শিরোনাম: |
রোহিঙ্গা এবং দেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি
|
![]() তেমনি একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে। কথা উঠেছে বাংলাদেশের বর্তমানে ষোলোকোটি মানুষের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে আসা দশলাখ শরণার্থীকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা বাংলাদেশের সরকার এবং মানুষের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো তারা কী খেল কী পড়ল সেটা নিয়ে নয়। তাদের এখানে থাকার সঙ্গে বিরাট অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ জড়িয়ে রয়েছে। শরণার্থীরা সমস্যায় পড়েই হয়তো সীমান্তের এপাড়ে আমাদের বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে এসেছে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কোমলমতি মানবিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এমনি একটি পরিস্থিতিতে প্রচুর মানুষকে শরণার্থী হতে হয়েছিল। কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ-ভারত আবার মিয়ানমার-বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোটেও এক নয়। এখন হয়তো দেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কারণে যেহেতু কিছু না কিছু বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে খুবই অপ্রতুল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে এভাবে রোহিঙ্গাদের ঢল আসতে থাকলে তাদের শুধুমাত্র খোরাকির জন্য বছরে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেটা কতদিন থাকবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। যদিওবা সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে মিয়ানমার শরণার্থীদের আগামী সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা এবং পূর্বাভিজ্ঞতা কোনোটাই সুখকর নয়। কাজে যদি বছরের পর বছর তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকে তাহলে তাদের জন্য বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তা সম্পূর্ণভাবে অনুত্পাদনশীল খাতে। তারা কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায় থেকে সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতিকে দিনকে দিন নষ্ট করে তুলছে যা পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারের সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত নষ্ট করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাম্প্রতিক চালু হওয়া মেরিন ড্রাইভ। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির কথা বলতে পারি। এ বছরেরই (২০১৭) জুলাই মাসে সপরিবারে আমি কক্সবাজারে গিয়ে সেখানকার বিপুল পর্যটন সম্ভাবনাময় মেরিন ড্রাইভ দেখে এসেছি। সেখানে ৮০ কিলোমিটারের একটি রাস্তা হয়েছে মাত্র, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস পূর্বে উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু সেই রাস্তাকে কেন্দ করে চারদিকে হোটেল মোটেল, আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট ইত্যাদি তৈরি করে কয়েক বছরের মধ্যেই সেই মেরিন ড্রাইভকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। কিন্তু এখন সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়ের কারণে সেই বিপুল সম্ভাবনাময় মেরিন ড্রাইভ তার কতটুকু সফল হতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ মেরিন ড্রাইভের পাশের পাহাড়গুলোর গা ঘেঁষেই তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প ও আবাসস্থল। যদিও অস্থায়ী বলা হচ্ছে সেটি কী আসলেই অস্থায়ী হয় নাকি কতদিন স্থায়ী হবে তা কেউই বলতে পারবে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেসব চিন্তা করা যায় তার সবটুকুই শুধু মানবিকভাবে করলে চলবে না। কারণ এদের সঙ্গে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে যা আমরা কোনোভাবেই ফেলে দিতে পারিনা। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে চলে আসছে কিছু মহামারী রোগবালাই। আতঙ্কের সঙ্গে জানা গেছে আগত বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ১২৭ জন নারী পুরুষ ও শিশু রয়েছে যাদের শরীরে মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু। আমরা জানি, রোহিঙ্গাদের সেদেশ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে তারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। সেটি পুরোপুরি সত্য না হলেও তার আংশিক সত্যতা রয়েছে। আর সে কারণেই সেখান থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সেখানকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী নেতারাও আমাদের দেশে এসে এ সুযোগে আশ্রয় নিচ্ছে। আর আমরা এও দেখতে পাচ্ছি তাদের অর্থ ও খাদ্যের লোভ দেখিয়ে আমাদের দেশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা তাদের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এবং কেউ কেউ ব্যবহূত হচ্ছেও। তারা আবার দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কেউ কেউ বাংলাদেশের একশ্রেণির দালালদের সহায়তায় পাসপোর্ট তৈরি বাংলাদেশের নাম ভাঙিয়ে বিদেশে গিয়েও সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। ইতিপূর্বে যারা রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে সেখানে বসবাস করছে তারা সুযোগ বা ফাঁক পেলেই সে কাজ করে বেড়াচ্ছে। অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ সুযোগে চোরাকারবারিদের তত্পরতা বেড়ে যাওয়া। এ চোরাকারবারিদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে মরণ নেশা ইয়াবা, বার্মিজ বিভিন্ন অবৈধ জিনিসপত্র অপরদিকে রয়েছে মানব পাচার, দালালদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি। সেসব করে প্রচুর দেশীয় মুদ্রা লুণ্ঠন করে চলেছে। এতে সার্বিক অর্থনীতি টান পড়ছে। আমরা বিগত অনেক বছর থেকে বিশেষত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলগুলোতে দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি হতে দেখা যায়নি। উপরন্তু কয়েক বছর আমরা খাদ্য কিছুটা হলেও রফতানি করে দেখাতে পেরেছি। নেপালের ভূমিকম্পে আমরা খাদ্য সাহায্যও পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু এ বছর দেশের অব্যাহতভাবে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত দেশের অন্যতম ধান ও মাছের ভাণ্ডারখ্যাত হাওর এলাকায় বন্যার আঘাত, পরে জুলাই আগস্টে দেশের উত্তরাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপ কাটাতে এ বছর বিশ লাখ টন টন খাবার বিদেশ হতে আমদানির প্রয়োজন হয়েছে। তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বানের জলের মতোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল। এরই মধ্যে ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে অক্টোবরের শেষ নাগাদ তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান দেয়ার মতো প্রধান প্রধান মৌলিক চাহিদা মেটানো হচ্ছে। যে কারণে দেশ-বিদেশে সরকার ও দেশের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে চারদিকে। এমনকি এ সমস্যাটির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ দেখানোর জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামও এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের খাতায় উচ্চারিত হয়েছে। তাকে দেয়া হয়েছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব। এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণসহ তাদের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ বাত্সরিক ব্যয় হতে চলেছে এতে করে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা এভাবে আমাদের সামমের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর এক্ষেত্রে বিশেষ করে আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী এবং দীর্ঘদিনের মিত্ররা যদি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে তবে আমাদের সামনের দিনগুলোতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে বৈকি! সেখানে চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম ও অমুসলিম দেশসমূহ শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেখানে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, দেশগুলো সত্যিকার অর্থেই কার্যকরভাবে আমাদের সঙ্গে আছে নাকি আমাদের অগ্রসরমান ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শ্লথ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। যদি দ্বিতীয়টি হয় সেখানে আমাদের মানবতার পাশাপাশি দেশের এবং দেশের নিরাপত্তা তথা আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতির এ অগ্রযাত্রা অর্জনে আমরা যে কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছি তা যেভাবেই হোক না কেন ধরে রাখতে হবেই। তাতেই আমাদের দেশের অর্থনীতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আর আমাদের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সেটাই প্রত্যাশা। লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |