শিরোনাম: |
মৃতশিল্পের ঐহিত্য
|
![]() কুমারটুলি অঞ্চলের মৃিশল্পীদের দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেব-দেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পূজার জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রফতানি করা হয়। কুমারটুলি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প (মৃিশল্প) কেন্দ্রও বটে। ইতিহাস অনুযায়ী, ইংরেজরা কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল ভাগ করে, এইভাবে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলো বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতার-পাড়া, আহিরীটোলা ও কুমারটুলি প্রভৃতি অঞ্চলের উত্পত্তি ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃিশল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কুমারটুলির পটুয়ারা, যারা গঙ্গা-মাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র ইত্যাদি তৈরি করে সুতানুটি বাজারে (এখন বড়বাজার) বিক্রি করতেন, তারা টিকে যান। পরবর্তীকালে তারা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পূজার নিমিত্ত দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করতে শুরু করেন। কলকাতা ও বাইরে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজার প্রচলন হলে পূজা-কমিটিগুলো কুমারটুলি থেকে প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকে। মঙ্গলকোট পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমাধীন কুনুর নদীর ডান তীরে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। অজয় নদের সঙ্গে কুনুর নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত এর ধ্বংসাবশেষ বিস্তৃত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৬-৯০ সালের মধ্যে এই প্রত্নস্থলটিতে উত্খনন কার্য পরিচালনা করে। মঙ্গলকোটে পাঁচটি প্রধান সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম স্তরে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে কালো ও লাল রঙের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মৃত্পাত্রের সন্ধান মিলেছে। অন্যান্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে লাল মৃত্পাত্রের টুকরা বা ফালি; সঙ্গে তামাটে, কমলা, গাঢ় বাদামি এবং দীপ্তিমান লোহিত মৃন্ময়। তবে কালো মসৃণ ও অমসৃণ মৃত্পাত্রের টুকরার সংখ্যাই অধিক। কিছু মাটির পাত্র সাদা বা কালো রঙের চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত। রেডিওকার্বন পদ্ধতির ভিত্তিতে এ পর্বের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মৃিশল্প জাতীয় নিদর্শন হিসেবে লাল, বাদামি, ধূসর ও কালো রঙের সাধারণ মানের মৃত্পাত্রের টুকরা; কালো ও লাল রঙের অপকৃষ্ট শ্রেণির মৃত্পাত্রের টুকরা এবং পূর্ববর্তী স্তরের মৃত্পাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে লৌহ নির্মিত বিপুলসংখ্যক তীরের অগ্রভাগ, বাটালি ও ছুরির ফলা ইত্যাদি। এ সামগ্রীগুলো থেকে লোহা ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য এ সময় হাড়ের সামগ্রী ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল। একদিকে কালো ও লাল মৃত্পাত্রের অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে কয়েক ধরনের নতুন মৃিশল্পের উদ্ভব তৃতীয় সাংস্কৃতিক স্তরকে (মৌর্য-শূঙ্গ আমল: আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যন্ত) বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। নতুন মৃত্সামগ্রীর মধ্যে নকশাবিহীন ও নকশাঙ্কিত উভয় প্রকারের লাল, ধূসর ও কালো মৃত্পাত্রের টুকরা এবং উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃত্পাত্রের (ঘড়ত্ঃযবত্হ ইষধপশ চড়ষরংযবফ ডধত্ব) অপকৃষ্ট ধরনের অল্প কিছু নমুনা রয়েছে। এ স্তরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে একটি ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা, লেখবিহীন তাম্র মুদ্রা এবং মৌর্য-শূঙ্গ শিল্পরীতির বেশ কিছু পোড়া মাটির মূর্তি। চতুর্থ স্তরটি কুষাণ সাংস্কৃতিক পর্বের একটি সমৃদ্ধিসূচক সময়কে তুলে ধরে। এ স্তরে মঙ্গলকোট প্রত্নস্থলে সম্ভবত সর্বপ্রথম ইটের রৈখিক বা লম্বালম্বি কাঠামো দৃষ্টিগোচর হয়। ফুল ও জ্যামিতিক অলঙ্করণের সুস্পষ্ট ছাপ সংবলিত শক্ত লাল মৃত্পাত্র হচ্ছে এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক মৃত্সামগ্রী। এ পর্বের প্রাপ্ত আকর্ষণীয় প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে বেশকিছু সিলমোহর, নির্ধারিত ছাঁচে নির্মিত পোড়ামাটির মূর্তি (কোনো কোনো মূর্তি স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত) রয়েছে। হাতে গড়া পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই বেশ কিছু মূর্তি এই স্তরে পাওয়া যায়। পঞ্চম স্তরটি গুপ্তদের সমসাময়িক এবং একটি সমৃদ্ধ বস্তুগত জীবনের চিত্র তুলে ধরে। পূর্ববর্তী সময়ের মতো এ পর্বেও ব্যাপক নির্মাণ কর্মকাণ্ড দেখা যায়। লালচে বাদামি রঙের অলঙ্কৃত পাতলা মৃত্সামগ্রী এ যুগের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে। এ স্তরে নানা ধরনের প্রতীক সংবলিত বহুসংখ্যক সিল পাওয়া গেছে। মাটির সামগ্রী তৈরির পদ্ধতি: মাটির বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করতে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়- প্রথমে মাটি বাছাই করতে হয়। পলি মাটি দিয়েই মাটির বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি হয়। এই মাটি মূলত আশপাশের খাল, বিল, নদী, পুকুরের মাটি। তারপর সেই মাটি ঝাড়া হয়। কারণ মাটির সঙ্গে অনেকসময় নূড়ি, পাথর, বালি ইত্যাদি মিশে থাকে। মাটি ঝাড়ার পর মণ্ড পাকানো হয়। এই মণ্ডগুলো বিভিন্ন জিনিসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওজনের হয়। এরপর মাটি মাখা হয় এবং চ্যাপ্টা করে বিদ্যুত্চালিত চাকায় দেয়া হয়। কুমোর এরপর তার নিজের হাতের গুণে গড়ে নেন তার চাহিদামত সামগ্রী। এরপর করা হয় নকশা। এখানেই শেষ নয় এরপর রোদে শুকাতে দেয়া হয় এইসব সামগ্রী। খানিকটা শুকাবার পর সামগ্রীটাকে টেকসই করতে পরিমাণ মতো তাপ দিতে হয়। আগুনের আঁচে পোড়ান হয় সামগ্রীটাকে তারপর প্যাকিং করে বাজারে পাঠানো হয়। মৃিশল্পের ক্ষেত্রে বহু জিনিসের চাহিদা অনেকটাই কমেছে। যেমন মাটির হাঁড়ি কলসির জায়গায় এখন এসেছে স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র। চাহিদা বেড়েছে মাটির মূর্তি, ঘর সাজাবার নানা উপকরণের। সেই কারণেই মৃিশল্পীরা টব, ফুলদানি, মূর্তি, প্রদীপ, অ্যাশট্রে, ধূপদানি, মোমদানি কফি মগ ইত্যাদি তৈরিতে বেশি মন দিয়েছেন। বর্তমানে এগুলোর চাহিদা বেশি থাকায় মৃিশল্পীদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে তা এখনও আশানুরূপ নয়। এখানে উদাহরণ হিসেবে নরসিংদীর মৃিশল্পীদের বর্তমান দিনকাল সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো। গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে- অস্তিত্ব সঙ্কটে পেশা ছাড়ছেন মৃিশল্পীরা। কালের বিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মৃিশল্প। তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ও বিকল্প পণ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি এসব গৃহস্থালি সামগ্রী। ফলে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। মৃিশল্পীদের মতে, এক সময় নরসিংদী জেলার মৃিশল্পের খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। জেলার শিবপুর, পলাশ ও বেলাবো উপজেলার হাজারও পাল পরিবার জড়িত ছিল এই শিল্পের সঙ্গে। এ জেলার মৃিশল্পীদের হাতে তৈরি মাটির জিনিসপত্র নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু দিনের পর দিন আধুনিকতার ছোঁয়া আর পৃষ্ঠপোষতকার অভাবে বিলীন হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। কম দামে বেশি টেকসই প্লাস্টিক, মেলামাইন, লোহা ও সিলভারের তৈরি সামগ্রীর দাপটে কমে গেছে মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা। ফলে পুঁজি ও শ্রম দিয়ে মাটির তৈরি জিনিস বানাতে গিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে মৃিশল্পীদের। মাটি দিয়ে তৈরি এসব গৃহ সামগ্রী রোদে শুকিয়ে চুল্লিতে পোড়ানো হয়, তার পর রঙ করে বিক্রির উপযোগী করা হয়। বাড়ির গৃহিণীরাও সহযোগিতা করেন এসব কাজে। মৃিশল্পীরা বলছেন, পরিশ্রম ও বিনিয়োগ অনুপাতে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না তারা। এ কারণে পুরনো পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই, খুঁজছেন বিকল্প পেশা। জেলার বেলাব, পলাশ ও শিবপুর উপজেলার হাজারও পাল পরিবারের মধ্যে এখন মাত্র আড়াই শতাধিক পরিবার ধরে রেখেছেন পূর্ব-পুরুষের এই পেশা। পাল পরিবারের নতুন প্রজন্মের কেউ শিখছেন না মৃিশল্পের কাজ। শিবপুর উপজেলার লেটাবর গ্রামের মৃিশল্পী মনিন্দ্র চন্দ্র পাল বলেন, তৈজসপত্র তৈরির জন্য এখন মাটি কিনে আনতে হয়। কেনা মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রের খরচও বেশি পড়ে। এ যুগে বেশি মূল্যে এসব জিনিস কিনতে আগ্রহ দেখান না ক্রেতারা। এতে আমাদের লোকসান গুণতে হয়। একই গ্রামের সুনীল চন্দ্র পাল বলেন, আমাদের সন্তানরা মাটির কাজ শিখতে চায় না। তারা অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। আমরা যারা আছি অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে লেগে আছি। যোশর গ্রামের মৃিশল্পী শশী চন্দ্র পাল বলেন, মৃিশল্পীরা বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বিপাকে থাকেন বছরের পর বছর ধরে। আমাদের এটাকে শিল্প বলা হলেও সরকারিভাবে কম সুদে কোনো ঋণ সুবিধা আমরা পাই না। পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ পাওয়া গেলে খেল না, শোপিসসহ অন্যান্য সৌখিন জিনিস তৈরি করে মৃিশল্পীরা বেঁচে থাকতে পারত, এই শিল্পের ঐতিহ্যও রক্ষা করা যেত। এভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মৃতশিল্পীদের কথা যদি ভাবা যায় তবে মৃিশল্প বেঁচে থাকতে পারে। ফিরতে পারে পুরনো ঐতিহ্যে। আর এ শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যক্তি উদ্যোগ দরকার। লেখক: কলাম লেখক |