শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫ ৬ আষাঢ় ১৪৩২
বিপদের বন্ধু প্রতিবেশী
Published : Thursday, 5 October, 2017 at 6:00 AM, Count : 961

এম. শামসুদদোহা তালুকদার : মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- যখন সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হয়নি তখনো মানুষ ‘পারিবারিক’ হিসেবে পৃথিবীতে বসবাস করে আসছে। মানুষ মূলতঃ একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। কাছাকাছি, পাশাপাশি বসতি গড়ে মানুষ তাদের প্রতিটি ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা বিনিময় করে থাকে। সর্বজন স্বীকৃত মতে- পাশের বাড়ির মানুষকে প্রতিবেশী বলে। প্রতিবেশীর সীমানা ও তাদের প্রতি কর্তব্যের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে স্বয়ং নবী করীম (সা.) বলেছেন- ‘শুনে রেখ, আশপাশে চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশী। যে ব্যক্তির প্রতিবেশী তার অনিষ্টকর আচরণ হতে নিরাপদ থাকে না, সে জান্নাতে দাখিল হবে না’ (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব)। ইসলামি মতে- প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর বিস্তৃতি অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ সব স্তরের প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়েছেন। ‘নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী এবং সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে’ (সূরা-নিসা: ৩৬) সূরা নিসার একাধিক আয়াতসহ অন্যান্য আয়াতেও প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ, নম্র-ভদ্র ব্যবহার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর নির্দেশনা রয়েছে।
বান্দার মাঝে ঈমানের অস্তিত্ব থাকবে কি থাকবে না- তা নির্ভর করে প্রতিবেশীর সঙ্গে আচরণের উপর। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন-‘আল্লাহর কসম! ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, প্রশ্ন করা হলো- ইয়া রাসুলুল্লাহ! কার ঈমান নেই? নবীজি (সা.) বললেন- যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট হতে নিরাপদ নয়’ (বুখারী ও মুসলিম)। প্রতিবেশীরা বাস্তবে আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও মর্যাদা ও নৈকট্যের দাবি রাখে। আত্মীয়-স্বজনরা সবাই একই এলাকায় বসবাস করে না। পাশাপাশি বসবাসকৃতরা বিপদ-আপদ, দুঃখ-বেদনার সময় এগিয়ে এসে সহযোগিতা করে। আহত বা জরুরি অসুস্থতায় পতিত হলে তাকে তাত্ক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা করাতে পারে। আকষ্মিক কোনো বিপদের সম্মুখীন হলে তার মোকাবিলায় সর্বপ্রথম প্রতিবেশীরাই এগিয়ে আসে। কারো মৃত্যু হলে স্বজনদের সান্ত্বনা প্রদানসহ তার বিদায়যাত্রার প্রস্তুতি পর্বে অবদান রাখে। এক কথায়- প্রতিবেশীরা একে অপরের কাছে জাগতিক নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। এমন দরদীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের কষ্ট বা ব্যথা দেয়া যাবে না। অনিষ্টকারী প্রতিবেশী মারাত্মক ধরনের কবিরা গুনাহকারীর অন্তর্ভুক্ত। মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’ (মিশকাতুল মাছাবীহ)।
প্রতিবেশীর অভাব-অনটনের খোঁজ খবর নেয়া, অভাবগ্রস্ত হলে অভাব মোচনে এগিয়ে আসা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। প্রতিবেশীর অনিষ্ট করা, বিপদ-আপদে উদাসীন থাকা, জান্নাতে প্রবেশের অন্তরায় হিসেবে হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যার প্রতিবেশী তার অত্যাচার ও অন্যান্য আচরণ থেকে নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’ (বায়হাকী, মিশকাত)। দরিদ্রতায় জর্জরিত ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর হক রয়েছে পাশের বাড়ির রন্ধনশালায়। তাকে খাদ্য প্রদান করতে হবে, এটা মানবীয় কর্তব্য। এ ব্যাপারে সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন- ‘আমি রাসুলে আকরাম (সা.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি পেট ভরে আহার করে, আর তারই পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে ব্যক্তি (প্রকৃত) ঈমানদার নয়’ (বায়হাকী, মিশকাত)।
