শিরোনাম: |
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও নদীদূষণ প্রসঙ্গে
|
![]() আজ তাই বেশিরভাগ নদী মৃত। ভরাট জমিতে নদীর পাড়জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ দালানকোঠা, শিল্প প্রতিষ্ঠান। নদীর পাড় দখল করে দেদার চলছে বালু, কাঠ বিক্রির রমরমা ব্যবসা। এমনকি সরকারি ভূমিতে প্লট তৈরি করে গড়ে উঠছে হাউজিংয়ের ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন নদীর তীরে রয়েছে হাজার রকমের জাহাজভাঙা ও লঞ্চ-স্টিমার মেরামত শিল্প। জলযানের ভাঙা অংশ, তেল, মবিল, তেল জাতীয় সামগ্রী সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। পুরান ঢাকা, জিঞ্জিরা, কালীগঞ্জ এলাকার হাজার হাজার ছোটবড় কলকারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ছাপাখানা, টেক্সটাইল, কাপড় ডাইংয়ের বিষাক্ত রাসায়নিক রঙ তিনিয়ত মিশছে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের পানিতে। এমনকি হাজারীবাগের ট্যানারির মারাত্মক পানিদূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য কোনো পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি অপসারণ করা হয় বুড়িগঙ্গায়। এক হিসাব মতে, প্রতিদিন ঢাকা মহানগরের ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার পয়োবর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিলিত হয়। এসব বর্জ্যে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক এসিড। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার ১৮টি স্থানের মধ্যে ৭টিতে ট্যানারিসহ শিল্পবর্জ্যরে কারণে ভয়াবহ দূষণ হয়। ওয়াসার স্যুয়েজ অপসারণের ক্ষেত্র হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। হাসপাতাল বর্জ্যরে মিশ্রণজনিত কারণেও নদনদীর ভয়াবহ দূষণ ঘটে। নদী তীরবর্তী বসতবাড়ি ও বাজারের সব ধরনের বর্জ্য ফেলা হয় বুড়িগঙ্গায়। অপরদিকে দেড় হাজার নদীর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে বছরজুড়ে নাব্যসম্পন্ন নদীর অস্তিত্ব রয়েছে মাত্র ২৩০টির। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় আজ প্রতীয়মান, বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীই হয়ে পড়েছে বিপন্ন, অস্তিত্বহীন। বাংলাদেশের নগর সভ্যতার বিকাশে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উজান থেকে নেমে আসা পানি সঙ্কট নদনদীর অস্তিত্ব রক্ষায় নেতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে। নিয়ন্ত্রণহীন দখল-দূষণে পিষ্ট হয়ে মরে গেছে অধিকাংশ নদনদী, খালবিল। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাঘেঁষে বহমান ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় দখলের কারণে পানি ধারণক্ষমতা ক্রমে কমে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণ বুড়িগঙ্গার পানির স্বাভাবিক রঙ পর্যন্ত বদলে দিয়েছে। বৃষ্টির পানির মিশ্রণও দূর করতে পারছে না দূষণের মাত্রা। বর্তমান অবস্থায় বুড়িগঙ্গার কয়েকটি অংশের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসে। পানির অম্ল এবং ক্ষারের মাত্রা নির্দেশকও (পিএইচ মান) হয়ে পড়েছে অস্বাভাবিক। এমনকি বুড়িগঙ্গার পানির বিদ্যুত্ পরিবাহিতা স্বাভাবিক মাত্রার প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। মৃতায় বুড়িগঙ্গায় এখন আর কোনো জলজ প্রাণী ও মাছ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে অপরি কল্পিতভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় দেশে শিল্পজনিত নদীদূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলের সীতাকুণ্ডে প্রতিষ্ঠিত জাহাজভাঙা শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণহীন হলে ঘটবে পরিবেশ দূষণ। জাহাজভাঙা শিল্প থেকে নিঃসরিত অপরিচ্ছন্ন তেল, মবিল সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পড়লে পানি হয়ে পড়ে বিবর্ণ। এছাড়া পুরনো জাহাজ ভাঙার ফলে পানিতে সিসা, তামা, দস্তা, পারদ, ক্রোমিয়ামের মতো নানা বিষাক্ত ধাতব পদার্থের মিশ্রণ নিতে পারে ভয়াবহ রূপ। ফলে পানি ছাড়াও উপকূলবর্তী এলাকার মাটিও দূষিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার গাছপালার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। সমুদ্র ও নদীর মাছ এবং উপকূলের পশুপাখির রোগবালাইসহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। তাছাড়া সমুদ্রের পানিদূষণের কারণে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেখা দেয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। জাহাজভাঙা শিল্পের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ না করলে সমুদ্র ও নদী উপকূলীয় এলাকার পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ভাব অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন। দূষণে আক্রান্ত বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, যমুনা, পদ্মা, মধুমতি, ধলেশ্বরী, আড়িয়ালখাঁ, পশুর, ভৈরব, বিষখালী, বালু, মনু, কপোতাক্ষ, করতোয়া, মহানন্দা, সুরমা, কুশিয়ারা, কীর্তনখোলা, বলেশ্বর, সন্ধ্যা, খোয়াই, ধরলা, গোমতী, পায়রা, বংশী, হালদা, খোয়াই, কালীগঙ্গা, কুমার ও খালবিল দূষণের কারণে ভূপৃষ্ঠের পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহারের অযোগ্য। ফলে দেশের মানুষ শুধু ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানায় বসানো হচ্ছে গভীর নলকূপ। উত্তোলন করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি। পান ছাড়াও কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পানি। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর ১ থেকে ৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আর ভূগর্ভেও পানি পাওয়া যাবে না; দেখা দেবে ভয়াবহ পানি সঙ্কট। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগসহ দেশের নদনদীকে দখল আর দূষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখে নিরাপদ নৌ যোগাযোগ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নদনদীর নাব্য ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক পানিবাহ ধরে রাখতে নদীভাঙন ও নদী ভরাট রোধ করা জরুরি। এর জন্য বন্ধ করতে হবে নদীর অবৈধ দখল। নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্যারাজ নির্মাণ করা যাবে না। কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে পানির অপচয় রোধ করতে হবে। অভিজ্ঞজনের মতে, সেচ কাজে বর্তমানে ব্যবহূত পানির প্রায় অর্ধেক দিয়ে নতুন যুক্তিতে ভালো ফসল ফলানো সম্ভব। নদী পুনর্খনন ও নদী শাসনের জন্য পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করা হলে নদীর স্বাভাবিক পানিবাহ ফিরে এলে নদীদূষণ রোধে সহায়ক হবে। নদনদীর পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ওয়াসার সিউয়েজ নিগর্মনসহ নদনদীর পানিতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যরে মিশ্রণ রোধ করা অত্যাবশ্যক। নদীর তীরে শিল্প-কারখানা নির্মাণ বন্ধ, শিল্প-কারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামত কালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যরে মিশ্রণ তিহত করতে পারলে নদীদূষণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কৃষি ক্ষেতে ব্যবহূত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে না এসে মিশতে পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সমুদ্রে কোনোরূপ তেজস্ক্রিয় পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ নদী দখল ও দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। নদনদী দখল ও দূষণ রোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হতে পারে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। নদীকে রক্ষার জন্য নদীরক্ষা বাহিনীর সার্বক্ষণিক তদারকি জরুরি। নদনদীর ভয়াবহ দখল ও দূষণ রোধ করে বাংলা দেশের নদনদীর আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সারসহ সামগ্রিক পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নত হবে। নদীর দূষণ বন্ধ হলে দেশের সব নদনদীর পানি আগের দিনের মতো পানযোগ্য হবে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কমে যাবে, পানির স্তর নেমে যাবে না নিচে। নদনদীর পানি মাছসহ জলজ প্রাণীর নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হবে। নদীকে ঘিরেই চলছে সভ্যতার ক্রমবিকাশ। নদীর পানি দূষিত করে সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই নদীর পানিবাহ সচল রাখতে, নদীদূষণ রোধ করতে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, যুক্তিগত ও আইনগত নিয়ন্ত্রণ। ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়ে বর্জ্যরে ভারে নদনদীর পানি যেন না হয় দূষিত, দখলের কব্জায় পড়ে নদীর গতিপথ যেন না হয় সঙ্কুচিত, সমুদ্রের অতল জলরাশির জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন জোগান দেয়া অফুরান শৈবাল যেন না হয় বিপন্ন, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। যে নদনদী, সমুদ্রের অফুরান জলধারা সৃষ্টির অপূর্ব রহস্য, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পানির পাশাপাশি বায়ু দূষণও বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে মানুষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে নানা প্রকার বিষ ও স্বাস্থ্যহানিকর উপাদান। এ কারণে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ ক্রমবর্ধমান। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটিও দূষণের কবলমুক্ত নয়। বলা যায়, পরিবেশের সব মৌলিক উপাদানই কোনো না কোনোভাবে দূষণের শিকার। এই সঙ্গে ফল, ফসলও দূষণযুক্ত। তাতে বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হলেও কোনো ক্ষেত্রেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। কোনো কোনো বর্জ্যরে ক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিকাঠামোই নেই। নিরাপদ খাদ্য, পানি, বায়ু, মাটি ইত্যাদি শুধু মানুষের জন্যই নয়, জীব ও প্রাণিকুলের জন্যও অপরিহার্য। পরিবেশের এসব উপাদান দূষণমুক্ত রাখা সকল প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য, সভ্যতার জন্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য একান্তভাবেই আবশ্যক। এদিকে নজর দেয়া এখন সময়েরই একটি বড় দাবি। লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী |