বৃহস্পতিবার ১ মে ২০২৫ ১৮ বৈশাখ ১৪৩২
ছেলে আন্টুর জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন প্রাপ্তি বড় আনন্দের
Published : Sunday, 24 December, 2017 at 6:00 AM, Count : 701

একেএম ফজলুল হক কবিরাজ : অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এ বিজয় অর্জনে ত্রিশ লাখ বীর বাঙালি জীবন উত্সর্গ করতে হয়েছে। সেদিন আমার বড় ভাই শহীদ আজিজুল ইসলাম আন্টু ছিলেন অন্যতম। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার ফিলিপনগরে সম্মুখযুদ্ধে আমার ভাইকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। বিজয়ের লাল সূর্য তখন ওঠার অপেক্ষায়। সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনঠাসা হয়ে আসছে। যুদ্ধের বাহিনীর আক্রমণের মুহূর্তে আমার ভাই আজিজুল ইসলাম আন্টুকে ওরা ধরে নিয়ে যায়। আমরা তখন শরণার্থী হিসেবে ভারতে ছিলাম। আমার বাবা যখন খবরটি জানতে পারেন প্রথমে তিনি তার আদরের সন্তান আন্টুর জন্য যতটা কেঁদেছেন তার চেয়ে বেশি কেঁদেছেন স্বাধীনতার জন্য, কখন বিজয় আসবে। তারপর স্বাধীনতা যখন এলো তখন বললেন আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এতে আমি দুঃখিত নই। দেশ পেয়েছি। আমার তিনটা ছেলের মধ্যে একটিকে পাক হানাদাররা হত্যা করেছে। আরও দুটি আছে। কিন্তু যার একটি সন্তান ছিল এবং তাকেই হত্যা করেছে, তার কেউ নেই। আমার সন্তানের মতো লক্ষ সন্তানের জীবনের রক্তের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা এসেছে। মুক্ত দেশে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেব।
স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমার ভাই আজিজুল ইসলাম আন্টু কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বিএ ক্লাসের শেষ বর্ষের ছাত্র। ভাইয়ের বন্ধু মহিউদ্দিন পাকুও একই কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যান। মধ্য প্রদেশের দেরাদুনে ট্রেনিং শেষে মাতৃভূমিকে দখলদার মুক্ত করার জন্য, দেশেকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে ভাইয়ের বন্ধু পাকুও ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে আমার ভাই আন্টু ও পাকুকে পাক-হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে। সে সময় জেলার হোসেনাবাদে (বর্তমান যেখানে ভোকেশনাল) আর্মি ক্যাম্প ছিল। গ্রেফতার করার পর তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছি আন্টু-পাকুকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি আর্মিদের আমার ভাই বলেছিল, ‘আমি স্বাধীন বাংলাদেশ চাই। আর আমার বাবার নাম জানার চেষ্টা করো না, গ্রামের নাম জানতে চেও না, পুরো বাংলাদেশে আমার গ্রাম। তোমার যে বাবাকে ধরেছো যা বলার তাকে বলো।’ এরপর বর্বর পাক-হানাদাররা নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমার ভাই আন্টুকে হত্যা করে হোসেনাবাদের আর্মি ক্যাম্পের পাশেই বধ্যভূমিতে ফেলে দেয়। এরপর পাকু ভাই কয়েকদিন বেঁচেছিলেন। তাকে গাড়িতে করে ফিলিপনগরে নিয়ে এসে নির্যাতন করতো। পরে পাকু ভাইকেও পাক-হানাদাররা হত্যা করে।
আমরা বিজয়ের ৪৬ বছর পালন করছি। ৩০ লাখ আন্টু-পাকুর জীবন আর ২০ লাখ মা-বোনের মান-সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। পাকিস্তানিরা এই বাংলাদেশকে শোষণ করতো। তত্কালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আমরা সম্পদে ও জনসংখ্যায় বেশি ছিলাম। স্বাধীনতা-পূর্ব আমাদের শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা উন্নয়ন করতো। বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে রাখা হতো। শাসনের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে ছিল। সেনাবাহিনী-পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা সব দিক থেকে তারা বেশি ছিল। আর আমরা বঞ্চিত ছিলাম। কিন্তু এখন স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ বছর প্রায় চার লাখ কোটি টাকার বাজেট হবে। পদ্মা সেতুর ন্যায় মেঘা প্রকল্প নিজ অর্থায়নে এগিয়ে চলেছে। সাহায্য নির্ভরতার বদলে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। দেশেই ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য উত্পাদন হচ্ছে। 
আগে শুধু কয়েকশ’ কোটি মার্কিন ডলারের পাট রফতানি হতো। এখন স্বাধীন দেশের প্রত্যয়ী মানুষের শ্রম, ঘাম দিয়ে পণ্য রফতানি করা হচ্ছে। সেই পণ্য রফতানি করে ৩৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। এই ফিলিপনগরে ১২২ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এক সময় নদী ভাঙনে ফিলিপনগরের মানুষ দিশেহারা ছিলাম। এখন সেই নদীকে শাসন করেছি। এই অজপাড়া-গাঁয়ে ১২২ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হবে- ভাবাই যেত না। স্বপ্ন আজ সত্যি। এসব স্বাধীনতার ফসল। আগামীতে এই দৌলতপুরে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হবে। 
সামাজিক উন্নয়ন সূচকেও আমরা অনেক এগিয়েছি। মাতৃমৃত্যু হার, শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন, সব ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল মনে করে। এটাই হলো আমাদের স্বাধীনতার ফসল। ক্ষুধামুক্ত উন্নত দেশ হলে তবেই আমরা পুরোপুরি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি যখন লক্ষ্য অর্জন করতে পারব সেদিনই আমার ভাই আন্টু পাকুসহ মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন দেয়া সার্থক হবে। আমরা সেই দিনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

একেএম ফজলুল হক কবিরাজ: কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের ফিলিপনগরে সম্মুখযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত। এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আজিজুল ইসলাম পাকুর ছোট ভাই ও চেয়ারম্যান।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com