শিরোনাম: |
সুশাসনই গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র
|
![]() উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই একটি বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়- সেটা হলো, একটি দেশের সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধনের জন্য ‘গণতন্ত্র’ ও ‘উন্নয়ন’ এ দুটির মধ্যে কোনটি বেশি জরুরি? গণতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন, একমাত্র নির্ভেজাল গণতন্ত্রই একটি দেশের কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করতে পারে। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই দেশের সার্বিক জনকল্যাণ সাধিত হতে বাধ্য। সবার আগে চাই গণতন্ত্র। তাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন কঠিন কিছু নয়। তবে আমরা গণতন্ত্রই বলি আর উন্নয়নই বলি, সবকিছুর মূলে রয়েছে সুশাসন। একটি দেশ যদি সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র উভয়ই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। বিশ্বে এমন একটি দেশেরও উদাহরণ দেয়া যাবে না, যারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। সেটা যতই গণতান্ত্রিক দেশ হোক না কেন। একটি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর নিজস্ব নিয়মের মধ্যে চলার স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের সেতুবন্ধন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় ‘ফোর্থ স্টেস্ট’ বা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষায় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিচার করা হয় সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। নির্বাচনই শুধু গণতন্ত্রের মাপকাঠি নয়। সাংবিধানিক উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছাড়া গণতন্ত্র পরিপক্কতা পায় না। এমন পরিস্থিতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিগত দাঙ্গাসহ ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভিযাত্রা দীর্ঘদিনের নয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসনের কালো থাবা দেখেছে এদেশের মানুষ। নব্বইয়ের পরে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু হলেও নানা সময়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্রান্ত্র আমরা দেখেছি। যার সর্বশেষ উদাহরণ আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনা। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে দেশে উন্নয়নের এক বিশেষ ধারা সৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে গণতান্ত্রিক চর্চাও যে কোনো সময়ের তুলনায় গতিশীল হয়েছে। তবে কার্যকর গণতন্ত্রের পথে আরও পথ পারি দিতে হবে আমাদের। আসলে সবকিছুর উন্নয়ন ও উত্কর্ষ সাধনই একটি চলমান প্রক্রিয়া। দুই বা আড়াই দশকের অভিযাত্রায় দুইশ’ বছরের পরিপক্ক গণতন্ত্র পাওয়া যাবে না। তবে উন্নতির লক্ষ্যে উদারতা একান্ত আবশ্যক। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান দুই মেয়াদে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা শুধু প্রশংসনীয় নয়, নজিরবিহীন। একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে যারা উপহাস করত এখন তারাই বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। বর্তমানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের খুব কম দেশের পক্ষেই এমন অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে। জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় যেখানে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ছিল ১২৯ মার্কিন ডলার, এখন তা ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এক সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছিল। এখন তা প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্ষেত্রে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভারতের পরেই। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। খাদ্যে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশ, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন রয়েছে বিদ্যুতের ছোঁয়া। দেশব্যাপী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা চলমান রয়েছে। পায়রা বন্দর হয়েছে, পদ্মা সেতুর কাজও এগিয়ে চলছে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বর্তমান সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে অচিরেই বিশ্বের বুকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সরকার প্রায় ১৪০০ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মানুষেরাই বাংলাদেশকে চিনতে পারবে না। কিন্তু এত এত অর্জনের পরও কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে দেশের মানুষ। সন্দেহ নেই বর্তমান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের গণতন্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সদা সচেষ্ট রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। তবে এটা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করি, সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। তাই বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বের যে গুজব রয়েছে, তা ভুল প্রমাণে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন। কিন্তু আমাদের দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা চরমভাবে দ্বিধাবিভক্ত। তাদের অনেকে সরকারের সমালোচনাকেই শুধু প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এতে করে তাদের বিপরীত পক্ষও একই নীতি অনুসরণ করে। ফলশ্রুতিতে কাদা ছোঁড়াছুড়িই হয় শুধু। গণতন্ত্রের উন্নয়নে তাদের নিরপেক্ষ অভিমত থেকে যায় উপেক্ষিত। এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে। একটি পক্ষ যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা ক্ষমতায় যেতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু করতেও পিছপা হবে বলে মনে হয় না। ইতিপূর্বে এবং সম্প্রতি এর বিভিন্ন আলামত দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জঙ্গিদের বিমান হামলার পরিকল্পনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবারও সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া শুরু হয়েছে। গত বছরেও দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের হত্যা ও তাদের ঘর-বাড়িতে নজিরবিহীনভাবে হামলা ও আগুন দেয়া হয়েছিল। মূলত এহেন সবকিছুই একটি চক্রান্তের মদদে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়েও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চেষ্টা চলছে। বর্তমান সরকারকে বিপদে ফেলতেই এসব পাঁয়তারা করছে স্বার্থান্বেষীরা। তাই এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সতর্ক ও দূরদর্শী হতে হবে। কোনো দেশে সত্যিকার অর্থে টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। সুশাসন না থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই সবার আগে একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সুশাসনের কোনো বিরোধ নেই। বরং গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে টেকসই এবং অধিকতর কার্যকর করতে হলে সুশাসনের হাত ধরে চলতে হবে। সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পৃথকভাবে জনকল্যাণ সাধন করতে পারে না। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একান্তভাবে জরুরি। লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান। |