শিরোনাম: |
বিষদাঁত
|
![]() যে ছইয়া ঘর হয়, সেই ঘরই আবার ছইয়া হয়ে নদীতে ভাসে। মানে, ভাসমান নৌকার ছইয়াগুলো কিছুদিন পর পর ডাঙায় উঠে এলে ওটাই ঘর হয়। কাছে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ-বেতের মিহি চাটাই বুনন আর তাতে রয়েছে গোবরে লেপ। চাটাইয়ের বাইরে ভেতরে মোটা একরঙা পলিথিন সাঁটা- বৃষ্টিবাদলা থেকে রক্ষার একমাত্র উপায়। এক সিজন চলে যায় অনায়াসে। লম্বা-প্রস্থে ৭ বাই ৪ আর ৫ ফুটে গিয়ে ঠেকে উচ্চতা- এ রকম একটা সংসার কালু দম্পতির। বিয়ের ৭ বছরের মাথায় অষ্টাদশী হাসি রানীর কোল আলো করে জন্ম নেয় রূপসী কুমারী। সে আজ থেকে বছর পনেরো আগে, কোনো এক মাঘের ধলপ্রহরে। সেদিন তীব্র কাঁপুনি ধরা হিম বাতাসে মা-শিশুর জন্মচিত্কারে কেঁপে উঠেছিল লোহর গাঙের বাতাস। কালু বসেছিল ছইয়ার বাইরে। দুই হাঁটু মুড়ে, উদোম ঠ্যাং দুখানা বুকের কাছে ভাঁজ করে, দুই হাতের তালুতে জাপটে ধরা কালসে নারিকেলের মালার হুক্কায় দম নিচ্ছিল ঘন ঘন। তামাক পোড়া ধোঁয়ার মতো বিষণ্ন ছিল তার মন। মুখে চিন্তার ছাপ। আগের দুই-দুইটা ছাওয়াল জন্ম নিয়েই পরক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। এবারও কি পূর্বঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? কালুর ভেতরটা কেন যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে অশনিতে। নিজেকেই ধমকায় কালু। ধুর, খালি অলুক্ষণে যত কথা! তবুও কি চিন্তারা থেমে থাকে? শুধু কিলবিল করে মাথায়। কালু হুক্কায় ঘন ঘন টান দেয় আর গুড়ুম গুড়ুম শব্দে যেন চাপা দিতে চায় সব অশুভকে। কাইতন দাই অভিজ্ঞ। রাতের প্রথম প্রহরে সে ঢুকেছিল হাসি রানীর আতুরঘরে। আলাদা করে ওরা আতুরঘর বানায় না, সন্তান বিয়ানোর সময় ওই ছইয়া ঘরই আতুরঘরের কাজ করে। এই সময় পুরুষরা বাইরে বাইরে থাকে। সেদিন রাতের শেষ প্রহরেও যখন কোনো জন্মসংবাদ মেলেনি, মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে কালুর। এই প্রতীক্ষা তার দুঃসহ ঠেকে। উজাগরি রাতের শেষ প্রহরে ঝিমুনি দিচ্ছিল কালু। তখন হুক্কার তামাক নিভে এলে হঠাত্ একটা ক্ষীণ অথচ সুতীব্র চিত্কারের পরই কাইতন দাই হাসি হাসি মুখ করে বের হয় ছইয়া থেকে। : কইরে কালু, ফুরি বিয়াইসে তর বউ। : চাচি, হাসানি কিতা কইতাস আমার ফুরি অইসে? : হ কালু, তর ফুরি অইসে। চান্দের লাগান সোন্দুর। বড় অইলে বেডাইত নাচাইব নাতনি আমার। কাইতন দাইয়ের ফোকলা দাঁতে টেরা হাসি খেলে যায়। দাইয়ের শেষ কথাটা কালুর কানে পৌঁছে কি-না বোঝা যায় না। আমার ফুরি অইসে, কালু খুশিতে আটখানা হয়ে প্রচারে লেগে যায়। দৌড়ে দৌড়ে যায় এক ছইয়া থেকে অন্যটায়। জানান দেয়, সন্তান আগমনের সংবাদ। মাত্র হাতে গোনা গোটাকয় পরিবার। নিমিষেই কাভার করে ফেলে কালু। চারদিকের বাতাস যেন ঠিক ঠিক ছড়িয়ে দিয়েছিল কাইতন দাইয়ের কথাটা এই ক্ষুদ্র জনপদে। আশপাশের ছইয়া থেকে বেরিয়ে এসেছিল মেয়েছেলেরা, বয়স্ক পুরুষরা। হাসি রানীর পাশে শুয়ে থাকা শিশুটার প্রশংসায় সবাই ছিল পঞ্চমুখ। কাইতন দাইয়ের কথাটাও বৃথা যায়নি। বড় হতে হতে রূপসীর রূপ ছড়িয়ে যায় চারদিকে। রূপসী কুমারী অপরূপা। এখন তার বেতগাছের মতন শরীর। বাঁশপাতার মতন সরু নাক। পাতলা ঠোঁটে যেন রাজ্যের নেশা। পাহাড়ের মতো তার সুডৌল বক্ষ। কঞ্চির মতো সরু কোমর। আর কোমরে রুপার বিছাখানায় যেন দইরার ঢেউ খেলে যায়। হাঁটার ছন্দে যখন রূপসী দোলে, দোলে যেন লোহর গাঙ। তখনও হাইওয়েটা এত ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। রাত্রিবেলা খড়ের বিছানায় শুয়ে যখন শুধু ট্রাকের দানবীয় গর্জন শোনা যেত একটু পর পর তখন কালু বেদের সঙ্গে হাসি রানীর বিয়ে হয়। এ ঘরেই তাদের বাসর হয়। এখানেই রূপসীর জন্ম হয়। ওরা প্রতিবছর এক জায়গায় ডেরা পাতে না। ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ঘুরে পছন্দসই স্থান বেছে নেয়। ৩-৪ বছর পর পর আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। ওরা বেদে জাত। যাযাবর। ওদের বাপ-দাদারা কিংবা পরদাদারা ঘুরে বেড়াত দেশ-বিদেশ। কিংবা তাদেরও আগে যারা ছিল ওরাও। নৌকার বহর নিয়ে ছুটত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নদ-নদী হলো ওদের জীবনের গতি, জলের টান হলো জীবিকার তাগিদ। এই নদ-নদীই ওদের জিইয়ে রাখার রসদ জোগায়। কালু বেদেরও শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাপ-দাদাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। সাপ ধরার মন্ত্র শিখেছে বাপের কাছে। কৈশোরে সাপ ধরেছে। যৌবনে সাপ খেলিয়েছে। রাজপানখ, দুধরাজ, সুতানলি, ধাড়াস সাপসহ আরও কত কত সাপ যে পোষ মানিয়েছে! আর তাদের বউ-মেয়েরা তখন গ্রামে গ্রামে তাবিজ বিক্রি করেছে। শিঙায় টান দিয়ে গেরস্থ-কামলা-মুনিষদের বাতরস খুলেছে, কত ব্যথা-ব্যামুযে নিরাময় করেছে! সাপ ধরা আর ঝাড়ফুঁকের কদরটা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলে ওদের অনেকেই এ পেশা বদল করে। রূপসীর বিয়ে হয় তেরোতে। এই বেদে-সমাজে কম বয়সে বিয়ের রেওয়াজ আছে। তার মায়ের বিয়ে হয়েছিল এগারো বছর বয়সে। সেই তুলনায় রূপসী পোক্ত। বিয়ে-শাদি আর ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে ওরা যেমন রাষ্ট্র-আইনের ধার ধারে না তেমনি রাষ্ট্রের নিয়মনীতিও ওদের ওপর বর্তায় না। ফলে এসব সামাজিক আচার নিজেদের মতো করে সজিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। যে বছর রূপসীর বিয়ে হয় তার আগের বছরের ঘটনা। কালু ছইয়া ফেলে বুধন্তি ঘাটে। ঘাটে পোঁতা লম্বা লম্বা লগি আর তাতে বাঁধা নানা কিসিমের নৌকা দোল খায় লোহরের ঢেউয়ে, বাতাসে। দেওয়ান বাজার, বুল্লা, শ্যামরা, মানিকপুর, জগত্পুর হয়ে লোহর গাঙটা বুধন্তি ঘাটে এসে যেন কলকলিয়ে ওঠে এবং সেখান থেকে ঘুরে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে উজান ধরে তিতাস নদীতে গিয়ে মেশে। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে-সংলগ্ন বুধন্তি নদীঘাটের উজানে বিশাল ভরাট মাঠ। জায়গাটা বেশ উঁচু। ভরা বর্ষায়ও জল উঠে না মাঠে। কেউড়া আর বন্য কলমিলতি কায়জলের দিকটা যেন অন্ধাভাবে জড়িয়ে থাকে। নদীর তীরে লেগে থাকা খয়েরি শ্যাওলার আস্তরণ মিশে থাকে ভাসমান শাপলা পাতায় আর ঘন দুধের সরের মতো দোল খায় কলমিদামের গোড়ায়। এরই একপাশ ঘেঁষে আরও একদল নতুন বেদে আস্তানা গড়ে সেবার। রূপসীর সঙ্গে সোনাই বেদের প্রথম দেখা এখানেই। একুশের এক সোমত্ত যুবক সোনাই। শ্যামলা, লিকলিকে পেটানো শরীর। চোয়াল ভেঙে গেছে কৈশোর থেকে যৌবনে উতরানোর চাপে। নাকের নিচে কালো এক ফালি গোঁফ। আর অধরে যেন অদম্য পুরুষালি লাবণ্য খেলা করে। তখন বারোতে রূপসী। কৈশোরের নদীতে স্নানরত এক বালিকা। সদ্য জেগে ওঠা তার নারীত্বে যেন ভরা জোয়ারের পূর্বাভাস। বুধন্তি ঘাটের ছলাত ছলাত পানির মতো রূপসীর শরীরও খলখলিয়ে বাজে। গোছার ওপরে সেঁটে থাকা ডোরাকাটা শাড়ির পরতে পরতে লেগে থাকে সোনাইয়ের চোখের ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিতে কাত হয় রূপসী। না হয়ে কি উপায় আছে বালিকার? সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। আকাশে মেঘের সঙ্গে চলছে পূর্ণচাঁদের ছলাকলা সন্ধ্যা থেকেই। হালকা বাতাসে দক্ষিণের মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে উত্তরে আর উত্তরের মেঘ পুবে-পশ্চিমে ছড়াচ্ছে। রূপসী বসেছিল ভাসমান এক নৌকার গলুইয়ে। পা দুইখানি লোহরের জলে ডুবিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল অপার বিস্ময় নিয়ে। মেঘেদের চলার ছন্দে মাথাটা ঘোরাচ্ছিল ডান থেকে বাঁয়ে আর বাঁ থেকে ডানে। কখনো দূরে তাকাচ্ছিল এক বুক মৌনতা নিয়ে। কী এমন কষ্ট থাকতে পারে চপলা কিশোরীর মনে? গোল ফর্সামতো চাঁদটা ঠিক বুঝেছিল। সে রাতে চাঁদ নেমে এসেছিল লোহরের জলে। ঢেউয়ের তালে চাঁদের ওঠানামা দেখতে দেখতে কখন যে নৌকাটা দুলে উঠেছিল বুঝতে পারেনি কিশোরী। বাতাসের টানে দ্রুত চলছে ভাটিপথে নাও। দাঁঁড়বিহীন নৌকায় একাকী বালিকা। বসতির বাতিগুলো ছোট হতে হতে শুধুই দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। রূপসীর