শিরোনাম: |
প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে হবে
|
![]() সারাবিশ্বের সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে ফেসবুক। এছাড়া স্কাইপি, টুইটার, ফ্লিকার, মাইস্পেস ডায়াসপোরা, অরকুট প্রভৃতি মাধ্যমও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বিনাখরচে ফেসবুকের সদস্য হয়ে বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করা যায়। লগ-ইন অবস্থায় একজন অন্যজনের সঙ্গে চ্যাট করা, প্রোফাইল দেখা, মেসেজ ও ছবি পাঠানো, ছবিতে মন্তব্য লেখা এবং প্রফাইলে ছবি যুক্ত করতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমের সুফল প্রতিদিন ভোগ করছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু প্রযুক্তির উপকারী এ মাধ্যমটির ব্যবহার আমাদের শিশু-কিশোররা কীভাবে করছে দেখা যাক। জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমাদের শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশই নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারছে। দিনের বেলায় তো আছেই তার ওপর রাত জেগে ফেসবুক, ইমু ইত্যাদির অপচর্চার মাধ্যমে নিজেদের শরীর মনকে বিকশিত করছে ভিন্নভাবে। বয়সের চেয়ে যৌন বিষয়ে বেশি পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আড়ালে-আবডালে তারা এসবের চর্চাও করছে। পাশাপাশি লেখাপড়ারও বারোটা বাজাচ্ছে। মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থী যদি রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত ফেসবুকে থাকে তাহলে বিষয়টি উদ্বেগের তো বটেই। জরিপ বলছে, এ ধরনের শিক্ষার্থী সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করছে। রাত জেগে তাদের আড্ডার বড় অংশজুড়েই থাকে রগরগে কথাবার্তা। এ কথাবার্তার এক পর্যায়ে নিজেদের অজান্তেই তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের যৌন কর্মকাণ্ডে বন্ধুদের মাঝে বিনিময় করছে নুড ছবি বা ভিডিও। এক পর্যায়ে স্কুল কিংবা কোচিং ফাঁকি দিয়ে লিপ্ত হচ্ছে বাসনা পূরণে। আর এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিজেদের সর্বনাশ করছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়; মোবাইলের মাধ্যমে রগরগে ওয়েবসাইটেও সহজে প্রবেশ করছে অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েরা। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মোবাইল ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশই এর মাধ্যমে পর্নো দেখে। অনেক সময় এতে আসক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদের নুড ছবি বা ভিডিও ধারণ করে বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময় করে। এরপর কখনো বন্ধুত্বের ফাটল ধরলে এ ভিডিও বা ছবিগুলো ইন্টারটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এর সত্যতা পাওয়া যায় সম্প্রতি দ্য ইনডিপেনডেন্টের অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি অবাধ হওয়ায় স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই তরুণরা ভয়াবহ এ নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষকের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ সম্পর্কে জানেন দুই-তৃতীয়াংশ বা শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ শিক্ষক। তারা বলেছেন, অনলাইন থেকে যৌনতায় আসক্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি ছয়জনের একজন হলো প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়া বয়সী। যেসব শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তাদের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলেছেন, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এসব শিক্ষার্থী নিজেদের নগ্ন ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেসব শিক্ষার্থী নরম মনের, শান্তশিষ্ট তাদের এসব ছবি পাঠিয়ে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে, তাদের যৌন হয়রানি করার জন্য এসএমএস দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; শিক্ষকরা বলেছেন, ক্লাসের পড়া চলাকালীনও কিছু শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন চালায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে তারা অপকর্মও করছে। কেউ কেউ নিজেদের জন্য একটি গ্রুপ তৈরি করেছে। ওই গ্রুপের সদস্যরা অন্যদের রেটেড ছবি গোপনে তুলে তা প্রকাশ করে দিচ্ছে সেই গ্রুপে। আরেকটি গ্রুপ একটি ভুয়া পেজ চালু করেছে। এটা ব্যবহার করে অন্যকে তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বা উত্সাহিত করা হচ্ছে। শিশুদের দাতব্য সেবদানকারী প্রতিষ্ঠান বার্নাডো এ ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন পর্নোগ্রাফি ও অন্য ক্ষতিকর অনলাইন শিশুদের মাথা বিকৃত করে তাদের বিপথে পরিচালিত করতে পারে। এতে তাদের স্বাস্থ্যগত সম্পর্ক ও অন্যান্য ধারণাই পাল্টে যাবে।’ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন আমাদের দেশের অভিভাবকরা। তারাও এর প্রতিকার চাচ্ছেন। গেল বছর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে একটি সম্মেলন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। এতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের বর্তমান চিত্র ও ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন অনেক সরকারি-বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা। তারা বলেন, মোবাইল ফোনের পাশাপাশি ফেসবুকেও আসক্তি বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের। এগুলো শিক্ষার ওপর বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার স্কুলশিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় কেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রিচার্ড মারফি ও লুইস-ফিলিপ বেলান্ড গবেষণা করেন। তারা গবেষণার জন্য ৯১টি ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল পর্যবেক্ষণ করেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পর্কে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন নিয়ম আছে, যার সঙ্গে ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল তুলনা করে দেখা হয়। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নম্বর শতকরা ৬.৪ ভাগ বেড়েছে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল খুব বেশি ভালো নয়, তাদের ক্ষেত্রে নম্বর বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অপরদিকে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছেন। মাদকের মতো তরুণ বয়সীরা বর্তমানে মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে সুশীল সমাজ। মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে তারা তাদের মেধাকে ধ্বংস করছে, অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে বলে তিনি মত দেন। ইদানীং প্রজন্মের মধ্যে মোবাইল ফোনের নেশা তৈরি হয়েছে। মোবাইল ফোনের অপব্যবহার ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে তাদের মধ্যে। এ অপব্যবহারের কারণে কিছু কিছু তরুণ ইভটিজিং, বখাটেপনাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তারা গভীর রাতে ফোনালাপে ব্যস্ত থাকছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে অভিভাবকদের অনুরোধ জানাচ্ছেন বিজ্ঞজনেরা। শিশু-কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ায় ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে বলেও শিক্ষাবিদদের অভিমত। মোবাইল আসক্তি যে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বা নৈতিক স্খলন ঘটাচ্ছে শুধু তাই নয়; তাদের মানসিক ও স্বাস্থ্যের ওপরও যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মোবাইলে আসক্ত শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ হচ্ছে অন্যভাবে। তাদের চিন্তাজুড়ে থাকছে ফেসবুক, ইমো, ভাইভার, স্কাইপের আবেগ অথবা গেমসের নানা চরিত্র। এ ধরনের আসক্তিতে জড়িয়ে একদিকে যেমন তাদের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে, অন্যদিকে নানা ধরনের গেমসের চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে জড়াচ্ছে অপরাধে; এমনকি প্রাণও বিসর্জন দিচ্ছে। ব্লু হোয়েল গেমসটি এর অন্যতম উদাহরণ। এ জন্য প্রতিটি মা-বাবার উচিত শিশুদের প্রযুক্তির হাতে ছেড়ে না দিয়ে পর্যাপ্ত দেখাশোনা করা, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, গঠনশীল আলোচনা করা। বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়াদের মোবাইলের অপব্যবহারের জন্য মূলত কারা দায়ী, সে দিকটিও আলোচনা করা প্রয়োজন। এক কথায় বলা যেতে পারে, এ জন্য শিশু-কিশোররা যতটা দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী অভিভাবকরা। কারণ তারা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক অথবা অতিরিক্ত স্মার্ট বানাতেই হোক সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়েই দায় সারছেন। তারা কখনো খোঁজ রাখছেন না তাদের সন্তানরা এ ফোনটির সঠিক ব্যবহার করছে কি-না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু-কিশোরদের সামনে আজ প্রযুক্তির অনেক মাধ্যম আগ্রাসনের হাতছানি দিচ্ছে। তারা নিজেদের অজান্তেই তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে মেধা-চরিত্রের বারোটা বাজাচ্ছে। আবেগের ওপর ভর করে চলা শিশু-কিশোররা প্রযুক্তির ভালোমন্দ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে না। তারা জানে না একটি ভুলই সারা জীবনের কান্না হতে পারে। তাই প্রযুক্তির আগ্রাসনের করাল গ্রাস থেকে রক্ষার জন্য এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের পরিষ্কার করে বোঝাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বাস্তবে তামিল সিনেমার নায়ক-নায়িকা হওয়া সম্ভব নয়। আজ যদি বিষয়টি আমরা আমলে না নিই, তাহলে আগামীতে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে, যা আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী |