শিরোনাম: |
অদৃশ্য আঘাত দূষণ
|
সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বায়ু দূষণকে অদৃশ্য ঘাতক আখ্যা দেয়া হয়েছে। সংস্থাটির মতে, বায়ু দূষণের বিষয়টি খোলা চোখে দেখা না গেলেও এটা মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বস্তুত দূষিত বায়ুকে বিশ্বের ৩৬ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সার, ৩৪ শতাংশ স্ট্রোক ও ২৭ শতাংশ হূদরোগের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী মনে করা হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, পৃথিবীর ৮০ শতাংশ বেশি শহরের বায়ু অনিরাপদ। অবশ্য আশার কথা, এ অবস্থা রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ক্লিন এয়ার কোয়ালিশন (সিসিএসি) বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এছাড়া বায়ু দূষণের ভয়াবহতা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে ‘ব্রিদ লাইফ’ নামে একটি সংগঠন বিশ্বব্যাপী প্রচারণা শুরু করেছে। দুই হাজার শহরের ওপর গবেষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এতে বলা হয়েছে, এমন অনেক শহরে মানুষ বসবাস করছে, যেখানে বায়ু দূষণ স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার ওপরে চলে গেছে। আশংকার বিষয় হল, যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, বায়ু দূষণ বৃদ্ধির কারণে মস্তিষ্কের আকৃতি হ্রাস পায়। আর এর ফলে হূদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। জাতিসংঘের মতে, গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি। সে হিসাবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় আট হেক্টর বনভূমি। যে হারে পৃথিবীতে বন উজাড় হচ্ছে, সে হারে নতুনভাবে লাগানো হচ্ছে না গাছ। বাংলাদেশে গড়ে ২৪ ঘণ্টায় এক লাখ ৩০ হাজার গাছ কাটার বিপরীতে লাগানো হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার। এতে বোঝা যায়, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে কী নিষ্ঠুর আচরণ করছি আমরা। এ আচরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের আবহাওয়ায়। রাজধানী ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা এরই মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। শিল্পবর্জ্যের কারণেও রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে বায়ু দূষণ বাড়ছে ক্রমাগত। শিল্পাঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের চাকা গতিশীল রাখতে মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য শক্ত হাতে বায়ু দূষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। রাজধানীসহ সারা দেশকে দূষণমুক্ত করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার বায়ু দুষণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মত- হাজারীবাগসহ পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় বাতাস হাইড্রোজেন, সালফাইড, অ্যামোনিয়া, নাইট্রোজেন যৌগের গন্ধে সবসময় ভারি থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বায়ু দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। দূষণ নির্ণয়ের ইন্ডিকেটর হিসেবে বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা সর্বোচ্চ ২.৫ পিএম থাকা উচিত, সেখানে ঢাকার বাতাসে এর পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি থাকায় শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপ, অবসাদ, ফুসফুসে প্রদাহ, ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। শুধু বায়ু দূষণই নয়, শব্দ দূষণও রাজধানী ঢাকার একটি বড় সমস্যা। শব্দ দূষণের মানমাত্রার চেয়ে ঢাকায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি শব্দ উত্পন্ন হচ্ছে। গাড়ির হর্ন, মাইকিং, গান-বাজনা, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ, নির্মাণকাজের শব্দে রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীতে শব্দ দূষণের কারণে বধির রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করছে মারাত্মকভাবে। বিশেষ করে শব্দদূষণের কারণে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। শব্দদূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে ২০০৬ সালে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’ প্রণয়ন করা হলেও কার্যত এর প্রয়োগ দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি। অর্থাত্ আইন আছে, আইনের প্রয়োগ নেই। আমাদের দেশে এ অবস্থা শুধু শব্দ দূষণ রোধে বিধিমালার ক্ষেত্রে নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। বিশেষ করে রাজধানীতে ভিআইপি হর্নের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিআইপি হর্নে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ‘শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি’ বিষয়ে একটি জরিপকাজেও এমন প্রভাবের সত্যতা পাওয়া গেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন ও পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৪ থেকে ১০০ ডেসিবল এককে দিনে হওয়া উচিত ৫০ এবং রাতে ৪০। বাস্তবে শব্দ দূষণের মাত্রা এখন অনেক বেশি। এজন্য শুধু আইন করেই হবে না, মানুষের সচেতনতা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন হাসপাতাল এলাকা কিংবা আবাসিক এলাকায় হর্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে ধরনের দিকনির্দেশনা দেয়া আছে, তা সবাইকেই মেনে চলা উচিত। কিন্তু কেউই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না, বরং আইনের লঙ্ঘন করলেও মামলা পর্যন্ত হয় না। ফলে আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষও সমানতালে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস প্রজেক্টের আওতায় ২০১৩ সালে এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দূষিত বায়ুর কারণে প্রতি বছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই হচ্ছে ভারত ও চীনের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। গবেষণা মতে, প্রতি বছর চীনে প্রায় ১৬ লাখ এবং ভারতে ১৩ লাখের কাছাকাছি মানুষ দূষিত বায়ুর কারণে মারা যায়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের কারণে কেন্দ্র থেকে নির্গত ক্ষুদ্র উপাদান, কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া দূষণের জন্য দায়ী। চীনে যেমন বায় ুদূষণের মূল কারণ কয়লা পোড়ানো, তেমনি ভারতের বায়ু দূষণের মূল কারণ কাঠসহ বিভিন্ন জ্বালানি পোড়ানো। অর্থাত্ একেক দেশে একেকভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে। চীন এখন শিল্পসমৃদ্ধ একটি দেশ। যে দেশের জনসংখ্যা শতকোটির অধিক হলেও শিল্প বিকাশের কারণে চীনের উত্পাদিত পণ্য গোটা বিশ্বেই তুলনামূলক কম মূল্যে সহজলভ্য হওয়ায় চীনা পণ্যের বাজার এখন অনেক ওপরে। যা সম্ভব হয়েছে শিল্প বিকাশের বদৌলতে। আবার শিল্প বিকাশের অন্যতম নিয়ামকই হল বিদ্যুত্। সেই বিদ্যুত্ উত্পাদনে মাত্রাতিরিক্ত কয়লা পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের কারণে নানা রোগে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। অর্থাত্ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের মূল ভিত্তি যেখানে শিল্প বিকাশ, সেখানে শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রেও দূষণের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে একদিকে মানুষের উন্নত জীবনমানের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব হলেও অন্য দিকে মানুষের সুস্থ জীবনের অনিশ্চয়তা বাড়বেই। নানা কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন গোটা বিশ্বের পরিবেশকে পাল্টে দিচ্ছে। অর্থাত্ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, বজ্রপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। প্রকৃতিবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন চরম সঙ্কটাপন্ন। এমতাবস্থায় আমাদের উচিত প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসা। তা না হলে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে দেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের বেঁচে থাকা কঠিন হবে। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস প্রজেক্টের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য অপুষ্টি, মুটিয়ে যাওয়া, মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহল গ্রহণ এবং অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের চেয়েও বায়ু দূষণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলো বিগত কয়েক দশকে বায়ু দূষণ রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় অকাল মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। শুধু বেইজিং বা দিল্লিই নয়, ঢাকার বাতাসেও একই পরিমাণ বায়ু দূষণ মাত্রার চিত্র এক জরিপে উঠে এসেছে। প্রায় দেড় কোটি বসতির রাজধানী ঢাকাকে বাস উপযোগী করতে বায়ু দূষণের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি শব্দ দূষণ বিধিমালা আইন-২০০৬ এর সফল বাস্তবায়নকে নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় রাজধানী ঢাকাসহ নগর-মহানগরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তাই দিনে দিনে আরও প্রকট হবে। বিশেষ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম মাধ্যম গাছ। তাই গাছ লাগানোর প্রতি জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আজকাল বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের দাবি ও উদ্যোগ প্রবল হয়ে উঠেছে। এদেশেও তার ঢেউ এসে লেগেছে। কিন্তু আমরা কি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, প্রাণী বিলুপ্তি, পরিবেশের ভারসাম্য কথাগুলোর অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারছি? এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে কতটুকু সচেতন? এদেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে এখনই সব পেশার মানুষকে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সজাগ হতে হবে। আর তা না হলে এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদেরই বহন করতে হবে। তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য সরকার ও বিভিন্ন এনজিও’র পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য আজই আমাদের দেশের বনজ ও জলজ পরিবেশ সম্পর্কে ব্যাপক জরিপ এবং গবেষণার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি এবং পরিবেশের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া নিয়েও গবেষণা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এক জটিল খাদ্যশৃঙ্খলে বাঁধা। তাই একের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব অন্য অনেকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অনেক ক্ষেত্রে এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধ প্রভৃতির উপকরণ যোগায়। কখনো বা নানাভাবে আমাদের পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন। লেখক : কলাম লেখক। |