চিত্কার ওখানে আর পৌঁছে না। চিত্কারের শব্দ কিছুদূর গিয়েই মিশে যায় লোহরের ঢেউ ভাঙার শব্দের সঙ্গে। এক একটা ঢেউ নৌকার কিনারে বাড়ি দেয় আর কিশোরী নিজেকেই নিজে জাপটে ধরে। ঠিক তখনই আকাশ কাঁপিয়ে ঘনবৃষ্টি নামে আর কিশোরীর নৌকা উল্টায় বানের বাতাসে। রূপসী কাত হয়ে লোহরের বুকে গড়িয়ে পড়ে। : কেএ এ এ ওওওওও সোনাইয়ের নৌকা থেকে হারান বেদে আওয়াজ তোলে। হারান সোনাইয়ের সুখ-দুঃখের সাথি, একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকে। সে রাতে দেওয়ান বাজার হয়ে সোনাই আর হারান ফিরছিল উজান ধরে বুধন্তি ঘাটে। দূর থেকে হারান দেখতে পায় উল্টানো নৌকার কুচকুচে কালো তলা। আবারও হাঁক তোলে হারান। : কেএএ এ ওওওওও শব্দটা লোহরের জলে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে নিজেদের কাছেই। কোনো সাড়া আসে না শুধু তাদের নৌকার দাঁড়ের ছলাত ছলাত শব্দ ছাড়া। উল্টে থাকা নৌকাটার কাছে এসে চারদিকে চোখ ফেলে ওরা। ততক্ষণে বৃষ্টির তোড় থেমে গেছে অনেকটা। এখন ঝিরঝিরিয়ে পড়ছে। ওদের নৌকা থেকে হাত বিশেক দূরে শাপলাদামের ওপর এক মেয়েছেলেকে ভাসতে দেখা যায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে সোনাই লোহরের জলে। সোনাইয়ের কোলে মাথা রেখেই রূপসীর জ্ঞান ফিরে। ফিরতি পথ সারাটা রূপসী কুমারী জাপটে ধরে রাখে সোনাইকে। আর কেঁপে কেঁপে ওঠে ভয়ার্ত ফ্যাকাশে চোখ নিয়ে। নৌকায় রাখা শুকনো কাঁথায় জড়িয়ে রূপসীর ভেজা কাপড় শুকিয়েছে। সোনাই পাগল হয়েছে কিশোরী শরীরের বন্য ঘ্রাণে। উথালে পাথালে যেন কাঁপন ধরিয়েছে। আস্তানার কাছাকাছি নাও ভিড়তেই রূপসীর মায়ের বুক চাপড়ানো বিলাপ শুনতে পাওয়া যায়। আর লোহরের বাতাস খানখান হয় সেই আর্তনাদে। দূর থেকে দেখা যায় কালু বেদে বুদ হয়ে বসে আছে ঘরের বেড়ায় ঠেস দিয়ে। বুধন্তি ঘাটে নাও ভিড়লে শোরগোল পড়ে যায় এই বেদেপল্লিতে। রূপসী মায়ের কোলে ফিরে। দিনে দিনে রূপসী সুস্থ হয়। সেই থেকে শুরু হয় সোনাইয়ের মনে আনচান। রূপসীকে কাছে পাওয়ার নানা বাহানা খুঁজে ফেরে অহর্নিশ। রূপসী সব বুঝে প্রশ্রয় দেয়। বারোতে দাঁড়িয়ে বালিকা যেন মধ্য যুবতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সোনাইয়ের হঠাত্ মৃত্যুটা এক মস্ত রহস্য। বিষধর কোনো সাপের দংশনে হলে মানা যেত। কারণ, সাপ নিয়েই ওদের যত ছলাকলা, ফলে সাপের ছোবলে মরাটা বিস্ময়ের নয়। লোহরের জলে ডুবে মৃত্যু হলেও তাও না হয় মানা যেত। কারণ জলের টানেই ওদের জীবনরথের চাকা ঘোরে। সমীকরণিক সব মৃত্যু-আশঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে শেষে কি-না ট্রাকে চাপা পড়ে মৃত্যু! অন্ধকার রাত। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল কদিন ধরে। হাইওয়ের কালো পিচ মাড়িয়ে ট্রাক-লরি ছুটছে গগনবিদারী আর্তনাদে আর চাকাদের ঘূর্ণনে বৃষ্টির জল ছিটকে ছিটকে পড়ছে রাস্তার দুই কিনারে। বজ্রপাতের ঝলকানিতে সেই জলের ফোটা রুপোর মতো চিকচিক করে উঠছে। সোনাই বেরিয়েছিল সকালে জীবিকার সন্ধানে, সে তো জীবনেরও সন্ধান? যেন জীবন বাঁচিয়ে রাখার এক অদৃশ্য ইন্ধন। সোনাই ফিরলেই দেখা করবে, সেজন্য রূপসী রাত জেগেছিল। রূপসী ছিল ওদের ছইয়াতে। মায়ের পাশে শুয়ে শুধুই ভাবছিল সোনাইয়ের কথা। আগের দিন সোনাইয়ের সঙ্গে জোর তর্ক হয়েছে। তার পণভাঙা অভিমান। এমনকি পরদিন সকালে সোনাই কথা বলতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রূপসী। সারা দিনে সেই অভিমান তাসের ঘরের মতো উড়ে গেছে- সোনাই ফিরলেই তার বুকে লুটিয়ে পড়বে রূপসী। আর তাতেই যত অভিমান সব গলে গলে সুখ শিহরণে বদলে যাবে। রাত বাড়ে সেই সঙ্গে রূপসীর অপেক্ষাও দীর্ঘ হয়। সোনাইয়ের সাড়া না পেয়ে একসময় ঘুম ভর করে চোখে। ভোরের দিকে ক্রন্দনরত মানুষদের আহাজারি আর শোরগোলে জেগে উঠেছিল রূপসী। ছইয়ার বাইরে সোনাইয়ের ছিন্নভিন্ন দেহটা রাখা। চারদিকে ভারী শোক, কান্নার মাতম। আর রূপসী নির্বিকার। অবশ্য তাদের মেলামেশার ব্যাপারটা পাঁচকান হয়নি তখনো। তাই বোধ হয় রূপসী তেমন গুরুত্ব পায় না সোনাইয়ের মৃত্যুতে। আর সব মেয়েছেলের মতো সেও দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সোনাইয়ের অন্তিমযাত্রা। সোনাইয়ের মৃত্যু রূপসী কুমারীকে কতটা নিষ্প্রভ করে দেয়, এ রূপসীকে দেখলেই টের পাওয়া যায়। তার চালচলনে কথাবার্তায় ভারিক্কি আসে। অপ্রয়োজনে কারও সঙ্গে মেশে না। একা একা ঘুরে বেড়ায় লোহরের তীরে। শালুক তুলে আনে, শাপলার লাল টকটকে ফুল খোঁপায় গুঁজে। আর পূর্ণিমার রাত্রিগুলোয় নৌকার গলুইয়ে বসে থাকে একাগ্রতা নিয়ে। হাসি রানী মেয়ের বিয়ের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। পরের বছর রূপসীর বয়স যখন তেরোতে, তখন তার বিয়ে হয় ভিনদেশি সাপুড়ে বলাই বেদের ছেলে লখাই বেদের সঙ্গে। লখাইয়ের বয়স একটু বেশিই। তাছাড়া সম্পূর্ণ অপরিচিত আবার ভিনদেশি বলেও হাসি রানী একটা বাহানা দাঁড় করাতে চায় কালু বেদের সামনে। ‘বাইদ্দার আবার দেশ আছেনি কিতা?’- কালুর এই নির্মম সত্য কথায় হাসি রানী দমে যায়। ঠিকই তো! যারা যাযাবর-বেদে, তারার আবার নিজের দেশ-অন্যের দেশ কি? যেখানে যাবে ওখানেই ওরা নিজেদের মতো করে ডেরা বানিয়ে নেবে। কেউ ওদের বাধা দেবে না। না রাষ্ট্র, না রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতি। লখাই আর রূপসীর বিয়ে হয় শাস্ত্রমতে। বিয়ের পর ওরা আলাদা ডেরা পাতে। লখাই পরিশ্রমী যুবক। সে এক পেশায় থাকতে চায় না। সাপধরা কমে এলে এই পেশা ছেড়ে দিয়ে গাছগাছালির শিকড়-বাকলে তৈরি ওষুধপাতি বিক্রি করে হাটেবাজারে। সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙা খাটুনির পর রূপসীকে কাছে পায় রাত্রিতে। আদরে সোহাগে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু রূপসী নিশ্চুপ পড়ে থাকে বিছানার এক কোণে। যেন অচল পয়সার মতো তার অস্তিত্ব লখাইয়ের সঙ্গে সহযাপনে। দুই বছরের দাম্পত্য সম্পর্কেও লখাই বেদে মন পায় না রূপসীর। প্রথম দিকে এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে। তুমুল বাহাস হয়েছে, চিত্কার চেঁচামেচি করেছে দুই পক্ষই। এখন আর লখাইয়ের তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না। পনেরোতে রূপসী এখনও চঞ্চল স্বভাবে-চলনে-বলনে, শুধুই দাম্পত্যে লখাইয়ের পাশে যেন বরফ শীতল। আর সাঁইত্রিশের লখাই বেদে যেমন ধীরস্থির, তেমনি পরিণত। রূপসীকে বিয়ে করার কিছুদিন পর থেকে লখাইয়ের নেশার অভ্যাসটা শুরু হয়েছে পুরাদমে। আগেমধ্যে যাকে বলে অকেশনালি দেশি মদটদ টানত লখাই। ইদানীং রোজ নেশা করে ছইয়াতে ফেরে। আর তখন রূপসীর শরীরের ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা বেড়ে যায়। হাতের কাছে যা পায় তা দিয়েই পেটাতে থাকে। রূপসী মুখ বুজে সব সয়ে নেয়। কারণ, রূপসীর শেষ আশ্রয়স্থল তার বাপ-মা তত দিনে তার জীবনের গত অধ্যায়। অত্যাচারের মাত্রাটা চরমে পৌঁছলে রূপসী সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মনস্থির করে। বুধন্তি নদীঘাটে নানান মানুষের আনাগোনা। রাস্তার নিচে খাদের কিনারে সারি সারি খাবারের দোকান। সামনে লরি রেখে ক্ষুধার্ত ড্রাইভাররা-হেল্পাররা গোগ্রাসে ভাতের দলা মুখে তুলে হোটেলগুলোতে। নদীঘাটের যাত্রীরা গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া দেয় মাঝিদের। উজানে দেওয়ান বাজার, খরমপুর দর্গাঘাট আর ভাটিপথে আনন্দবাজার, ফান্দাউক, ছাতিয়াইন। যাত্রীদের হইহুল্লোড়, ড্রাইভারদের চেঁচামেচি আর বাস-ট্রাকের হর্নের শব্দে জায়গাটা সরগরম থাকে দিনের বেলা। তত দিনে বেদেদের গোত্রীয় পেশায় ধস নেমেছে পুরাদমে। বেদেনীরা এখন নিজস্ব পেশা বাদ দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য তোলে। ওরা যখন দলবেঁধে ডেরায় ফেরে তখন বুধন্তি ঘাটে চেনা-অচেনা মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়। বেদেনী দলযাত্রীদের পথ আগলে দাঁড়ায়। ওদের হাতে ধরা ছোট্ট বেতের কৌটোতে সাপ পুরে নিয়ে পথচলা মানুষদের চমকে দেয়। পিছু নেয়। ৫-১০ টাকায় দফারফা হয়। লরি ড্রাইভার মতাব্বরের চোখ লেগে আছে রূপসীর ওপর। সেকি