রবিবার ৪ মে ২০২৫ ২১ বৈশাখ ১৪৩২
বাল্যবিয়ে ও আমাদের দায়বদ্ধতা
Published : Monday, 13 November, 2017 at 6:00 AM, Count : 1064

মামুনুর রশীদ : সকালে ঘুম ভাঙলেই পত্রিকার খোঁজ করি। হররোজ পত্রিকায় চোখ না বুলিয়ে সাধারণত বাহিরে যাওয়া হয় না। প্রতিনিয়ত নানা ঘটনার পাশাপাশি বেড়েই চলেছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে রোধ করতে এত এত প্রচারণার পরও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আনাচে-কানাচে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। স্থানীয় প্রশাসনের উপর বিবাহ রোধের সব ক্ষমতা থাকলেও অনেকেই হয়তো ভয়ে সে পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেন না। এ ক্ষেত্রে বাবা মায়ের বক্তব্য হলো, আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দিব তাতে কার কী আসে যায়? এই সময়ে এসে এমন বক্তব্য শুনতে পাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন শিক্ষাবৃত্তি। মেয়েদের উপবৃত্তির পাশাপাশি মা’কেও দেয়া হচ্ছে শিক্ষাবৃত্তি। যেন কোনো শিশু আর অকালে শিক্ষার অভাবে ঝরে না যায়।
এই শিক্ষাবৃত্তি কি প্রকৃতভাবেই শিক্ষার পেছনে খরচ হচ্ছে নাকি দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে খরচ হচ্ছে সেটা তদারকির কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিধায় শিক্ষার উপকরণ না কিনে কেনা হচ্ছে জীবিকা। তাহলে উপবৃত্তির ফায়দা কি? একটি ছোট্ট মেয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে। বাবা-মায়ের ভুলে পাতা ফাঁদে পা দিবে না। এ জন্যই তো নারীদের শিক্ষা গ্রহণটা জরুরি বিষয়। সেটা কি আসলেই হচ্ছে? এটার পেছনে আসলেই দায়ী কে? বাবার ভুলের খেসারত কেন একটা ছোট্ট শিশু দিবে। ভরণ-পোষণের পাশাপাশি শিক্ষার উপকরণের অর্থ সরকার দিচ্ছে তাহলে সীমাবদ্ধতা কোথায়?
আমাদের সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব শুধু অশিক্ষিত বাবা-মায়ের সচেতনতা। তাদের বুদ্ধি বিবেচনা যতদিন না বৃদ্ধি পাবে ততদিন আমাদের সমাজ থেকে কোনো প্রকার আইন দ্বারা এই সমস্যা রোধ করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি জেএসসি/ জেডিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পত্রিকায় আসছে ‘পরীক্ষা কেন্দ্রের বদলে স্বামীর ঘরে’ এই ধরনের ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকছে কি? সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জের কুর্শা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের চার ছাত্রীর বাড়িতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার আগের দিন প্রবেশপত্র নিয়ে গেলে চারজনের কাউকেই বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তারা এখন স্বামীর ঘরে।
বগুড়ার শিবগঞ্জের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না খাতুন (ছদ্মনাম) সারা বছর লেখাপড়া করে ফরম পূরণ করলেও জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের বদলে যেতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ি। এই পরিণতি শুধু স্বপ্নার নয়, দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে এ রকম চিত্র পাওয়া যাবে, যারা ফরম পূরণ করেছে অথচ পরীক্ষায় বসেনি। কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনুপস্থিত এই পরীক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বাল্যবিয়ের শিকার। 
বাল্যবিয়ে নামের সামাজিক ব্যাধিতে অনেক সম্ভাবনাময় ছাত্রী অকালে ঝরে পড়ছে। এসব মেয়ের অধিকাংশ অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারছে না। জনৈক অভিভাবক বলেন, ‘কন্যাশিশুকে নিয়ে অভিভাবকরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আমি পরীক্ষার আগে হঠাত্ করে ভালো একজন পাত্র পাওয়ায় অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।’
পরিবার হলো আমাদের মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে আপনি আপনার সন্তানকে যেভাবে মানুষ করবেন সে সেভাবেই বেড়ে উঠবে। আপনার চেতনা বা চিন্তাধারা যদি থাকে মেয়ে সমাজের বোঝা। এদের অল্প পড়িয়ে কোনো ভালো ছেলের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্তই আমাদের দায়িত্ব। তাহলে আপনাদের বাবা-মা হিসেবে দায়িত্ব কি? এমন অনেক বাবা-মা আছেন তাদের কথা হলো মেয়ে করবেন ঘরের কাজ তাদের দিয়ে পড়ালেখা করানো দরকার কি? এসব ধারণার মূল হলো প্রকৃত শিক্ষার অভাব। এসব ভুল ধারণার অবসান ঘটানো আমাদের দায়িত্ব। আমাদের প্রশাসনের পাশপাশি এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা সমাজে আমাদের শিক্ষিত হয়ে লাভটা কি? আমাদের গ্রহণ করা শিক্ষা যদি মানবকল্যাণে না লাগাতে পারি তাহলে সুশিক্ষা কোনো কাজেই আসবে না।
সারা বাংলাদেশের অবস্থা একই। সবখানেই বাল্যবিয়ে জোরদার হচ্ছে। সম্প্রতি পাস হওয়া বাল্যবিয়ে আইন এর সফলতা কি? আর তার কাজটাই বা কি হচ্ছে? বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মানুষকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। এর কুফল সম্পর্কে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে ইউপি চেয়ারম্যানদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাল্যবিয়ে রোধ করার জন্য। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো বা স্কুল কমিটিকে বিষয়টি অবহিত করা জরুরি। তাহলেই হয়তো অনেক শিশুকে ক্ষতির মুখ থেকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব।
বাল্যবিয়ে আইনে কিছু বিষয় আরও বেশি পরিষ্কার করা জরুরি। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭-এর বিশেষ ধারায় ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না বলে উল্লেখ আছে।’ কিন্তু আইনটি আরও বেশি প্রবল করার দরকার ছিল যে, ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে হওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সেটা না করে সেখানে ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ রাখা হয়েছে। সেটার সুযোগ নিঃসন্দেহে সবাই নিবে। বাল্যবিয়ে নিরোধের পুরনো আইন বিলোপ করে নতুন আইন প্রণয়নের সময় থেকে বিশেষ ধারায় অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে বৈধ করার বিষয়ে কানাঘুষা ছিল। শেষ পর্যন্ত এ বছরের মার্চে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ বিশেষ বিধানসহ পাস হয়।
‘আইন থাকেন ঈশ্বরের ওই ভদ্র পল্লীতে’। বিষয়টি এ রকমভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বাল্যবিয়ের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে অষ্টম। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিয়ের হার শূন্যের কোঠায়, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫-১৮ বছরের বাল্যবিয়ের হারকে এক-তৃতীয়াংশে ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছে। প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ১৯২৯ বাতিল করা হয় এবং এর বিশেষ ধারা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
প্রেমের সম্পর্কের কারণে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক গর্ভবতী বা সন্তানের মা হয়েছে এমন বা শিশুর আত্মীয়-স্বজন, মা-বাবা, ভাইবোন, নানা-নানী কেউ জীবিত নেই এবং তার ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য হলে আদালতের সিদ্ধান্তে বিয়ে হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রেও শর্ত জুড়ে বলা হয়েছে, শিশু যদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে তাহলে মা-বাবা বা অভিভাবককে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্র আদালতে দেখাতে হবে। যে শিশুর অভিভাবক নেই এবং ভরণ-পোষণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেই শিশুর বিয়ের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে আদালতে সরকারি শিশুসদন বা সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এতিমখানা কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে তারা শিশুটিকে রাখতে পারবে না। ‘শিশুর নিরাপত্তা দেয়া দুঃসাধ্য’ এই প্রত্যয়নপত্র সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদালতে পেশ করতে হবে।
বিশেষ ধারা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর ৯০ ভাগ মানুষ বিয়ের বয়স ১৮ জানেন বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
আমরা কিন্তু গাছের গোড়া কেটে মাথায় জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। আইন থাক আইনের জায়গায়, আইন কি আমার সন্তান বা আমাদের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিচ্ছে? এ রকম ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক অজুহাত দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আমাদের অভিভাবকরা। মেয়ে হয়েছে, মেয়ের জন্য মাকে অনেক কষ্ট শিকার করতে হয়। কেন মেয়ে সন্তান জন্ম দিল। এভাবে মানসিক, শারীরিক নির্যাতন তো আছেই! সরকার কাজ করছে প্রতিশ্রুতি রাখার প্রত্যয়ে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সরকারের প্রত্যেকটি কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। আর আমাদের অঙ্গীকার হোক আর একটিও হতে দেব না বাল্যবিয়ে। শিক্ষিত হোক নারীরা। এগিয়ে যাক পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও। তাহলেই হাসবে বাংলাদেশ।
লেখক: কলাম লেখক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com