শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মাছের খামারে স্বপ্ন দেখছে ডুমুরিয়ার নারীরা
Published : Tuesday, 1 August, 2017 at 6:00 AM, Count : 833

একটা সময় ছিল নারীরা শুধু পুরুষেরই কাজে লাগতো। তাদের সংসার গুছানো বা দেখভাল করা। রান্নাবান্না করা। সন্তানদের আদর যন্তে বড় করা। সঙ্গে ছিল কিছুটা গৃহপালিত পশুপাখির দেখাশোনা করা ইত্যাদি। তবে কালের খেয়ায় এতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন নারীরা সবকিছুই করতে শিখেছে। কোমল থেকে অনেক শক্ত কাজও এখন তারা অহরহ করেই দেখাচ্ছে। কেউ বিমানের পাইলট আবার কেউ রিকশার! থেমে নেই, সব বাধা পেরিয়ে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছে অনেক আগ থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় নারীরা এখন মাছের খামার গড়েও সফলতার স্বপ্ন বুনছে।
সেই স্বপ্ন বুনার বা দেখার কাতারে এমনই একটি নাম চিংড়ি চাষি রীতা চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি চারুলতাকে জানায়, অনেকেই তো অনেক কিছু করে সফল হচ্ছে। কি নারী কি পুরুষ। সেই চিন্তা চেতনা থেকে আমি চিংড়ি চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি, আর এখন আমি এবং আমরা চিংড়ি চাষ করতে শিখেছি। আমরা নারীরা এখন সংসারের বোঝা নই বরং সংসারের অনেক কাজে আসছি। সেটা কেবল আর্থিক সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যার ফলে সংসারে আমাদের গুরুত্ব বেড়েছে। এর জন্য মত্স্য বিভাগকে সাধুবাদ। কেননা, তারাই আমাদের নতুনভাবে পথচলা শিখিয়েছে।
রীতা আরও জানায়,বর্তমানে আমাদের এই গ্রামের ২৫ জন মহিলা একত্রিত হয়ে চিংড়ি চাষ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,শুধু রীতা চৌধুরীই নন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ৫ শতাধিক নারী মত্স্য চাষি রয়েছেন যারা পুরুষের পাশাপাশি নিজেরাই মত্স্য খামারে মাছের পরিচর্যায় সরাসরি জড়িত। রীতা জানায়, তার বাড়ির পাশে নিজেদের জমিতে পৃথক তিনটি মত্স্য খামার গড়ে তুলেছেন রীতা। যদিও খামারগুলো ছোট ছোট। তারপরও প্রতিটিতে খরচ বাদে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এ বছর ১ বিঘা জমিতে সরকারের সহায়তায় শুরু করেছেন কাকড়া চাষ। এটিও লাভজনক বলে জানায় রীতা।
চারুলতাকে তিনি বলেন, সম্প্রতি খরচ বাদে এক বিঘা জমিতে ৩৫ হাজার টাকার কাকড়া বিক্রি হয়েছে। আশা করছি আরও কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে।  জানা যায়,খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলাটি মত্স্য সম্পদে সমৃদ্ধ ও অপার সম্ভাবনাময় একটি জনপদ। বর্তমানে ডুমুরিয়া উপজেলার জনগোষ্ঠীর জন্য যে পরিমাণে মাছের চাহিদা রয়েছে তার তিনগুন বেশি মাছ উত্পাদন হচ্ছে এখানে। এই উপজেলার নদী খাল ও বিলে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কৈ টেংরা, টাকি, শোল, পুটি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেতো। বর্তমানে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। দেশীয় মাছকে রক্ষা করার জন্য ৫টি মত্স্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে অভয়াশ্রমগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করায় ওই সব অভয়াশ্রমে উল্লেখযোগ্য হারে বিপন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের আবির্ভাব ঘটেছে।
