শিরোনাম: |
বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে কী?
|
![]() তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলীর সরকারি জায়গায় দেয়া তার বসত ঘরটিতে এখন চলে নেশাখোরদের আড্ডা। গুরুদাসী স্মৃতি রক্ষা নামে একটি সাইন বোর্ড টানানো থাকলেও বাড়ির আঙিনায় আশপাশের লোকজন মলমূত্র ত্যাগ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা তার চোখের সামনে স্বামী-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে তার সর্বস্ব লুটে নেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে কপিলমুনিতে আনেন। চিকিত্সা শেষে সেখানে বসবাসের জন্য একটি পাকাঘর নির্মাণ করে দিলেও মৃত্যুর পর কথিত ভূমিদস্যুরা তা দখলে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে গুরুদাসীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ গঠন হলেও পরে আর তাদের কোনো বিশেষ কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ওই দিন তার বসত বাড়িটিতে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেয়া হলেও গত ৯ বছরেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এরই মধ্যে গত ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক গেজেটে ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ শুরু করেছে। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বার্থে বীরাঙ্গনারা অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের অবদান কখনোই ভোলা যাবে না। এ জন্য সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মৃত বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে না পারলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধে বীরঙ্গনাদের ভূমিকা অজানা রয়ে যাবে। পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের গুরুপদ মন্ডলের স্ত্রী গুরুদাসী। স্বামী গুরুপদ পেশায় একজন দর্জি ছিলেন। ২ ছেলে আর ২ মেয়ে নিয়ে ছিল তার সংসার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের ইন্ধনে পাকবাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে গুরুদাসীর উপর। এ সময় স্বামীসহ সন্তানরা তার সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে আসলে গুরুদাসীর সামনে একে একে গুলি করে হত্যা করে স্বামীসহ ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে। পারিবারিক সূত্র জানায়, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহগুলো বীভত্স করে দেয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাশে কাদা পানির ভেতরে। এরপর গুরুদাসীর ওপর হায়েনারা পর্যায়ক্রমে শুরু করে পাশবিক নির্যাতন। এরপর হায়েনারা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীরা সর্বহারা মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসীকে উদ্ধার করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে তাদের হেফাজাতে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিত্সার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে সেখানেও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকেন। আর বারবার ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী তখন ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। সারাক্ষণ হাতে ছোট্ট লাঠি নিয়ে মানুষকে হাসতে হাসতে সাপের ভয় দেখিয়ে হাত পেতে ২/১ টাকা চেয়ে নিয়েই চলতে থাকে তার জীবন-জীবিকা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাকে এক নামেই চিনত গুরুদাসী মাসি হিসেবে। এরপর বাগেরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, পাইকগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী ও তত্কালীন পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদার কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় গুরুদাসীর বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। সেখানেই অনাদরে, অযত্নে, অভাবে দীর্ঘদিন বরাবরের ন্যায় অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে নিজ ঘরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী দেখে প্রতিবেশীরা শয়ন কক্ষের জানালা দিয়ে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। গুরুদাসীর মৃত্যুর খবরে কপিলমুনিতে ছুটে যান মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ। তবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুদাসীর আত্মত্যাগের কথা আজও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। কপিলমুনিবাসীর এখন একটাই দাবি আগামী গুরুদাসীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁইসহ তার বসতবাড়িটি পূর্ব ঘোষণানুযায়ী সংরক্ষণের। |