রবিবার ৪ মে ২০২৫ ২১ বৈশাখ ১৪৩২
প্রমত্তা ভৈরব নদের গতিপথ পরিবর্তন
Published : Monday, 13 November, 2017 at 6:00 AM, Count : 893

মো. আলতাফ হোসেন : ভৈরব নদ বাংলাদেশের মেহেরপুর, চুড়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের একটি নদ। ভৈরব নদের তীরে খুলনা ও যশোর শহর অবস্থিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৪২ কিলোমিটার, প্রস্থ ৬০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। এ নদীর তীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে মুজিবনগর, মেহেরপুর, গাড়াবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, বড়বাজার, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, দৌলতপুর ও বাগেরহাট। হিন্দুদের কাছে এটি পবিত্র নদী হিসাবে সমাদৃত।
‘ভৈরব’ এর অর্থ ‘ভয়াবহ’। এক সময় গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ এই নদকে প্রমত্তা রূপ দিয়েছিলো, সেই থেকেই নামটির উত্পত্তি। নদীটির দুইটি শাখা রয়েছে- ইছামতি নদী এবং কপোতাক্ষ নদী। খুলনা-ইছামতীর কিছু অংশ ভারতে এবং বাকিটুকু বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে। এই নদীটি সেখানে বাংলাদেশ ও  ভারতের সীমানা নির্দেশ করে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, এই ভৈরব নদীটির একটি ধারা একসময় যশোরের মাঝ দিয়ে পড়েছিলো কপোতাক্ষ নদে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পলি পড়ে এর মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি মৃত নদীতে পরিণত হয়। এ নদীর  মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। নদীটির উত্পত্তিস্থান থেকে যশোরের নোয়াপাড়া পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম ছাড়া বাকি সময় থাকে মৃত। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে (১৯৮৫) নদীয়া জেলার গঙ্গা রাজপুরে ভারত সরকার ক্রস বাঁধ নির্মাণ করে ফলে ভৈরব নদী তার শেষ অস্তিত্বটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে।
বর্তমানে নদটির অনেকাংশ শুকিয়ে এসেছে। যশোর জেলার বাঘেরপাড়া উপজেলা পার হলে এর আর নাব্যতা থাকে না। বর্ষা মৌসুমে এটি নাব্য থাকলেও শুঙ্ক মৌসুমে নদটি শুকিয়ে যায়। তবে নদটির নিচের দিকের অংশে জোয়ার ভাটা হয় এবং তা সারা বছর নাব্য থাকে।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে ভৈরব নদ দখল উত্সব। আর দখলের কারণে পরিবর্তন হচ্ছে এর গতিপথ। এতে দখলদাররা লাভবান হলেও নিঃস্ব হচ্ছে নদের অন্য পারের মানুষ। বিআইডব্লিউটিএ একপেশে নদ খনন এবং চলমান ভৈরব নদের ওপর সেতু নির্মাণ কাজ ভাঙনকে আরও তীব্রতর করেছে।
নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের দক্ষিণ-পশ্চিমপাড়ে মশরহাটী গ্রাম। এ গ্রামে নদের কূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা প্রতিনিয়ত নদ দখল করে নিচ্ছে। আর এ কারণে নদের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে নদের উত্তর-পূর্বপাশে দেয়াপাড়া গ্রামে অব্যাহত গতিতে চলছে ভাঙন। দেয়াপাড়া গ্রামের ২৬টি পরিবারের প্রায় ৭২ বিঘা (৪২ শতক) জমি নদের মধ্যে চলে গেছে। ইতোমধ্যে ৩টি পরিবারের ভিটেবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি হারিয়ে তারা অন্যত্র অবস্থান নিয়েছে। ভাঙনরোধে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক  নদের মধ্যে তৈরি নির্মিত বাঁধ অপসারণের জন্য এলাকার শতাধিক মানুষ উপঝেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন।
জানা গেছে, উপজেলার মশরহাটী গ্রামের নদের কূল ঘেঁষে পরশ অটোরাইস মিল, আক্তার অ্যাগ্রো ফার্টিলাইজার, সিডল টেক্সাটাইল মিল, নওয়াপাড়া জুট মিল গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা সবাই ভৈরব নদের মাটি ফেলে নিজেদের স্থাপন নির্মাণ করে চলেছেন। অভিযোগ উঠেছে, বিআইডব্লিউটি-এর কতিপয় কর্মকর্তা অবৈধ স্থাপন নির্মাণকারীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নদীর মাঝ দিয়ে ড্রেজিং না করে পূর্বপাশ দিয়ে ড্রেজিং করছেন। আর এতে ভাঙন প্রক্রিয়া তীব্র হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদের গতিপথ প্রায় ২০০ ফুট পূর্বদিকে সরে গেছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) অভয়নগর উপজেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বরে ৭৮ কোটি ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬১৫ টাকা ব্যয়ে ৭০২.৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ মিটার প্রস্থ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-রানকেন জয়েন্ট ভেঞ্চার। মোট ১৫টি পিলারের মধ্যে ১৪টি পিলার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। একটি পিলার থেকে অপর পিলারের দূরত্ব ৫৮ মিটার। নদের মধ্যে পড়েছে তিনটি পিলার। নদের মধ্যে সেতুর ১২ নম্বর পিলার নির্মাণের কাজ চলছে। সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমপাড়ে পরশ অটোরাইস মিল ও আক্তার অ্যাগো ফার্টিলাইজার নদের প্রায় ২০০ ফুট মাটি ভরাট করে দখল করে নিয়েছে। তার মাঝ দিয়ে সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের সুবিধার্থে নদ ভরাট করে ১১ নম্বর পিলার পর্যন্ত চলে গেছে। বাঁধের ওপর সেতুর বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। এর ফলে দেয়াপাড়া অংশে নদের বাইরের ১৩ নম্বর পিলার পর্যন্ত ভেঙে পিলারটি এখন নদের মধ্যে চলে গেছে। নদটি বেঁকে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদের প্রতি পরিবর্তনের ফলে জিয়াউর রহমান গাজী (৩২), মো. ফারুক শেখ (৬৫), আলী হোসেন পাটোয়ারী (৩৩) বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। জিয়াউর রহমান গাজী বলেন, ওপারে নদীদখল এবং সর্বশেষ নদী ড্রেজিংয়ের ফলে আমাদের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। দেয়াপাড়া গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, নদের পাড়ে আমার ৪৮ শতক কৃষি জমি ছিল। নদের মধ্যে লম্বা ও চওড়া বাঁধ নির্মাণ এবং অব্যাহত দখলের জন্য সব জমি ভেঙে নদের মধ্যে চলে গেছে।
পরশ অটোরাইস মিলের মালিক মো. আনিসুর রহমান বলেন, আমি নদী দখল করিনি। বরং নদের চর কেটে আমি আমার পুকুর ভরাট করেছি। মিলের সামনে নদের চরটি আমি বিআইডব্লিউটিএ’র কাছ থেকে লিজ নিয়ে ব্যবসা করছি। নওয়াপাড়া নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক মাসুদ পারভেজ আনিসুর রহমানের দাবি অস্বীকার করে বলেন, উনিসহ আক্তার ফার্টিলাইজার ও সিডল টেক্সটাইল মিল দীর্ঘদিন অবৈধভাবে নদী দখল করে আছে। এর সঙ্গে সেতু নির্মাণ করতে নদের মধ্যে মাটি দিয়ে প্রায় ২০০ ফুট লম্বা এবং প্রায় ৬০ ফুট চওড়া একটি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। 
এতে বাঁধে স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদটির উল্টোদিকে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। অভয়নগর উপজেলা প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সরদার বলেন, নদের ওই অংশ কিছুটা উঁচু ছিল। ঠিকাদার এ সুযোগটা গ্রহণ করে বাঁধ নির্মাণ করেছে। আমরা তাদের বাঁধটি অপসারণ করতে বলেছি। শ্রীধরপুর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিআইডব্লিউটিএর লোকজন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নদীর মাঝ দিয়ে ড্রেজিং না করে পূর্বপাশ দিয়ে করছে। এতে ভাঙন বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘদিন নদী দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছি, কিন্তু দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তাতে উপকার হয়নি।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com