এখন শিংগে মরা নদীতে জাল টেনে বিপন্ন প্রজাতির টেংরা, পুটি, বেলে, শিং, চিংড়ি ইত্যাদি মাছের ১০-১২ শতাংশ পুনরাবির্ভাব ঘটতে দেখা গেছে। মত্স্য অভয়াশ্রমগুলোর সুফল দেখে ব্যক্তি উদ্যোগে উপজেলার হাজিবুনিয়া মরা নদীতে একটি মত্স্যজীবী সমবায় সমিতি অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে। ওই সমিতির একজন সদস্য জানান, অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় এই খালে আগের চেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মাছ চাষে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে।
বিগত এক বছরে ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস, টাউনঘোনা, গোলনা, বড়ডাঙ্গা, ভান্ডারপাড়া অঞ্চলের নারীদের দলগত প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও উদ্বুদ্ধ করার ফলে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাধিক নারী সরাসরি মাছ চাষে জড়িত হয়ে পড়েছে। নারীরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
এছাড়া চাষিদের মধ্যে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে উপজেলার বড়ডাঙ্গা গ্রামে সৃষ্টি হয়েছে চিংড়ি চাষ পল্লী। যা সবার কাছে চিংড়ি চাষের বড়ডাঙ্গা মডেল নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে চিংড়ি সংগ্রহ কেন্দ্রে। যেখানে চিংড়ি চাষিরা সরাসরি চিংডি বিক্রি করতে পারে। সেখানে সংগ্রহকৃত চিংড়ি সরাসরি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কোম্পনিতে পাঠানো হয়। কোন ফরিয়া বা ডিপো মালিকের প্রয়োজন পড়ে না।
মত্স্য অধিদফতরের লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে চিংড়ি চাষের জন্য তৈরি করা হয়েছে বড়ডাঙ্গা মডেলটি। উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ চিংড়ির উত্পাদন বৃদ্ধি করা। মত্স্য অধিদফতর নিরাপদ খাদ্য উত্পাদনের যে চালেঞ্জ নিয়েছে তারই বাস্তব প্রয়োগ হলো এই বড়ডাঙ্গা মডেল। এখানকার উত্পাদিত মাছ বা চিংড়ি বা সবজিতে কোনো কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত পরিবেশে নিরাপদ খাদ্য তৈরি হচ্ছে এ এলাকায়।
ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র মত্স্য অফিসার সরোজ কুমার মিস্ত্রী চারুলতাকে জানান, উপজেলায় ২১ হাজার ৭০৮ হেক্টর (১ হেক্টর = ২.৪৭ একর) জলাশয় রয়েছে। এ সকল জলাশয় মত্স্য সম্পদ উত্পাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ডুমুরিয়া উপজেলার জনগোষ্ঠির জন্য মাছের চাহিদা ৫ হাজার টন। অথচ ডুমুরিয়াতে গত অর্থবছরে (২০১৬-২০১৭) উত্পাদন হয়েছে ১৫ হাজার ১৫৯ টন। যা চাহিদার তিনগুণ।
তিনি আরও জানান, সারাদেশে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ হয়। তার মধ্যে ডুমুরিয়ায় চাষ হয় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে। এ জমিতে গলদার উত্পাদন হয়েছে ১১ হাজার ১০৭ মেট্রিক টন। যা সারাদেশের উত্পাদনের ৬ ভাগের ১ ভাগ। মত্স্য অফিসার সরোজ কুমার মিস্ত্রী আরও বলেন, ‘মত্স্য সম্পদ উন্নয়নে সরকার অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। গত বছর ডুমুরিয়ার ১২ টি বৃহত্ জলাশয়ে এবং ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের পুকুরে ১১ টন মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।’ এ বছর আরও বেশি পরিমাণ মাছের পোনা অবমুক্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
সবশেষ বলা যায়, এক রকম চিংড়ি এবং দেশি মাছের বিপ্লব ঘটেছে এই গ্রামে, যা দেশের অন্যজেলাগুলোতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। ফলশ্রুতিতে মাছে ভাতে বাঙ্গালি চিরন্তন এই কথাটি প্রতিয়মান হওয়ার পথেই হাটছে মত্স্য বিভাগ, এমনটা এখন বলা যেতেই পারে।
- চারুলতা প্রতিবেদক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com