সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
ধনী-দরিদ্র বৈষম্য
Published : Tuesday, 24 October, 2017 at 6:00 AM, Count : 1074

আবু জাফর সাইফুদ্দিন : ধনী হতে কে না চায়? সম্ভবত পাগল কিংবা শিশু ছাড়া এমন প্রশ্নে কারও ‘না’ মত থাকবে না। কারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই, চাহিদারও অন্ত নেই। ধনীরা তাদের অবস্থানকে মজবুত করার জন্য যেমন বেশি বেশি ধন-সম্পদ লাভের চেষ্টা করে; তেমনি দরিদ্ররা তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য ধন-সম্পদের প্রতি আগ্রহী হয়। 
এই চাওয়া বেশি দেখা যায় সম্পদশালীদের মধ্যে। সম্পদের প্রতি এদের তৃষ্ণা দুর্নিবার ও অসীম। যে যত পায় সে ততই চায়। এই নেশায় গরিবের সম্পদের হাত দেয় তারা। গরিবেরা হয় তখন শোষিত। 
রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় রয়েছে এমন রুঢ় বাস্তবতা। কবিতার একাংশে কবি বলেছেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় যার আছে ভুরি ভুরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি...।’ কবিতাটি লেখার পেছনে একটি কাহিনীর কথা জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে তার পৈতৃক কুঠিবাড়িতে আশপাশের জমিদারির দেখাশোনা করছেন। খবর পেলেন তার এক নায়েব একজন গরিব প্রজার জমি জোরদখল করেছে। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ জমিদার রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিবাদস্বরূপ ওই কবিতাটি রচনা করলেন। 
ধনী হওয়ার অদম্য প্রতিযোগিতা এ যুগেও আমরা দেখছি। যেমন একদিনের জন্য হলেও বিশ্বের ‘শীর্ষ ধনী’র তালিকায় ওঠার এক বিস্ময়কর গল্প শুনেছি আমরা। গল্পের নায়ক নাম ‘জেফ বেজোস’। একজন মার্কিন উদ্যোক্তা। অ্যামাজন ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে টপকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন জেফ বেজোস। ফোর্বস সাময়িকীর তথ্য অনুসারে, গত ২৭ জুলাই ২০১৭, পুঁজিবাজারে অ্যামাজনের শেয়ারের দাম ২.৫ শতাংশ বাড়ার প্রভাবে বেজোসের মোট সম্পদমূল্য বিল গেটসকে ছাড়িয়ে যায়। হিসাব অনুযায়ী বেজোসের মোট সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিল গেটসের চেয়ে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি। কিন্তু হঠাত্ করে অ্যামাজনের শেয়ারের দরপতনে শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকে ছিটকে পড়েন বিজোস। ফলে তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনী হিসেবে টিকেছিলেন মাত্র একদিন। গত ২৩ বছরের মধ্যে ১৮ বার বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তির তালিকায় রয়েছেন বিল গেটস। চলতি বছর প্রকাশিত এ তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন জেফ বিজোস। ধনী হওয়ার দৌড়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও তৃতীয় থেকে হুট করে বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় নাম লেখাতে পারলেন জেফ বেজোস। 
জীবযাত্রার উন্নয়নে দরিদ্ররা ধনীতে উন্নীত হতে আর ধনীরা আরও ধনী হওয়ার প্রত্যয়ে শ্রম ব্যয় করেন, মেধা খাটান। এই প্রক্রিয়ায় দরিদ্রতা হ্রাস পায়, আর বাড়ে ধনীর সংখ্যা। পরিবর্তনশীল জগতে এই ধারাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন আসে তখনই- যখন দেখা যায় ধনীর সংখ্যা কমছে। ধনীর সংখ্যা কমার মানে হলো- সম্পদ কুক্ষিত হয়ে পড়ছে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে।
ধনী ও দরিদ্র, উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব- এমন বিভাজনে বিশ্বের মানুষ এবং বিশ্ব ব্যবস্থা। জীবযাত্রার উন্নয়নে দরিদ্ররা ধনীতে উন্নীত হতে আর ধনীরা আরও ধনী হওয়ার প্রত্যয়ে শ্রম ব্যয় করেন, মেধা খাটান। এই প্রক্রিয়ায় দরিদ্রতা হ্রাস পায় আর বাড়বে ধনীর সংখ্যা। পরিবর্তনশীল জগতে এই ধারাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন আসে তখনই- যখন দেখা যায় ধনীর সংখ্যা কমছে। 
চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘অক্সফাম’ সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভায় চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করে। সংস্থাটি গবেষণ করে দেখিয়েছে- বিশ্বের অর্ধেক (৩৬০ কোটি) মানুষের মোট সম্পদের পরিমাণ শীর্ষ ৮ ধনীর সম্পদের সমান। অক্সফামের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- বর্তমানে অতি ধনী ও দরিদ্রতম ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়েছে। সম্পদের এই বৈষম্যকে ‘অসঙ্গত’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্যানুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ আট ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ ৪২৬ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটসের মোট সম্পদের পরিমাণ ৭৫০০ কোটি ডলার। অন্যদের মধ্যে অ্যামানসিও ওর্তেগা ৬৭০০ কোটি ডলার; ওয়ারেন বাফেট ৬০৮০ কোটি ডলার; কার্লোস স্লিম ৫ হাজার কোটি ডলার; জেফ বেজস ৪ হাজার ৫২০ কোটি ডলার; জাকারবার্গ ৪ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার; ল্যারি অ্যালিসন ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার এবং ব্লুমবার্গ ৪ হাজার কোটি ডলার সম্পদের মালিক। ২০১৬ সালের অক্সফামের একই ধরনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীর অর্ধেক পরিমাণ সম্পদ ৬২ জন অতি ধনীর হাতে ছিল। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ৯ জনে নামিয়ে আনা হয়। ওই সময়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে দরিদ্র মানুষের আয় ১০ শতাংশ বেড়েছে যা মাথাপিছু ৬৫ মার্কিন ডলার। একই সময়ে বার্কি ১ ভাগ ধনী যারা বিশ্বের সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন তাদের আয় বেড়েছে দরিদ্র মানুষের চাইতে ১৮২ গুণ বেশি এবং এর পরিমাণ মাথা পিছু ১১ হাজার ৮০০ ডলার। সংস্থাটির আন্তর্জাতিক প্রধান নির্বাহী উইনি বাইয়ানিমা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ একেবারেই অল্প কিছু মানুষের হাতে রয়েছে। অথচ এখনও পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের একজন মাত্র ২ ডলারে দিন চালায়। বৈষম্যের কারণে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ছে। এটা আমাদের সমাজ ও গণতন্ত্রের মধ্যে ফাটল তৈরি করছে।’
ধনী-দরিদ্র বৈষম্য এখন গ্লোবালাইজড হয়ে পড়েছে। এতক্ষণ উন্নত দেশের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ঘাটাঘটি করলেও এর ঢেউ উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়ছে না, তা নয়। আয় বৈষম্যে বাংলাদেশও এগিয়ে যাওয়ার কথা জানা গেছে। গত ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপের-(২০১৬) ফল প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই জরিপ করা হয়েছে। সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই জরিপ করা হয়। এতে দেখা যায় গরিবদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ কমে গেছে, ধনীদের তা বেড়েছে। বিবিএস বলছে, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী। আর মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। যদিও সামগ্রিকভাবে দেশের দারিদ্র্য কমেছে। যেমন, গত ৬ বছরে সার্বিক দারিদ্র্যের হার সাড়ে ৩১ শতাংশ থেকে কমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। মূলত ধনী-গরিব নির্বিশেষে আয় বৃদ্ধির কারণেই দারিদ্র্য কমেছে। তবে এই আয় বৃদ্ধির দৌড়ে গরিবের চেয়ে ধনীরাই বেশি এগিয়ে। 
সমাজতান্ত্রিকরা খুবই কঠোরভাবে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে। সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অন্যতম কারণ হলো পুঁজিবাদের দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক অসমতা। একই সমান সুবিধা, সম্পদ ও মর্যাদা লাভ করা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। কিছু লোক লুটতরাজ করে সম্পদের পাহাড় গড়বে আর কোটি কোটি মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করতে পারবে না- এমন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিরই নামান্তর বলে মনে করে এ মতবাদ। কার্ল মার্ক্সের মতবাদ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেয়া যায়- শ্রমের বিনিময় মূল্য অর্থাত্ শ্রমিককে প্রদত্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য সব সময় বেশি থাকে। ব্যবহারিক মূল্যের এই উদ্বৃত্ত অংশকে তিনি ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এই উদ্বৃত্ত মূল্যকে পুঁজিপতিদের ‘চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত মূল্য’ বলে গণ্য করেছেন। 
‘মহাত্মা গান্ধী বলেছেন- ‘সামজের মানুষ তার চাহিদার চেয়ে বেশি নিলে তা চুরির শামিল। এই চুরি কেননা কোনো মানুষের কাছ থেকে করা হয়। দৈনন্দিন চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও তার উত্পাদন বাড়িয়ে চলেছে। প্রত্যেক মানুষ যদি প্রকৃত চাহিদার অতিরিক্ত সংগ্রহে লিপ্ত না হয়, তাহলে পৃথিবীতে কোনো মানুষই অনহারে মৃত্যুবরণ করবে না। সমাজে অসাম্য মানেই কোনো না কোনো শ্রেণি ব্যাপক লুণ্ঠনে লিপ্ত আছে। এই লুণ্ঠনের মাত্রা কমে গেলে সমাজে অসাম্য দূরীকরণ সম্ভব হবে।’ (‘মহাত্মা গান্ধীর লেখা ও বক্তব্য’ দেশ, ২ এপ্রিল ২০০৬)। 
লেখক : সাংবাদিক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com