শিরোনাম: |
ভেজাল খাদ্যে বিপন্ন জনস্বাস্থ্য
|
![]() ভেজাল নেই কোথায়? আমরা যে খাবার খাচ্ছি তা খাবার না বিষ খাচ্ছি? চারদিকে ফরমালিনের জয়জয়কার। মাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, তরকারিতে কোথায় নেই এই জীবনহন্তারক ফরমালিন। তেলে ভেজাল, চালে ভেজাল এমনকি ওষুধেও ভেজাল। কেউ কেউ তো বলেনই বিষেও নাকি ভেজাল। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে হাইপ্রেসার, ক্যান্সার আর হার্টস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রায় প্রতিটি খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষ। আর সেই বিষ খেয়ে আমরা আর সুস্থ নেই। জীবিত থেকেও যেন মৃত। অর্থাত্ জীবনমৃত। খাদ্যে ভেজালের মাত্রা এতটা বেড়েছে যে, মানুষ এখন বিরক্ত হয়ে বলে বিষ খাব? তাতেও তো ভেজাল। আমাদের দেশে ভেজালের যে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন তাতে মনে করা যেতেই পারে সভ্যতার উত্কর্ষকালেও আমরা সভ্যতার মাপকাঠিতে এদিক থেকে আদিম যুগের চেয়েও পিছিয়ে আছি। তাছাড়া নকল-ভেজালের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে অভিযান চললেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। লঘু সাজার কারণে নকল-ভেজাল কারীদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। সারাদেশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মানহীন পণ্য। এর ফলে ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এক শ্রেণির অসত্ ব্যবসায়ী ক্রেতাদের ঠকিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়লেও তা যেন দেখার কেউ নেই। দেশে উত্পাদিত পণ্যের মান প্রণয়ন, প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রী উত্পাদন ও গুণগত মান পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করে মানের নিশ্চয়তা প্রদান বিএসটি আইয়ের কাজ। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও এ কাজের তদারকিতে নিয়োজিত। বিএসটিআই মাত্র ১৫৫টি পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করে। বাকি পণ্যগুলো বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এগুলোতে ভেজাল মেশাচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের যে পদ আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এছাড়া নমুনা সংগ্রহকারীরাও নিয়মিত নন। সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সংখ্যাও অপর্যাপ্ত। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য রয়েছেন সীমিতসংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট। অভিযান পরিচালনার সময় প্রায়ই পুলিশের সঙ্কট দেখা দেয়। এমনিতেই মানহীন কিংবা ভেজাল পণ্য উত্পাদকদের শাস্তি খুব একটা হয় না। এছাড়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতারও অভাব আছে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থাকলেও তার তত্পরতাও সীমিত। ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান অনেকাংশেই রাজধানীতেই সীমিত। ঢাকার বাইরে তত্পরতা নেই বললেই চলে। ভেজাল বন্ধে নকল-ভেজাল অপরাধের দণ্ড বাড়াতে হবে। খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে কোনো খাদ্যই স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বাজারে যেসব জুস ও পানীয় বিক্রি হয় তার সিংহভাগই মানসম্মত নয়। নামিদামি কোম্পানির তৈরি করা মিষ্টি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে যে ঘি, বাটার অয়েল ও ভোজ্যতেল বিক্রি হয় তার সিংহভাগই নকল-ভেজাল। শিশুখাদ্যের মানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। দুধে ভেজালের রাজত্ব বিরাজ করছে যুগ যুগ ধরে। এখন যেসব প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই মানসম্মত নয় বলে অভিযোগ। আম, কলা, আপেল, খেজুর ইত্যাদি ফল খেতে ভয় পায় এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফল পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও রোগাক্রান্ত করছে। খাদ্যে নকল-ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ বা মোবাইল কোর্টের অভিযান যেমন অব্যাহত রাখতে হবে তেমনি এ জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। এমনকি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত এ আপদের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপের বিকল্প নেই। খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে এক নম্বর হুমকি। এ হুমকি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সামাজিক সচেতনতার অভাবে তা কোনো কাজে আসছে না। দেশে সরকার, প্রশাসন আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও ভেজালের দৌরাত্ম্য কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না? নিরাপদ খাদ্য আইন, থাকলেও তাতেও কিছুই এসে যায় না ভেজালকারীদের। দাপট চলছেই। এভাবেই কি চলবে? ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়, সভা সেমিনার হয় কিন্তু ভেজাল রোধ হয় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে কখনোই সচেতন হয়ে ওঠে না। জনগণও না। দেশে নানা ইস্যুতে আন্দোলন হয়, হরতাল অবরোধ হয় কিন্তু ভেজালের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দেয়া হয় না কখনোই। আন্দোলন তো দূরের কথা ভেজালের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করে না কেউ। রাজনীতিকরা চাইলে কয়েক মাসেই ৮০ থেকে ৯০ ভাগ খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব। প্রকৃতই ভেজালকারীদের সংখ্যা এত বেশি যে, ভেজালের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমাদের রাজনীতিকদের উল্টো না ভেজালে জড়িয়ে পড়তে হয় এ ভয়ে হয়তো তারা শব্দ করেন না। হাসপাতালগুলোতে কত ধরনের রোগ-বালাই নিয়েই না ছুটছে মানুষ। মানুষ যত না বাড়ছে তুলনামূলক হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে। এ কথা সত্য যে, ভেজাল খেয়ে মানুষ শুধু অসুস্থই হচ্ছে না, ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ভেজাল রোধ না হলে, খাদ্যে ভেজালের গতি এমনটাই যদি থাকে তাহলে যে হারে মানুষ মরবে তা শুধু দেশবাসীকেই নয়, যারা সারাবিশ্বে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন তাদেরও মাথাব্যথার কারণ হবে। দেশে ভেজালবিরোধী জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটিতে সত্ এবং যোগ্য চলতি দায়িত্বে থাকা এবং অবসরপ্রাপ্ত আমলারা থাকবেন। অবসরপ্রাপ্ত সত্ ব্যক্তিদেরও এ কমিটির আওতাভুক্ত করতে হবে। খাদ্যে ভেজালে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। প্রকাশ্যে সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। সাজা হতে হবে শারীরিক এবং আর্থিক। র্যাবকে ভেজালের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ৬ মাস মাঠে রাখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভেজালের বিরুদ্ধে র্যাবকে মূল ভূমিকায় রাখা যেতে পারে। ৬ মাস প্রতিটি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যকর থাকতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজালবিরোধী জাতীয় কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। নিকট অতীতে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল এমন মাছের বাজারে মাছি নেই। প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে ভয়াবহ মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ বিষই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু হাসপাতালগুলোয় গেলেই বোঝা যায় কত প্রকার রোগই না এখন মানবদেহে ভর করে আছে। আসলে আমরা জেনেশুনেই বিষ খাচ্ছি। আমে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ মেশানো খাবারগুলোই সপরিবারে আমরা গিলে চলেছি। ভেজালের এ বৃত্ত থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাই মিলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনোই সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সর্বতভাবে তত্পর হতে হবে। দেশের আমজনতা, রাজনীতিক বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে। সর্বোপরি গণমাধ্যমসহ ব্যাপক জনসচেতনতাও প্রত্যাশিত। তবেই হয়তো ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে। তাছাড়া খাদ্যসামগ্রী ও কৃষি উত্পাদনে ব্যাপক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশের সাধারণ ভোক্তারা উত্কণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। ভেজালের বিরুদ্ধে আইনের যথার্থ প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে খাদ্যে নকল-ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে নকল-ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নেবে আমরা তেমনটিই দেখতে চাই। লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী। |