প্রতিবেশীদের অবস্থান সম্মান ও মর্যাদার। যা পবিত্র কোরআন ও হাদিস দ্বারা নির্দেশিত ও সমর্থিত। একজন প্রকৃত মুসলমান তার প্রতিবেশীকে সর্বদা সম্মান করবে, সহযোগিতা করবে, এটা মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধেরও স্বীকৃতি। প্রতিবেশীকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের নিরিখে বিবেচনা করা বাতুলতা। সর্বাবস্থায় প্রতিবেশীর পাশে থাকতে উদ্ভুদ্ধ করেছে ইসলামী কর্তৃপক্ষ। মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবীয় আচরণ করা মূলতঃ কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা ও সুনীতি। 
পাশ্চত্যের তথাকথিত সমাজে ‘প্রাইভেসি’র অবাধ চর্চার কারণে প্রতিবেশী তো দূরের কথা নিজ পরিবারের সভ্য সদস্যদের কোথায় কি করছে সে খবরও জানা থাকে না। গত মাসে গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ায় একটি সচিত্র খবর প্রকাশিত হলে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। লন্ডনের উপকণ্ঠে একটি বাড়িতে বসবাসরত এক মহিলার মৃতদেহ সোফায় বসে টিভি দেখা অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। স্লিপিং গাউন পরা কঙ্কালের ছবিটা মূলতঃ তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রতি চপেটাঘাত বৈ আর কিছু নয়। প্রতিবেশীরা ঠিক তখনই এগিয়ে এসেছিল যখন ওই মহিলার মেইল বক্স ভরে গিয়ে চিঠি বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। 
হাদিসের আলোকে প্রতিবেশীর হক, অধিকার অনুসারে প্রতিবেশীকে তিনটি শ্রেণীতে বিন্যাস করা হয়েছে- এক হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী- যারা আত্মীয় নয়, মুসলিমও নয়। দুই হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী- যারা আত্মীয় নয় কিন্তু মুসলিম। তিন হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী- যারা আত্মীয় ও মুসলিম (তিরমিযী)।
প্রতিবেশীর অধিকার হিসেবে সামর্থ্যানুসারে তাদের জন্য কিছু অংশ বরাদ্দ রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে রাসুল (সা.) হুকুম করেছেন: ‘যখন তুমি সালন (তরকারি) পাকাবে তখন তাতে কিছু পানি বাড়তি দিবে, আর তোমার প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিবে’ (বুখারী ও মুসলিম)। প্রতিবেশীর অধিকার প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) এর নিন্মোক্ত বক্তব্যের পর আর কোনো কথা থাকে না। তিনি (সা.) বলেছেন- ‘জিব্রাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এত বেশি তাকিদ দিচ্ছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল তিনি তাদের আমার ওয়ারিশ বানিয়ে দিবেন’ (বুখারী ও মুসলিম)।
প্রতিবেশী মূলতঃ বিপদের বন্ধু- মানবিক চেতনাই প্রধান নিয়ামক। মানুষের সেবায় ব্রত থাকার অঙ্গীকারকে ইসলাম প্রাধান্য দেয়। এখানে ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় বিবেচ্য নয়। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এর এক ইহুদি প্রতিবেশী ছিল। তিনি যখন কোনো বকরী জবেহ করতেন তখন তার কিছু অংশ সেই ইহুদির বাড়িতে পাঠাতেন। হাদিসে আরও বর্ণিত আছে যে, কেয়ামতের দিন গরিব প্রতিবেশী ধনী প্রতিবেশীকে পাকড়াও করে আল্লাহর কাছে নালিশ জানাবেন- কেন সে তার ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছিল!
জালিম প্রতিবেশীর জুলুম সহ্য করাও তার প্রতি এক প্রকার ইহসান। প্রতিবেশীর দেয়া কষ্ট ও নির্যাতন বরদাশত করার নজীর রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর একজন অমুসলিম (যিম্মী, মজুসী) প্রতিবেশী ছিল। তার ঘর হতে ময়লার তরল বর্জ্য পাত্র ছিদ্র হয়ে সাহাবীর ঘরের অভ্যন্তরে এসে পড়ত। আর হযরত সাহল ওই ময়লা ও বর্জ্য নিজে একটি বড় পাত্রে ধারণ করে প্রতি রাতে দূরে ফেলে আসতেন। হযরত সাহল (রা.) যখন অন্তিম শয্যায় তখন তাকে ডেকে এনে তার ঘর হতে বেরিয়ে আসা ময়লা-আবর্জনাযুক্ত দূষিত বর্জ্য দেখিয়ে বললেন- দীর্ঘদিন এটা হয়ে আসছে। আমি তা জমা করে রাতে আবার ফেলে দেই। এখন আমার অন্তিম সময়। এখন আপনি স্বচক্ষে দেখুন এবং কি করবেন বলুন! তখন মজুসী বললেন- হে শেখ! আপনি দীর্ঘদিন যাবত এভাবে আমার দ্বারা কষ্ট পেয়ে আসছেন অথচ এখনও আমি কাফির অবস্থায় আছি তা কি করে হয়? আপনার হাত প্রসারিত করুন। মজুসী প্রতিবেশী উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন- ‘আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু’। অতঃপর হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ মাওলার দরবারে চলে গেলেন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com