ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম : প্রায় সব কয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চলছে ভর্তুকির মাধ্যমে। সরকার প্রতি বছর দিচ্ছে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি। যেসব সংস্থায় মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিজেএমসি, বিআইডব্লিউটিসি, আরডিএ, বিআইডব্লিউটিএ, বিএসসিআইসি, বিএসবি, ইপিবি, বিএডিসি, বিডব্লিইডিবি, এনএইচএ, বিএসআরটিআই ইত্যাদি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দেয়া হয় ২ হাজার ১৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রতি বছরই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। আর যে সব সংস্থায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই বাণিজ্যিক। সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে চালাচ্ছে। তবে ভর্তুকির বাইরে রাখা হয়েছে কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থাকে। এই শিল্পের সঙ্গে লাখ লাখ চাষি জড়িত। আছে ২০-২২ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার। বিশ্বের সেরা ও মানসম্পন্ন চিনি উত্পাদন করছে এই সংস্থাটি যদিও চাহিদার তুলনায় কম। কাঁচামালের সঙ্কটসহ নানা কারণে এই সংস্থাটি চাহিদার তুলনায় চিনি উত্পাদন করতে পারছে না। তারপরও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যে কথাটি উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো এই সংস্থা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় চিনি উত্পাদন করতে না পারায় এর সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি আমদানিকারক ও ৫/৬টি পরিশোধনকারী মিল মালিক। তারা চিনির নামে বাংলাদেশের জনগণকে ‘বিষ’ (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষনাকারী প্রতিষ্ঠান এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা পরিশোধিত মিহিদানার চিনিকে বিষের সঙ্গে তুলনা করেছেন) খাওয়াচ্ছে আর দু’হাত ভরে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে ভোক্তা সাধারণ না জেনেই বেশি দাম দিয়ে ‘বিষ’ খেয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পকে সরকার ভর্তুকি না দেয়ায় অনেকটা লড়াই করেই সেটি এগিয়ে যাচ্ছে। ধার-দেনা করেই চলতে হচ্ছে এই সংস্থাটিকে। অনেকটা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো’। সময় মতো শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়া যায় না, জরুরি উন্নয়ন ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরও সরকারকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছে। অথচ অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা যেগুলো লাভে চলার কথা সেগুলোকে সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে অনেকটা আশার কথা হচ্ছে যে, গত প্রায় তিন বছর যাবত্ চিনি শিল্পের লোকসানের পরিমাণটা কমে আসতে শুরু করেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে নীট লোকসান ছিল ৫৬৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা কমে প্রায় ৪৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত দুই বছরে উত্পাদনও কিছুটা বেড়েছে। এই সংস্থার অধীনস্থ ১৫টি চিনিকলের মধ্যে বেশিরভাগই দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় সেগুলোর উত্পাদন ক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এগুলোর উন্নয়নও জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া আখ চাষ বৃদ্ধি ও দাম বৃদ্ধি করাও দরকার বলে মনে করছেন। তবে অনেকটা আশার কথা হলো যে, এই সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পের উন্নয়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ ও পরিকল্পনায় আছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নর্থবেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত্ ও সুগার রিফাইনারি স্থাপন। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৪ দশমিক ১৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত্ উত্পাদন করে চিনিকলের নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় একটি সুগার রিফাইনারিও স্থাপন করা হবে। যার মাধ্যমে ‘র’ সুগার হতে হোয়াইট সুগার উত্পাদন করে দেশে চিনির চাহিদা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখা হবে। ঠাকুরগাঁও চিনিকলের পুরনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন এবং সুগারবিট থেকে চিনি উত্পাদনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় অবস্থিত চিনিকল ও ডিস্টিলারি কারখানা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লি.। এর আধুনিকীকরণের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে বিএমআর প্রকল্প। এতে ৭৩ বছরের পুরনো যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিনিকলটির বর্তমান আখ মাড়াই ও চিনি উত্পাদন ক্ষমতা সংরক্ষতি হবে। এছাড়ও সাম্প্রতিক অন্যান্য যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে তা হলো সনাতন পুর্জি প্রথার পরিবর্তে একটি মোবাইল এসএমএস’র মাধ্যমে সব আখচাষির কাছে মিলে আখ সরবরাহের আগাম বার্তা পৌঁছে দেয়া (ই-পুর্জি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর একযোগে সব চিনিকলে ই-পুর্জি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এর ফলে লাখ লাখ চাষির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল সেবা। নিশ্চিত করা হয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। ই-পুর্জির সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ভারতের মস্থন অ্যাওয়ার্ড সাউথ এশিয়া ২০১০ পুরষ্কার লাভ করে। এছাড়াও ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ২০১০-এ ই-সেবা ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরষ্কার লাভ করে। ই-পুর্জি ব্যবস্থাপনায় সফলতার পর সেবার পরিধি আরও বিস্তৃতি করতে চালু করা হয়েছে ই-গেজেট। এর মাধ্যমে চাষিরা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে অনলাইনে পুরো মৌসুমের কেন্দ্র ও ইউনিটভিত্তিক আখ ক্রয়ের আগাম কর্মসূচি দেখতে পারেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আখমাড়াই মৌসুমে ফরিদপুর চিনিকলে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হয় এবং চলতি ২০১৬-১৭ আখ মাড়াই মৌসুমে সব চিনিকলে চালুর কর্মসূচি নেয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ব কৃষিভিত্তিক এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা জরুরি। আর সে লক্ষ্যে প্রয়োজন চিনির পাশাপাশি কিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা। শোনা যাচ্ছে যে, জয়পুরহাট ও কুষ্টিয়া চিনিকলে দুটি যৌথ বিনিয়োগে দুটি বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হতে পারে, রাজশাহী চিনিকলে একটি জোসপ্লান্ট হতে পারে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে পুরনো চিনিকলগুলোর সংস্কার হতে পারে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে এই সংস্থাটি অনেকটা রক্ষা পাবে বটে। আর বড় কথা হলো যে, কৃষিভিত্তিক এই সংস্থাটিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার।
|