শিরোনাম: |
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রসঙ্গে কিছু কথা
|
![]() এটিই আপাতত: সুখবর এবং অনেক দুঃসংবাদের মধ্যেও আশাব্যঞ্জক তথ্য। সম্প্রতি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনশৃঙ্গলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে খবর পাওয়া মাত্রই বাল্যবিয়ের আয়োজন পণ্ড করে দিচ্ছে। সংবাদ পত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিয়ে বন্ধের এ ধরনের বেশ কিছু কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব খবরই মূলত বাল্যবিয়ে নিয়ে হতাশার মধ্যে এসব উদ্যোগ মহাসাহসী এবং প্রশংসনীয়। এখন বাল্যবিয়ে বন্ধের কিছু খণ্ড চিত্র বিবৃত হচ্ছে। দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, স্থানীয় প্রশাসন, ভ্রাম্যমাণ আদালত, বেসরকারি সংস্থা ও এলাকার কিশোরীরা মিলে বাল্যবিয়ে প্রতিহত করায় গ্রামগঞ্জে ধীরে ধীরে কমে আসছে বাল্যবিয়ে। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বাল্যবিয়ে রোধকল্পে আন্তরিকভাবে সক্রিয়। তারা বাল্যবিয়ের খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছেন মেয়ের বাড়িতে। বন্ধ করছেন বিয়ে। এমনকি সরকার এ বছর থেকেই বাল্যবিয়ে রোধকল্পে ভ্রাম্যমাণ আদালতও নিয়োগ করেছে। চার জেলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচটি বাল্যবিয়ে রুখে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এ বছরের ১৪ই অক্টোবর ময়মনসিংহের নান্দাইলে দুটি, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় একটি, টাঙ্গাইলের বাসাইলে একটি ও মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় একটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ইউএনও এর হস্তক্ষেপে চর কোমরভাঙ্গা ও বীরকামটখালী গ্রামে দুটি বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়েছে। খবরে প্রকাশ, উপজেলার বেতাগৈর ইউনিয়নের চর কোমরভাঙ্গা গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেনের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে মরিয়মের সঙ্গে পাশের গ্রামের গার্মেন্টসে চাকরি করা সাইফুল ইসলামের বিয়ের দিন ঠিক ছিল। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে ইউএনও ওই রাতেই মরিয়মের বাবার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে মেয়ের বয়স জানতে চান। মেয়ের বয়স ১৫-১৬ হবে বলে জানান বাবা। তখন ইউএনও ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ের বিষয়ে আইনে নিষেধ আছে জানালে মেয়ের বাবা এ বিয়ে বন্ধ করে। অন্যদিকে একই ইউনিয়নের বীরকামটখালী গ্রামের মৌলানা আমীর উদ্দিনের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে সুমাইয়ার বিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঠেকিয়েছেন ইউএনও। দুই মাস আগে ইউএনও নিজে গিয়ে মেয়ের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিয়ে না দিতে সুমাইয়ার বাবাকে অনুরোধ করেন। এরপরও ১৪ অক্টোবর গোপনে গৌরীপুরের মসজিদের ইমাম আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করছিলেন আমীর উদ্দিন। খবর পেয়ে ইউএনও আমীরকে ফোন করে বিয়ে বন্ধের নির্দেশ দেন, অন্যথায় পুলিশ নিয়ে হাজির হবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। তখন আমীর ইউএনওকে কথা দেন, ১৮ পূর্ণ হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডি (বি আইডিএস)এর ২০১৫ সালের এর জরিপ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে বিয়ের শতকরা হার ছিল ৬২.৬ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশ। ১৫ বছরের নিচে বিয়ের শতকরা হার ছিল ২৩.৮ শতাংশ ছিল। ২০১৭ সালে বি আইডিএস জরিপ অনুযায়ী তা কমে হয়েছে ১০.৭ শতাংশে। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে সব কলেজে সপ্তাহে অন্তত একদিন এক ঘণ্টার একটি সেশনের আয়োজনের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। সম্প্রতি সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। প্রসঙ্গত এ বছর সরকার বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়োজিত করেছেন। গত আগস্টে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় বাল্যবিয়ে দেয়ার সময় তা বন্ধ করে দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলার মেরং ইউনিয়নের ছোট হাজাছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আকবরের সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে কবাখালী এলাকায় তার মামার বাড়িতে এনে বিয়ে দেয়া হচ্ছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেন। এ সময় বাল্য বিয়ে দেয়া ও ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বানানোর দায়ে বাবা আকবরকে আটক করা হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মেয়ের বয়স ১৩ বছর। এ ছাড়া গত ১২ জানুয়ারি নবাবগঞ্জে, ২৯ জানুয়ারি লোহাগাড়াও ৯ জুলাই ঘাটাইলে ভ্রাম্যমাণ আদালত এমন কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেয়। গ্রেস ফর চিলড্রেন অ্যাচিভিং দি এমডিজিস উইথ ইকুইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। এ বয়সে মেয়েরা গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয় না। চিকিত্সকদের মতে, একটি মেয়ের শারীরিক পূর্ণতা আসে ২০ থেকে ২২ বছর বয়ছে। শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা আসার আগেই বিয়ে হলে তার ওপর চাপ পড়ে। নাবালিকা একটি মেয়ে সন্তান সম্ভবা হলে নানারকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। স্বাভাবিক প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়, ফিস্টুলাসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। জরায়ু ক্যান্সারও অল্প বয়সে মা হওয়ার বড় ঝুঁকি। এ ছাড়া অল্প বয়সে সন্তান ধারনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ অথবা খিঁচুনি হয়ে মা ও সন্তান উভয়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং মায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। ফলে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি না হওয়ায় কম ওজনের শিশুর জন্ম হয়। অনেক ক্ষেত্রে মা ও শিশুর মৃত্যু হয়। বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো সমাজে সবপর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাহলে মানুষ সচেতন হবে। পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসন, মসজিদের ইমাম এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ বিষয়ে এগিয়ে এলে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব। তবেই সমাজ, দেশ বাল্য বিয়ের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি জনসংখ্যার চাপ মবে, কমবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে সন্তান জন্ম দানের হার, কমছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু। এটা করা গেলে দেশ, অর্থর্নীতি সমাজ সমানভাবে এগুবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে। মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক.কলামিস্ট |