শিরোনাম: |
বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ভাষণ বাঙালি জাতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
|
![]() মাত্র ২১ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণে জাতির পিতা বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি তার সেই সম্মোহনী বক্তৃতায়। ঢাকার সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানে জনসমুদ্রের মঞ্চ কাঁপিয়ে তার সেই ভাষণ বাঙালিকে নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ দিক নির্দেশনা। যে দিকনির্দেশনায় ছিল বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সাধনা, সততা, নিষ্ঠা, আদর্শ, রজনৈতিক দূরদর্শিতা ও রণকৌশল। ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি শব্দই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উজ্জীবিত করার দৃঢ় চেতনা। তিনি তার ভাষণে উদ্দিপ্ত কণ্ঠে জনসমুদ্রে বলেছিলেন, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলনে, ‘...তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আরও ঘোষণা দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণে উত্তাল জনসমুদ্রে জনতা গগনবিদারী কণ্ঠে ‘জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু’ ধবনিতে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানিয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এরপরই জনতা যে যার এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠন করে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। প্যারিসে ইউনেসকোর প্রধান কার্যালয়ে ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর চার দিনের এক সভায় বসেছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। সেখানে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল নিবন্ধনের জন্য ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আইএসির এই কমিটিতে ছিলেন ১৫ জন বিশেষজ্ঞ। এর চেয়ারম্যান ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আলরাইজি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রস্তাব করা ঐতিহাসিক দলিল পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করেন। দুই বছরের প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬-১৭ সালের জন্য দলিলগুলোকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মনোনয়নগুলো সম্পর্কে সুপারিশ করে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা বলেন, ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ কর্মসূচি পরিচালিত হওয়া উচিত দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা তাদের মনে লালন করতে পারে।’ ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা গত ৩০ অক্টোবর প্যারিসে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণটিকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত জানান। এটিই এমওডব্লিউ’তে সংরক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক কোনো দলিল। ফলে সারা বিশ্ব এখন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বিজয় সম্পর্কে আরও বেশি করে জানতে পারবে। ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যে কেবলই একটি ভাষণ নয়, এটি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। ৭ মার্চের কালজীয় ভাষণকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানে বাঙালি জাতির জন্য এনে দেয় একটি মহা অর্জন। যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চির অম্লান হয়ে থাকবে। বাঙালির ইতিহাস পুনর্জাগরণের ইতিহাস। এ পুনর্জাগরণের ধারায় আজ বাংলাদেশ বিশ্বের এক উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। এ দেশের ১৬ কোটি জনগণের ত্যাগে শ্রমে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত এ দেশ আজ অনেক দেশের উন্নয়নের প্রেরণা। তবে বাংলার তথা বাংলাদেশের আজকের এ অবস্থানের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির ইতিহাস, রয়েছে এক মহানায়কের তেজোদ্দীপ্ত ও সুনিপুণ নেতৃত্বের ইতিহাস। পুনর্জাগরণের মানে হলো ইতিপূর্বে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী এক জাগরণ বা রেনেসাঁয় অংশ নিয়েছিল। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ এবং সবশেষে ১৯৭১- এই ২৩ বছর ধরে সে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। এ সময়ে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত সংগ্রাম কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কখনও ছাত্রদের বিজ্ঞানভিত্তিক, সর্বজনীন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্তশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম এবং এই পুরো সময়জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উপযোগী সুস্থ-সবল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম এসব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের। যার ঢেউ শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ মাসে। সেই মার্চে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এ বাংলার মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি সেই ’৪৮ থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে। আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে সামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অমর সেই ভাষণটি ক্যালেন্ডারের একটি তারিখকে মহাকালের দেয়ালে সূর্য চিহ্ন এঁকে দিয়ে অনন্তকালের জন্য ভাস্বর করে দিল, সেটি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ২৩ বছর ধরে তিল তিল করে রচিত সংগ্রামের পথ বেয়ে মহাজাগরণের এ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলের, যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে মূলত স্বাধীনতার ঘোষণাই নিহিত ছিল। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর বহুদর্শী ও সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা, পরিমিতি বোধের বহির্প্রকাশ ঘটেছিল ৭ মার্চের ভাষণে। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিব ওইদিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। কী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন তা সবারই মোটামুটি জানা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি। ওই নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। সামরিক আইনের অধীনে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পাওয়ার পর বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাত্ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ওই ষড়যন্ত্রের কারণে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এটা ছিল বাঙালিদের ওপর যুদ্ধপূর্বকালীন সবচেয়ে বড় আঘাত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বুঝতে পারলেন এদেশকে স্বাধীন করার বিকল্প আর কোনো পথ খোলা নেই। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ আয়োজিত শ্রমিক-জনতার এক সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারাদেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চলল। সারাদেশে তখন একজন মাত্র নেতা। তিনি হচ্ছেন দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা। দেশের সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। তবে এ অঞ্চলে শেখ মুজিবের কথাই তখন আইন। তার নির্দেশে সমগ্র বাংলাদেশ পরিচালিত হতে থাকে। সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এল ৭ মার্চ। সবার দৃষ্টি ওই দিনটির দিকে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী বলবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবিয়ে তুলল পাকিস্তান সামরিক চক্রকেও। কারণ তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে শেখ মুজিবের কথায়। চিন্তিত পাকিস্তান সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাত্ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তত্কালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার কথায় কর্ণপাত করেননি। কারণ তিনি জানতেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তির আর কোনো পথ খোলা নেই। আর এ জন্য জাতির জন্য দরকার সুস্পষ্ট দিন নির্দেশনা। পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবিলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না। এমন এক কঠিন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন, তেমনি যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ... যা হোক, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তত্কালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও বিশ্ব-সম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। সব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধিরা ঢাকায় উপস্থিত থেকে ভাষণের বিবরণ প্রদান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়; বিশ্ব নেতারা ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও এ ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণার পরই পুরো বাঙালি জাতি যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বাঙালিদের এই মনোভাব আঁচ করতে পেরেই ২৫ মার্চ রাতে নৃসংশভাবে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। এরপর যা ঘটে তা বিরাট ইতিহাস। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষ নেয় দুই বিশ্ব পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পক্ষ নেয় পাকিস্তানের। যা হোক দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে উদয় হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। আর এর পেছনে রয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ ও লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতহানি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মহাকবির বজ্রকণ্ঠের এক মহাকাব্যিক উচ্চারণ, এতে উজ্জীবিত হয়েই বাঙালি জাতি মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। তখন সমরাস্ত্রে বাঙালি পাক হানাদার বাহিনীর তুলনায় অতি সামান্য হলেও বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণাশক্তি ছিল অপরিমেয়। আর এ প্রাণশক্তির উত্স ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ। তাই তো ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলেও এ দেশের মুক্তির সংগ্রামে ভাটা পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই মন্ত্রকে হূদয়ে ধারণ করে যুদ্ধ চালিয়ে যায় বাঙালি। তাই এক কথায় বললে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা এবং ওই ঘোষণার ফসল আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান |