরুণীর আত্মহত্যার খবর মিলেছে। গেমটির শুরুর ধাপগুলো অবশ্য তেমন ভয়ঙ্কর নয়; বরং বেশ মজারই। আর সে কারণেই কিশোর-কিশোরীরা এ গেমের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ওই মোবাইলে ক্রমাগত নোটিফিকেশন আসতে থাকে, যা ওই মোবাইলের ব্যবহারকারীকে এ গেম খেলতে বাধ্য করে। এভাবে বাধ্য হয়ে খেলতে খেলতে গেমের লেভেল যত অগ্রসর হয়, ধাপগুলো ততই ভয়ঙ্কর হতে থাকে। এ ধাপগুলোয় অংশগ্রহণের পর ওই ছবি গেমিং পেজে পোস্ট করতে হয়। অক্ষরে অক্ষরে গেমের নির্দেশনা মানতে গিয়ে অবশেষে আত্মহত্যা করতে হয়। কিন্তু এমন তো কোনো গেম হতে পারে না। এ থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে? এ সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। কেন ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইলে বেশি সময় দিচ্ছে, অনেক অভিভাবকের সেদিকে তাকানোর সময় নেই। তারা প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার নিয়ে খোঁজখবর রাখেন না। ফলে বিপদ তাদের নজর এড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। বাবা-মাদের তাদের সন্তানদের আরও বেশি সময় দেয়া, সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা এ সমস্যার একমাত্র কার্যকরী সমাধান হতে পারে। জলজ্যান্ত মানুষের অবহেলা থেকেই ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন গেমের দিকে ঝুঁকছে। এ খেলায় প্রত্যেকেই মারা গেছে, এমনটা নয়। মারাত্মক আঘাত নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জাও লড়ছে কেউ কেউ। এদের করুণ পরিণতি কেন হচ্ছে, জানতে হবে। কেন তারা আত্মহননের পথ বেছে নিল, তা বের করে জনসম্মুখে প্রচার করতে হবে। আরেকটি কথা আমি জোরপূর্বক বলে চাই, অবিলম্বে দ্য ব্লু হোয়েল বা এ ধরনের বিপজ্জনক গেমসের লিংক গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, মাইক্রোসফট ও ইয়াহু থেকে সরিয়ে ফেলা হোক। কারণ লেখাপড়ার বাইরে বেশিরভাগ সময় তারা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনের সামনে কাটাচ্ছে। তাদের এই স্ক্রিন আসক্তির ফলে তারা যেমন ঘরকুনো হয়ে পড়ছে, তেমনি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে প্রত্যেকের একই কথা, একই অভিযোগ। ‘আমার বাচ্চাটা কোথাও বের হতে চায় না। স্কুল আর বাসা। কারো সঙ্গে খেলে না। মোবাইলে গেমে মাথা গুঁজে রাখে আর না হলে টিভিতে কার্টুন দেখে। কী যে করি!’ ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত মা-বাবার সন্তানকে নিয়ে এই আক্ষেপ এখন মুখে মুখে। এই ঘরকুনো মুখ লুকানো বদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া শিশুদের এই দশার জন্য দায়ী কে? নিঃসন্দেহেই বলা যায় মা-বাবা। তাদের অতি সচেতনতা এবং ব্যস্ততাই আমাদের চোখের সামনে আমাদের সন্তানেরা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলা না করে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে এই প্রজন্মের সন্তানগুলো মার্কিন জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক্স’-এ প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব শিশু প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখে বা কম্পিউটারে খেলার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, তারা অন্য শিশু যারা এসব করে না তাদের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বেশি সমস্যায় ভোগে। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয়, সব কিছুই অতিরিক্ত করে ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই যন্ত্রপাতির প্রতি মানুষের একটা বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, শুধু কম্পিউার গেমে আসক্তিই নয় ইন্টারনেট ব্যবহার, মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার, কম্পিউারে অনেক সময় ধরে ব্রাউজিংয়ের সবগুলোরই নেতিবাচক দিক রয়েছে। এগুলো পরিহার করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি এবং এ ব্যাপারে ঐসব মাধ্যমেও প্রচারণা প্রয়োজন। সমালোচকদের অভিযোগ, এমন খেলায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপচয় হয় অর্থও। আর সেই সুযোগে ব্যবসা করে নিচ্ছে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলো। গবেষণায় দেখা গেছে, গেমারদের ১০ ভাগ এই খেলায় পুরোপুরি আসক্ত। তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত ব্যয় করছে কম্পিউটারে সামনেই। তবে এজন্য সন্তানের প্রতি বাবা-মার উদাসীনতাকেও কিছুটা দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা। লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী |