শনিবার ৩ মে ২০২৫ ২০ বৈশাখ ১৪৩২
মৃৎশিল্প ও আমাদের ঐতিহ্য
Published : Thursday, 16 November, 2017 at 6:00 AM, Count : 895

মো. ওসমান গনি : বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য রূপ লাভ করেছে মৃিশল্প। বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হয় সে দেশ বা জাতি। এক একটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একটি দেশ বা জাতির অবদান। বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্র্যের দেশ। এদেশে অতীতকাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলো ‘মৃিশল্প’। বাংলাদেশের মৃিশল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের রূপকার হলেন কুমার শ্রেণির পেশাজীবীরা। এদেশের কুমার শ্রেণি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, পাল পদবিতে পরিচিত। বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করে আসছেন। ‘মৃত্’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে নিজ হাতে তৈরি শিল্পকর্মকে ‘মৃিশল্প’ বলে। কুমাররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধাঁনো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। মাটি দিয়ে তৈরি এই শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, খানদা, ফুলের টব, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, ঘটি-বাটি, ডাবর-মটকি, প্রতিমা, মাটির ব্যাংক,শোপিস, পিঠা তৈরির ছাঁচ, নানা রকম খেলনা। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশে বেশি। পরিবেশবান্ধব এই শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে। গ্রীষ্মকালে মাটির কলসির একগ্লাস পানি যেন দূর করে দিত সব ক্লান্তিকে।
ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায়, মাটির শিল্প প্রথম চীনের বিখ্যাত শহর থাংশানে প্রচলিত ছিল। এই শহরটিকে মৃিশল্পের শহর বলা হয়। মিং রাজবংশের ইয়ং লে এর সময়কালে থাংশানে মৃিশল্পের উত্পত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত হয়। বর্তমানে চীনে ৫০০টির বেশি মৃিশল্পের সামগ্রী দেখা যায়। চীনে এই মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হয় ‘সেলাডন’ চীনারাই এশিয়া, ইউরোপে তাদের এই ‘সেলাডন’ ছড়িয়ে দেয়। প্রাচীনকাল থেকে মৃিশল্প বিভিন্ন সভ্যতায় অনেক মর্যাদা লাভ করেছে। আমাদের দেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবের নিদর্শন এই মৃিশল্প। আমাদের দেশে অনেক কাল আগে থেকেই এই মৃিশল্পের চলন চলে আসছে। অতীতে যখন কাচ, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়ামের প্রচলন ছিল না, তখন মানুষ মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করতো। মাটির শিল্পেই এদেশের প্রাচীন শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়। এটি এদেশের নিজস্ব শিল্প। বৈশাখী মেলায় ও নানা পার্বনে গ্রামের কুমারদের নিপুণভাবে তৈরি মাটির জিনিসপত্র অকৃত্রিম সৌন্দর্য বর্ধন করে। হাঁড়ি-পাতিল-কলসি ছাড়াও আমাদের দেশের এক সময়ে গড়ে ওঠা সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের কাজ যার নাম ‘টেরাকোটা’ তা এই প্রাচীন মৃিশল্পের অবদান। নকশা করা মাটির ফলক ইটের মত পুড়িয়ে তৈরি হত এই টেরাকোটা। ময়নামতির শালবন বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে যেসব পোড়ামাটির ফলকের নিদর্শন রয়েছে সেইসব এই প্রাচীন মৃিশল্পের উদাহরণ।
সম্প্রতি নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে নানা ধরনের মাটির পাত্র আর ফলক, যা আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের নিদর্শন। একটি সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি ঘরে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার হতো। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় সহজ পরিবহণ, কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পর্যাপ্ত জ্বালানি এবং সর্বোপরি দেশব্যাপী বিপুল চাহিদা থাকায় অতীতে মৃিশল্পের ছিল জয়জয়কার। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখনকার চিত্রটা ভিন্ন। কম চাহিদা, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত মাটির মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি সঙ্কট, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসংগতি, ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা ইত্যাদি নানা কারণে মুখথুবড়ে পড়েছে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এই মৃিশল্প। মূলত প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থের তৈরি তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। এক সময় কুমারপাড়াগুলো মাটির কাঁচা গন্ধে থাকতো মাতোয়ারা। ব্যস্ত কুমাররা হিমশিম খেতেন চাহিদা মেটাতে। হাটবাজারে মাটির তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসতেন মৃিশল্পিরা। নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়াও শিশুদের খেলনা, সৌন্দর্য বর্ধন সামগ্রীসহ বিভিন্ন বাহারি মাটির তৈজসে পূর্ণ থাকতো কুমারপাড়া। তখনকার প্রতিযোগিতার বাজারে বস্তুকে আকর্ষিত করতে দৃষ্টিনন্দিত আলপনার ছোঁয়াও দেয়া হতো। কিন্তু আজ এই সবই অতীত। গাঁয়ের কুমারপাড়ায় আর কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না। নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনও কিছু জরাজীর্ণ কুমার পরিবার ধরে রেখেছে বাপ-দাদার পেশা। যা ‘মরা গাছে পানি দেয়ার মতো চলছে। কুমাররা অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন তাদের কেউ কেউ স্বর্ণের কাজ, কেউ বিদেশে আবার কেউবা কামারের কাজ করছে। যে গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে যেখানে দিনরাত ঘুরতো কুমারের চাকা, পানিতে মিশত নরম কাদা, রোদে শুকাত হাঁড়ি-পাতিল, পোড়ানো হতো সেসব জিনিস আর আচড় পড়ত রঙ তুলির কালের বিবর্তনে সেখানে শুধু লাভহীন এই পেশাকে বর্তমানে বাপ-দাদার পেশা রক্ষায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে মুষ্টিমেয় কুমার, যারা অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। আশার কথা হলো কুমার শিল্পীরা আবার যেন তাদের নিখুঁত কাজের মাধ্যমে ফিরে আসছে আমাদের মাঝে। দেশ ছেড়ে বিদেশেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে কুমারদের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দিত মৃিশল্পের শখের জিনিসপত্র। এককালের মৃিশল্পের তৈজসপত্র রাজা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারের নিত্য ব্যবহার্য বস্তু একালের শিল্প সচেতন ব্যক্তিরা কদর করছেন বেশ। তাদের চাহিদায় শৌখিনতার অনুসঙ্গ হচ্ছে মাটির এসব জিনিস। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা প্রকাশ করছে। সঠিক ব্যবহারে প্রশংসা ওপায় এসব জিনিস ব্যবহারকারী। আর আমাদের কুমাররা নিজ প্রচেষ্টায় খুব অল্প দামে এই জিনিসগুলো সরবরাহ করছে দেশের সর্বত্র বিপনিকেন্দ্রে। বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া মৃিশল্প আবার যেন ফিরে আসছে তাদের নিঁখুত কাজের মাধ্যমে। একমাত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে আমরা আমাদের শেকড়ের এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি যা আমাদের অন্যতম রফতানি পণ্য হিসেবে বিদেশে স্থান নিতে পারবে এবং আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
ভবিষ্যতে যেন এই শিল্প আর ধ্বংসের পথে ধাবিত না হয় সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মা আর মাটির সঙ্গে এদেশের মানুষের নাড়ির টান। আবহমান কাল থেকেই বাংলা ও বাঙালি নামের সঙ্গে মিশে আছে মাটির গন্ধ। কুমার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের মাটির দেশের এই মাটির শিল্প।
লেখক: কলামিস্ট



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com