আজ থেকে? সোনাই যখন বেঁচেছিল তখন থেকেই। মতাব্বরের বাপ-দাদারা ছিল পেশায় বেদে। মতাব্বরের বাপ চতুর তজাব্বর বেদে আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিল তাদের গোত্রীয় পেশায় একদিন ধস নামবে নিশ্চিত। তাই ছেলেকে সে অন্য পেশায় জড়িয়েছিল। যদিও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজে বেদের পেশাকেই আঁকড়ে থেকেছে। মতাব্বর বাসের হেল্পারি করেছে, কন্ডাক্টরি করেছে। গত ১০-১২ বছর এই রোডে আছে। সে এখন ট্রাক চালাচ্ছে। স্থায়ী নিবাস হয়েছে তার। রূপসীকে সে বহুবার দেখেছে সোনাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে। সেই থেকে মতাব্বরের শকুনি ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে আছে। মতাব্বরের লোভাতুর চাহনি সোনাইয়ের জন্য থমকে থমকে দাঁড়িয়েছে কত কতবার? সব মনে আছে তার। ইদানীং মতাব্বর যেন একটু বেশিই রূপসীর কাছে ঘেঁষতে চায়। রূপসী বোঝে। মতাব্বরের শ্যেনদৃষ্টি তার হূদয়েও এক-আধবার শিহরণ জাগিয়েছে। থিরথির কাঁপন তুলেছে আর সেজন্যই রূপসীকে একটু একটু করে মতাব্বরের দিকে হেলতে হয়েছে। এখন ওদের কথা হয় টুকটাক। মতাব্বরের মিষ্টি মিষ্টি কথায় রূপসী এক রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়। একটু তফাতে বসে সব কাণ্ড-কারখানা দেখে হেল্পার হাসে। ভাবে, হালার বেডা ফারেও! হেল্পার ফোঁড়ন কাটে। : উস্তাদ, মাল উডবো মনে অয়। মতাব্বর চল্লিশে পৌঁছলেও তাকে তাগড়া জোয়ান দেখায়। কাঁচাপাকা একফালি গোঁফের নিচে কালসে ঠোঁটে চিকন হাসি লেগে থাকে সব সময়। তার তীক্ষ চাহনি রূপসীর কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় করে। তীব্র এক সুখব্যথায় রূপসী আস্তে আস্তে ঢলে পড়তে থাকে মতাব্বরের দিকে। সুযোগ নেয় মতাব্বর। : বিয়া নি বইবা আমার কাছে? সুহে রাহুম। : ইশ বেডার শখ কত? গরের মাইদ্যে আমার জামাই নাই না কিতা? কোন দুক্কে আমি আবার বিয়া বমু? : দুক্ক ত তুমার মনে। মন থাইক্কা চোহে ভাসতাসে। আছে না দুক্ক? : না নাই। রূপসী জিভ কেটে চলে যায়। মতাব্বর সব বুঝে। তার হাঁটার ছন্দে মতাব্বের চোখে তাক লাগে। আহা, লোহর গাঙের ছলাত ছলাত জলের ঢেউ যেন রূপসীর কোমর আছড়ে নামছে। মতাব্বর সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়। মনে মনে বলে, আছে মাগি- দুক্ক আছে তর মনে। সোনাই রে বালা ফাইতি, হে তো আমার টেরাকের নিচে ফইরা মল্ল। আর অহন তর লাঙ্গে মদ খাইয়া তরে মারে। আমি বুজি না, না কিতা? সব বুজি। অভিজ্ঞ ট্রাক ড্রাইভার মতাব্বরের চোখ কোনো এক গোপন অভিলাষে চক চক করে ওঠে। খোয়াবে দেখা সাপের বিষদাঁত সে আমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। |